কুড়িগ্রামে দুর্ভোগে বানভাসি মানুষ

কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি কিছুটা কমলেও সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে; বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ কমেনি।

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 July 2020, 03:31 PM
Updated : 2 July 2020, 05:22 PM

ধরলা, দুধকুমর ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার উপর প্রবাহিত হচ্ছে। টানা সাত দিন ধরে এই তিন নদীর অববাহিকায় পানিবন্দি রয়েছে হাজার হাজার মানুষ।

পানীয় জলের সংকটের সঙ্গে রয়েছে পয়ঃনিষ্কাষণ সমস্যা। মানুষ কর্মহীন দিন কাটাচ্ছে।

এদিকে, ধরলা নদীর ভাঙনে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নে সারডোব গ্রামে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৪০০ মিটার অংশে ভাঙন ধরেছে। ইতোমধ্যে বাঁধের বেশিরভাগ অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমরের পানি কিছুটা কমলেও বিপৎসীমার উপর বইছে। ধরলা বিপৎসীমার ২৯ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্র চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার উপর এবং দুধকুমর নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

সরেজমিনে উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন চরে গিয়ে দেখা গেছে বানভাসীদের সীমাহীন দুর্ভোগ।

হাতিয়ার বাবুরচর গ্রামের বিধবা রুপালী ও তার পরিবারের একমাত্র নলকূপটি বন্যায় তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এ্কই ইউনিয়নের নীলকণ্ঠ গ্রামের পাঁচ শতাধিক পরিবার খোলা বাঁধে আশ্রয় নিলেও পয়ঃনিষ্কাষণ সুবিধা নেই সেখানে। তারা শৌচাকাজ করতে পানি সাঁতরে বাড়ি যেতে হচ্ছে।

চর ভেলাকোপার অটোরিকশা চালক মেহেদী নয় মাসের গর্ভবতী স্ত্রী মুক্তাকে নিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। হাঁপানিতে আক্রান্ত বৃদ্ধ গহুর আলীকে অনেক কষ্টে উজানে ছোট বোন শেফালীর বাড়িতে নিয়ে গেছে বড় বোন বিজলী।

একই এলাকার উমর ফারুক (৪২) বলেন, “মাটি কাটা, বালু তোলার কাজ করি। বন্যার ফলে কাজ নাই। যা আছে তাই দিয়ে চলছে সংসার। কামাই না হওয়ায় কিছু কেনাকাটাও করা যাচ্ছে না। ভালোমন্দ খাওয়ার জন্য বাচ্চাগুলো কাঁদে।

কলাতিপাড়ার মনোয়ারা (৪০) বলেন, “হামরাগুলা ত্রাণ পাই নাই। মুই বিধবা বেটিছওয়া। বেটাক নিয়া থাকং। দুপুর হয়া গেইল। এলাও চুলাত আগুন জ্বলে নাই। হামাকগুলাক কাঁইয়ো দেখে না।”

এমন নানা অভাব-অভিযোগের কথা শোনা গেল বন্যার্তদের মাঝে। জনপ্রতিনিধিদের সীমাবদ্ধতা থাকায় সবার কাছে পৌঁছতে পারছেন না বলে জানান।

হাতিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বি এম আবুল হোসেন বলেন, ইউনিয়নে ২৫ গ্রামের সাড়ে তিন হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। জিআর চাল এবং জিআর ক্যাশ থেকে শুকনো খাবার কিনে আড়াইশ পরিবারকে বুধবার সহায়তা দেওয়া হয়। ফলে বাকি তিন হাজার ২৫০ পরিবার রয়েছে ত্রাণ সেবার বাইরে।

“ফলে ঘরে ঘরে খাদ্য সংকট চলছে। দুর্গত মানুষরা দিনে-রাতে ইউনিয়ন পরিষদ ও বাড়িতে এসে ত্রাণের জন্য চাপ প্রয়োগ করছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা গুজিমারী, দাগারকুটি, গাবুরজান, নয়াডারা, বাবুরচর, নীলকণ্ঠ, কলাতিপাড়া আর শ্যামপুর এলাকার।”

