ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় থমকে নীলফামারী-সৈয়দপুর সড়ক উন্নয়ন

ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় নীলফামারী-সৈয়দপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক প্রশস্ত ও মজবুত করার কাজ বন্ধ হয়ে আছে।

নীলফামারী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Oct 2020, 12:35 PM
Updated : 3 Oct 2020, 06:49 PM

নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার ওয়াপদা মোড় থেকে জেলা শহরের চৌরঙ্গী মোড় পর্যন্ত সাড়ে ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কের উন্নয়ন কাজের প্রথম দফার সময়ের মেয়াদ শেষে আবার সময় বাড়ানো হয়। দ্বিতীয় মেয়াদের সময় বাকি আছে আর নয় মাস।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী দুই দফা মেয়াদে কাজের ২৫ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে।

এদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা এবং অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো হলেও ভূমি অধিগ্রহণ আর স্থাপনার ক্ষতিপূরণের টাকা দুই বছরেও বুঝে পাননি ক্ষতিগ্রস্তরা। ক্ষতিপূরণের টাকা বুঝে না পাওয়ায় জমি ছাড়ছেন না ভূমি মালিকরা।

উন্নয়ন কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বলছে, ভূমি মালিকরা ক্ষতিপূরণের টাকা না পাওয়া জমি ছাড়ছেন না। কাজ শুরু করলেই ভূমি মালিকরা বারবার বাধা দিচ্ছেন। আর সড়ক বিভাগ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে জমি বুঝিয়ে দিচ্ছে না। এই জটিলতায় সড়ক উন্নয়ন কাজ বন্ধ রয়েছে।

অপর দিকে নীলফামারী সড়ক ও জনপথ বিভাগের দাবি, ভূমি অধিগ্রহণের চারটি এলএ (ভূমি অধিগ্রহণ) মামলার মধ্যে তিনটি এলএ কেসের টাকা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসনের কাছে। কিন্তু জেলা প্রশাসন এখনও জমি বুঝিয়ে দেয়নি সড়ক ও জনপথ বিভাগকে।

জেলা প্রশাসন দাবি করছে, ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাবনা তৈরিতে ত্রুটি থাকায় সেসব সংশোধনে সময় লাগছে।

অন্যদিকে জমি ও স্থাপনার মালিকরা বলছেন, প্রায় দুই বছর ধরে ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বারবার ধর্ণা দিয়েও কাজ হচ্ছে না। নিরুপায় হয়ে কাজে বাধা দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।

ক্ষতিপূরণ আদায়ে দুই বছরে বেশ কয়েকবার সড়ক অবরোধ, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।

নীলফামারী সড়ক ও জনপথ বিভাগ জানায়, নীলফামারী-সৈয়দপুর আঞ্চলিক মহাসড়কটির সাড়ে ১৫ কিলোমিটার ১৮ ফুট থেকে বৃদ্ধি করে ৪২ ফুট প্রশস্ত করতে ২০১৭ সালের ‘নীলফামারী-সৈয়দপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক প্রশস্তকরণ ও মজবুতকরণ’ প্রকল্পের জন্য ২২৫ কোটি টাকা অনুমোদন দেয় একনেক।

এ টাকার মধ্যে ৫৪ দশমিক ৬১৫ একর জমি অধিগ্রহণ এবং স্থাপনা ক্ষতিপূরণ বাবদ ১১৫ কোটি টাকা এবং সড়ক উন্নয়ন কাজের জন্য ১১০ কোটি টাকা ধরা হয়।

দরপত্র গ্রহণ শেষে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে সড়ক সম্প্রসারণে ৫৪ দশমিক ৬১৫ একর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসনকে প্রস্তাবনা দেয়। এরপর ওই বছরের ২ অগাস্ট এক বছরের সময় নির্ধারণ করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নাভানা কনস্ট্রাকশন এবং ইসলাম ব্রার্দাসকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়।

এই সাড়ে ১৫ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে সৈয়দপুর ওয়াপদা মোড় থেকে জেলা সদরের গ্লোরী সিরামিকস পর্যন্ত আট কিলোমিটার সড়কের কাজ পায় নাভানা কনস্ট্রাকশন এবং গ্লোরী সিরামিকস থেকে জেলা শহরের চৌরঙ্গী মোড় পর্যন্ত সাড়ে সাত কিলোমিটার সড়কের কাজ পায় ইসলাম ব্রার্দাস।

সড়কের জন্য প্রয়োজনীয় জমি ও স্থাপনা অধিগ্রহণে এলএ কেস চারটি অংশে ভাগ করে সড়ক বিভাগ, বনবিভাগ ও গণপূর্ত বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ শুরু করে জেলা প্রশাসন।

