৬ সন্তানকে আলোকিত করতে চা শ্রমিক শিলা গোয়ালার সংগ্রামের গল্প

নিজে কোনোদিন স্কুলে যেতে পারেননি বলে আক্ষেপ ছিল, তাই সন্তানরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হোক- তা চাননি চা শ্রমিক শিলা গোয়ালা।

বিকুল চক্রবর্তী মৌলভীবাজার প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Dec 2020, 04:12 AM
Updated : 7 Dec 2020, 05:09 AM

এই সংগ্রামে পাশে থেকে শিলাকে সহায়তা করেছেন স্বামী কানাই গোয়ালা। এই দম্পতি তাদের ছয় সন্তানকেই উচ্চশিক্ষায় নিয়ে গেছেন।

তাদের বড়ো মেয়ে লিপি গোয়ালা সিলেটের এমসি কলেজ থেকে উদ্ভিদ বিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করেছেন; দ্বিতীয় সন্তান বাক্ প্রতিবন্ধী জয় গোয়ালা শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যিমিক পাস করে স্নাতক তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়েছেন; তৃতীয় সন্তান মনি গোয়ালা মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ থেকে বাংলায় এমএ করেছেন; চতুর্থ সন্তান রুপু গোয়ালা বিএস-সি ইন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করেছেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে; পঞ্চম সন্তান পিন্টু গোয়ালা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র এবং ষষ্ঠ সন্তান শ্রাবণী গোয়ালা শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে চট্টগ্রামে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর ওইমেন্স-এ পড়ছেন।

এরমধ্যে বড়ো মেয়ে লিপি গোয়ালার সরকারি প্রাইমারি স্কুলে সহকারী শিক্ষিকার চাকরিও হয়েছে।

একজন চা শ্রমিকের মেয়ে শিলা কুর্মির আজকের এই শিলা গোয়ালা হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে এক অনুকরণীয় সংগ্রামের গল্প।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শিলা তার জীবনের গল্প শোনান।

ছয় সন্তানের সঙ্গে কানাই ও শিলা গোয়ালা

৫৩ বছর আগে ১৯৬৭ সালে সিলেটের মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট ইউনিয়নের রাজঘাট চা বাগানে এক সাধারণ চা শ্রমিকের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন শিলা। তার বাবা-মা জহর লাল কুর্মি ও ভগন্তি কুর্মি।

শিলা জানান, চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। বাবার টানাপড়েনের সংসার। বাগানে মায়ের কাজেই সংসার চলে। মায়ের শরীর খারাপ হলে কাজে যেতে না পারলে হাজিরা নেই; তখন অভাব আরও বেড়ে যায়। ভাতের মার, কচু সেদ্ধ এমন খাবার খেয়ে বহুদিন কেটেছে তাদের।

শিলা বলেন, একটু বেশি বয়সেই তার বিয়ে হয় একই বাগানের শ্রমিক কানাই গোয়ালার সঙ্গে। সেটিও ছিল টানাপড়েনের সংসার। বিয়ের কিছুদিন পর তাদের প্রথম সন্তান লিপির জন্ম হয়। অভাবের সংসারে খরচ আরও বেড়ে যাওয়ায় শিলা ও কানাই দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। তাই তারা বিকল্প আয়ের সন্ধান করেন।

শিলা গোয়ালা বলেন, আয় বাড়াতে তার স্বামী বাগান থেকে কাজ শেষে ফিরে জ্বালানি কাট কুড়িয়ে আনতেন। শিলা ওই কাঠ কেটে দিলে স্বামী বাজারে বিক্রি করতেন। পাশাপাশি শিলা নিজেও বাগানের অন্য শ্রমিকের কাছ থেকে ডালপালা কিনে টুকরো করে অল্প লাভে বিক্রি করতেন।

ঘরের কাজে ব্যস্ত শিলা গোয়ালা

এভাবে শিলা-কানাইয়ের সংসার চলছিল। তখন তাদের দ্বিতীয় সন্তান জয় গোয়ালা।

শিলা বলেন, তাদের একেকটি সন্তান হয় আর শিলা দম্পতির দুশ্চিন্তা বাড়ে। এক পর্যায়ে শিলা বাড়ির পাশের রাস্তায় বসে ডিম সিদ্ধ করে বিক্রি করা শুরু করেন। সঙ্গে আটার গোল্লাও বিক্রি করতেন।

এই সময শিলার স্বপ্নের প্রথম ধাপ পূরণ হয় যখন শিলা তার প্রথম সন্তান লিপিকে বাগানের স্কুলে ভর্তি করেন। সেদিন তার আনন্দের শেষ ছিল না।

এরপর একে একে শিলার আরও ছেলে-মেয় হয়, যাদের প্রত্যেককেই তিনি শিক্ষিত করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।