কুড়িগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা দিলীপ কুমার সাহা বলেন, চলতি বন্যায় তিনটি পৌরসভাসহ ৫৫টি ইউনিয়নের ৩৫৭টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ৬২ হাজার চরাশ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যায় ভাঙনে বিলীন হয়েছে দুই হাজার পরিবার। বন্যার ফলে ছয় হাজার ৮৮০ হেক্টর আবাদি জমির ফসল নিমজ্জিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৬ হাজার ১০০টি। এছাড়াও প্রায় ৩০ কিলোমিটার বাঁধ ও ৩৭ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এদিকে, ধরলা নদীর ভাঙনে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নে সারডোব গ্রামে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৪০০ মিটার অংশ ভেঙে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বাঁধের বড় অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ফলে নদী তীরের ২০টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে।

হলোখানা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান উমর ফারুক জানান, ২০১৭ সালের ১২ আগষ্ট ধরলা নদীর তীরবতী সারোডোব এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ  এবং বাঁধের উপর পাকা সড়কের কয়েকটি স্থানে ভেঙে বিরাট এলাকা প্লাবিত হয়েছিল।

“এরপর দুবছরেও বাঁধ মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। গত বছর এলাকাবাসী মানববন্ধন ও সমাবেশসহ অনেক দেনদরবার করলেও বাঁধ ও সড়ক মেরামত না হওয়ায় হতাশা দেখা দেয়।”

পরে ভেঙে যাওয়া সারোডোব বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটির ৪০০ মিটার অংশ এলাকাবাসীর স্বেচ্ছাশ্রম ও অর্থে মেরামত করা হয় বলে তিনি জানান।

তিনি জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ড এরপর জিও টেক্সটাইল বিছিয়ে সাময়িক মেরামতের কাজ করে দেয়। কিন্তু চলতি বছর বর্ষা শুরুর পর থেকে বাঁধের মেরামত করা অংশে আবার ভাঙন দেখা দিয়েছে। এই ৪০০ মিটার বাঁধের অনেক জায়গায় অংশ ভেঙে বিলীন হওয়ার পথে। চলতি বর্ষায় বাঁধটি টিকবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কায় আছে এলাকাবাসী। বাঁধটি ভাঙলে পার্শ্ববর্তী ২০টি গ্রাম প্লাবিত হবে।

সারডোব গ্রামের বাসিন্দা প্রাক্তন ইউপি সদস্য আশরাফ হোসেন বলেন, বাঁধের ভাঙা অংশ ঘেঁষে ধরলা প্রবাহিত হওয়ায় ভঙন শুরু হয়েছে। ফলে ২০টি গ্রামের কয়েক হাজার পরিবার বন্যা ও ভাঙনের কবলে পড়ার আশঙ্কা করছে।

এলাকার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান বলেন, বাঁধের অর্ধেক অংশ ভেঙে গেছে। বাকিটা ভাঙলে এই এলাকার বাড়িঘর সব ভেঙে যাবে। আগের মতো বালু পড়ে ঢেকে যাবে উর্বর আবাদী জমি। 

স্থানীয় ইউপি সদস্য বাকিনুর ইসলাম বলেন, বাঁধ রক্ষার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগ করলেও তারা বরাদ্দ নেই বলে সাড়া দেয়নি। অবশেষে নির্বাহী প্রকৌশলী পরিদর্শন করার পর বাঁধ রক্ষার আশ্বাস পাওয়া গেছে।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম বলেন, “বাঁধটি রক্ষার জন্য আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। ভাঙা অংশটি মেরামত করব। যাতে বাঁধ রক্ষা পায় এবং মানুষের চলাচল স্বাভাবিক হয়। পাশাপাশি ইতোমধ্যে এখানে ৮০০ মিটার তীর সংরক্ষণ কাজের অনুমোদন পাওয়া গেছে। বর্ষার পরে সেই কাজ শুরু হবে।”