ওই চার অংশের মধ্যে তিনটি অংশের ভূমি অধিগ্রহণ এবং ক্ষতিপূরণের অর্থ জেলা প্রশাসনকে বুঝিয়ে দেয় সড়ক ও জনপথ বিভাগ। তিনটি অংশের মধ্যে একটি অংশের ভূমি মালিকদের জেলা প্রশাসন ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদান করলেও নানা জটিলতায় আটকে যায় বাকি দুইটি অংশের ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা প্রদানের কাজ।

আর করোনাভাইরাস মহামারীতে শহরের কালিতলা থেকে চৌরঙ্গী মোড় পর্যন্ত অংশের মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু করা হয়নি।

জেলা সদরের চড়াইখোলা ইউনিয়নের দারোয়ানী পিলার বাজারের ব্যবসায়ী মো. সামাদুল হক (৫৭) বলেন, রাস্তার উন্নয়ন কাজের জন্য তার পাঁচ শতক জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ওই জমিতে তার বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল।

“দুই বছর আগে রাস্তার কাজ শুরু হলে আমার বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভেঙে কাজ শুরু করে সড়ক বিভাগ। কিন্তু আজও আমার জমির মূল্যসহ স্থাপনার ক্ষতিপূরণ পাইনি।”

একই এলাকার ভূমির মালিক কতুব উদ্দীন (৪০) বলেন, “রাস্তার কাজের জন্য আমার সাড়ে ১৮ শতক জমি নিয়েছে সরকার। এ অংশের রাস্তার কাজ প্রায় শেষ, কিন্তু আজও আমি ক্ষতিপূরণের টাকার জন্য ঘুরছি।”

ক্ষতিপূরণের টাকার টাকার দাবিতে এক বছর আগে তারা সড়ক অবরোধ করে মানববন্ধন করলে জেলা প্রশাসন থেকে বলা হয়েছিল ১৫ দিনের মধ্যে টাকা দেবে। এরপর একাধিকবার ভূমি মালিকরা জেলা প্রশাসনে যোগাযোগ করলেও ফল মেলেনি বলছেন ভুক্তভোগীরা।

দারোয়ানী টেক্সটাইল মিল বাজারের ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান লাল বাবু (৩০) বলেন, আড়াই মাস আগে টাকা আসার কথা শুনে তারা জেলা প্রশাসনে যোগাযোগ করেন।

হাবিবুর বলেন, তখন তাদের বলা হয়েছিল- টাকা দেওয়া হবে; ১৫ দিনের মধ্যে তাদের কাছে পিডব্লিউডি, এলএ শাখা, বনবিভাগসহ সংশ্লিষ্ট ভিাগের লোকজন যাবে।

এরপর তিন মাস কেটে গেলেও সমস্যার কোনো পরিবর্তন হয়নি বলছেন তারা।

ওই বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুল জলিল (৭০) বলেন, দুই বছর আগে তাদের দোকান না ভাঙলে ঠিকাদার কাজ শুরু করতে পারছেন না। সে সময় তারা বলা হয়েছিল অল্প সময়ের মধ্যে তারা ক্ষতিপূরণের টাকা পাবেন।

সময়মতো টাকা পেলে ওই ব্যবসায়ীরা বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারতেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “দীর্ঘ সময়েও টাকা না পাওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী পরিবার নিয়ে পথে বসেছেন। এখন টাকা এসেছে, কিন্তু ডিসি পুনরায় দেখে টাকা দেবেন বলে আমাদের জানিয়েছেন।”

নগর দারোয়ানী মোল্লাপাড়ার গ্রামের ওসমান গণি (৫৫) বলেন, “যখনই সড়ক অবরোধ করি তখনই সরকারি লোকজন এসে আশ্বাস দেয় টাকা পাবেন। এরপর আর তাদের খোঁজ থাকে না। বারবার ডিসির কাছে ধর্ণা দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। আসলে কার কাছে গেলে টাকা পাব বলতে পারেন?”