শিলা বলেন, তাদের যখন ছয় সন্তান (দুই ছেলে ও চার মেয়ে) তখন সঞ্চিত অর্থ দিয়ে তিনি একটি গাভি ক্রয় করেন। একটি গাভি থেকে কয়েকটি গাভি হয়। দুধ বিক্রি করেন; দুধ থেকে দই করেও বিক্রি করেন; দুধের সর থেকে ঘি তৈরি করেও বিক্রি করেন।

কানাই ও শিলা জানান, এরপর তারা রাজঘাটেই বাড়ির পাশে ঘর নিয়ে চা, পান, সিঙ্গারা বিক্রি করেন; শিলা সেলাই শেখেন। ভোর ৩টায় উঠে দোকানের সিঙ্গারার সবজি কাটাসহ অনান্য কাজ করতেন। গ্রামীণ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সমিতি থেকে  ঋণ নিয়ে দোকানে পুঁজি বাড়ান। স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে পরিশ্রম করেন ব্যবসার জন্য্।

ছয় সন্তানের সঙ্গে কানাই ও শিলা গোয়ালা

এভাবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর এই দম্পতি তাদের সংগ্রামী জীবন চালিয়ে যান।

শিলা গোয়ালার স্বামী কানাই গোয়ালা বলেন, তার প্রথম সন্তান জন্মের সময় সাপ্তাহে হাজিরা পেতেন ১০০ টাকার মতো। পরবর্তীতে ১৪০ টাকা, ১৬০ টাকা, ২০০ টাকা, ৩০০ টাকা, ৬০০ টাকা, যা বর্তমানে সাপ্তাহে ৭১৪ টাকায় উঠেছে।

সন্তানের লেখাপড়ার খরচ যোগার করতে গিয়ে তার স্ত্রী শিলা গোয়ালা দেবীর ভূমিকা রেখেছেন বলে কানাই স্বীকার করেন অকপটে।

“অনেক দিন আধপেটা খেতে হয়েছে। নিজের জন্য কখনও ভালো কোনো জামা-কাপড় কিনতে পারিনি। স্ত্রীকে মনের মতো একটা শাড়ি কিনে দিতে পারিনি,” বলেন কানাই।

শিলা গোয়ালা বলেন, শুধু তার সন্তানকেই লেখাপড়া করানো নয় তার বড় ছেলে জয় গোয়ালা মিঠুকে বিয়ে দিয়ে পুত্রবধূ পুস্প গোয়ালাকেও ভর্তি করে দিয়েছেন শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজে।

শিলা গোয়ালার বড় মেয়ে লিপি গোয়ালা সরকারি প্রাইমারি স্কুলে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।

কানাই-শিলা দম্পতি সরকারের কাছে তাদের অন্য সন্তানদের জন্য যোগ্যতানুসারে চাকরির আবেদন জানিয়েছেন। 

শিলা প্রমাণ করেছেন শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে দারিদ্র্য কোনো বাধা নয়, প্রবল ইচ্ছাশক্তিই বড়ো।

গৃহস্থালী কাজে ব্যস্ত শিলা গোয়ালা

এই ব্যাপারে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মাখন লাল কর্মকার বলেন, অনেক বিত্তবান বাড়ির কাছে স্কুল কলেজ রেখেও অনেক ক্ষেত্রে তাদের একটা দুটা সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত করতে পারেন না। আর শ্রীমঙ্গল রাজঘাট চা বাগানের পিছিয়ে পড়া এই অধিবাসী শিলা গোয়ালা বাগানের ভিতরে ছোট একটি ব্যবসা করেই ছয় সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় নিয়ে গেছেন। এটি চা শ্রমিকদের জন্য অনুকরণীয়।

রাজঘাট চা বাগানের এক শিক্ষিত যুবক সেলিম হক বলেন, শিলা গোয়ালা নিজে লেখাপড়া জানেন না, কিন্তু তার প্রত্যেক সন্তানকে শিক্ষিত করেছেন। শুধু সন্তানদের শিক্ষিত করা নয় তিনি বাগানের বিভিন্ন লাইনে লাইনে ঘুরে শ্রমিকদের বোঝান তাদের সন্তানদের যেন লেখাপড়া করান। যত কষ্টই হোক কারো সন্তানই যেন লেখাপড়া থেকে বাদ না পড়ে।

এই ব্যাপারে শিলা গোয়ালা বলেন, “আমার সন্তানকে আমি কষ্ট করে লেখাপড়া করিয়েছি। কিন্তু আমি চাই আমার বাগানে সকল শ্রমিকের সন্তানরাই লেখাপড়া করুক।”

সময় পেলেই শিলা পাড়ায় বেড়াতে যান এবং নারী শ্রমিকদের কাছে নিজের কষ্ট আর সাফল্যের গল্প বলেন। তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করাতে সাহায্যের প্রয়োজন হলে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতও দেন।