পিলার বাজারের ভূমির মালিক আব্দুল ওয়াহেদ (৬০) বলেন, “আমি কয়েকবার জেলা প্রশাকের সাথে দেখা করেছি, তৎকালীন জেলা প্রশাসক মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে আমাদের সময় নষ্ট করেছেন।

“বর্তমান জেলা প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমানের সাথে দেখা করে জানতে পেরেছি, যখন সড়কের জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করা হয় তখন জরিপ কাজে দায়িত্বরতরা নানা অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে প্রকৃত ভূমির মালিকের পাশে ভাড়াটিয়া, দখলদার দেখিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করেছে; যার কারণে আমরা ক্ষতিপূরণের টাকা আজও পাইনি।”

এদিকে জমির দাম ও প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রকল্প ব্যয় সংশোধন করে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ৪৪৩ কোটি টাকা অনুমোদন দেয় একনেক; যার মধ্যে ভূমি ও স্থাপনা অধিগ্রহণ ব্যয় ধরা হয় ৩১৩ কোটি টাকা।

ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ইসলাম ব্রাদার্সের প্রতিনিধি মো. কামরুল ইসলাম বলেন,“আমরা জমি মালিকদের বুঝিয়ে তাদের জায়গায় কাজ শুরু করেছিলাম। এখন দীর্ঘ সময়েও ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় কাজে বাধা দিচ্ছেন জমি মালিকরা। ফলে গত জুন মাস থেকে কাজ বন্ধ রয়েছে।

“এমন সমস্যায় একটি অংশের ঠিকাদার নাভানা বিল্ডার্স চুক্তি বাতিল করে চলে গেছেন। দ্রুত সমাধান না হলে আমাদেরকেও কাজ ছেড়ে চলে যেতে হবে।”

জেলা শহরের পরিবহন চালক আব্দুল আউয়াল (৩৫) বলেন,“জেলা শহর থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যোগাযোগের একমাত্র সড়কটির দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার কাজ চলছে। শেষ না হওয়ায় ভাঙা সড়কে চলাচল করতে হচ্ছে। এতে যানবাহনের যেমন ক্ষতি হচ্ছে তেমনি সময়ও অপচয় হচ্ছে।”

নীলফামারী সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ মঞ্জুরুল করিম বলেন, “ভূমি অধিগ্রহণের জন্য সড়কটিকে চারটি অংশে বিভক্ত করা করা হয়। এরই মধ্যে তিনটি অংশের বিপরীতে জেলা প্রশাসনকে ২৫৮ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। একটি অংশের প্রাক্কলন এখনও পাইনি। সেটি পেলে তাদের চাহিদামত টাকা দেওয়া হবে।”

তিনি বলেন, জেলা প্রশাসন একটি অংশের অধিগ্রহণ নিষ্পত্তি করে জায়গা বুঝিয়ে দিয়েছে, যার দৈর্ঘ্য ৪ কিলোমিটার ৩০০ মিটার। ওই অংশের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি তিনটি অংশ নিষ্পত্তি না হওয়ায় ঠিকাদার কাজ করতে পারছেন না। এরই মধ্যে দুটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নাভানা কনস্ট্রাকশন নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে চিঠি দেয়।

“আমরা চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের (নাভানা কনস্ট্রাকশন) চুক্তিপত্র বাতিল করে ওই অংশে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করেছি।

জেলা প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন,“অধিগ্রহণের কাজটি শুরু হয়েছিল ১৯৮২ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে নতুন গেজেট হলে নতুন আইন ধরে ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়ার চূড়ান্ত প্রাক্কলন করা হয়। এনিয়ে প্রকল্পের শুরু থেকে একটি জটিলতা শুরু হয়েছিল। এই জটিলতায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সময় চলে গেছে। পরবর্তীতে স্থানীয় সংসদ সদস্যে এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ‘রিভাইজড পিপি’ হয়ে টাকাটা আমাদের কাছে এসেছে। এরপর যখন আমরা জনগণকে এ ক্ষতিপূরণ দেব তখন দেখা গেল এটি প্রস্তুতের সময় (প্রস্তাবনা) কিছু ভুলক্রটি রয়ে গেছে। আইনে বলা আছে, ভুল যখনই জেলা প্রশাসকের গোচরীভূত হবে, তখনই সংশোধন করে চেক প্রদান করতে হবে। সে অনুযায়ী জেলা প্রশাসন, প্রত্যাশী সংস্থা, গণপূর্ত বিভাগ ও বনবিভাগকে যুক্ত করে কাজ করছি আমরা। একটা সিস্টেমে কাজ সম্পন্ন করতে হবে; সে অনুযায়ী আমরা আগাচ্ছি। ইতিমধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে একটি পত্র প্রেরণ করেছি। সব পেলে এ বছরেই কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।”

তিনি জানান, ওই সড়কের জমি ও স্থাপনা অধিগ্রহণে চারটি ভাগ করা হয়েছে; যার মধ্যে একটি অংশের ক্ষতিপূরণ প্রদান করে জায়গা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে একটি অংশের মাঠ বই তৈরি করা যাচ্ছে না।