টিপু রাজাকারের ফাঁসি দ্রুত কার্যকর চায় শহীদ পরিবার

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাজশাহীর জামায়াত নেতা আবদুস সাত্তার ওরফে টিপু সুলতান ওরফে টিপু রাজাকারের ফাঁসির রায় দ্রুত কার্যকরের প্রত্যাশা করছেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা।

বদরুল হাসান লিটন রাজশাহী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Dec 2019, 06:15 PM
Updated : 11 Dec 2019, 06:16 PM

বুধবার বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল টিপু রাজাকারের মৃত্যুদণ্ড দেয়।

মামলার রায় ঘোষণার আগে তালাইমারি শহীদ মিনারে অবস্থান নেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন তারা।

রায় ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়ায় শহীদ বাবর আলীর ছেলে শাহ জামান বলেন, “এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। রায় ঘোষণার পর আমরা এতই আনন্দিত যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আমরা যে বিচার চেয়েছিলাম ট্রাইব্যুনালের কাছে সে বিচার সম্পন্ন হয়েছে এবং আসামির ফাঁসি হয়েছে।”

তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, “একাত্তরে আমি নবম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। আমার বাবা ছিলেন প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার এবং আওয়ামী লীগের নেতা। ওই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর শহরের সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট থেকে টিপু রাজাকারের নেতৃত্বে আমার বাবাকে ধরে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলে নিয়ে যায়। সেখানে কয়েকদিন রেখে নির্যাতনের পর হলের পিছনে গুলি করে হত্যা করে লাশ পুঁতে ফেলে।

“পরে তালাইমারিতে আমাদের বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে আগুন দেয় টিপু রাজাকার ও তার সহযোগীরা।”

রায় শুনে প্রতিক্রয়া জানাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন শহীদ শফিউদ্দীনের একমাত্র সন্তান জয়নুব বেগম।

তিনি বলেন, তার বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। বাবা শহীদ হওয়ার পর তাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।

টিপু রাজাকারের রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানান তিনি।

একই দাবি জানান শহীদ আফিল উদ্দিনের মেয়ে বিলকিস বানু। আফিল উদ্দিনও ব্যবসায়ী ছিলেন। তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা ও বাড়িতে লটুপাট চালায় টিপু রাজাকার ও তার সহযোগীরা।

মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানা এলাকায় হত্যা, নির্যাতন, আটক, অপহরণ ও লুণ্ঠনের অভিযোগে টিপু রাজাকারসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে উল্লিখিত অভিযোগের প্রমাণ পায় প্রসিকিউশন টিম। তবে ছয়জনের মধ্যে মনো, মজিবর রহমান, আব্দুর রশিদ সরকার, মুসা ও আবুল হোসেন আগেই মারা গেছেন। বেঁচে আছেন একমাত্র আসামি টিপু সুলতান।

রাজশাহীর বোয়ালিয়ায় ১০ জনকে হত্যা, দুজনকে দীর্ঘদিন আটকে রেখে নির্যাতন, ১২ থেকে ১৩টি বাড়ির মালপত্র লুট করে আগুন দেওয়ার অভিযোগ তদন্ত করে পাওয়া গেছে।

গত বছর ২৯ মে প্রসিকিউশনের দেওয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়ে ৮ অগাস্ট অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে টিপুর বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

নাটোরের লালপুর উপজেলার গোপালপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে অবসরে যাওয়া টিপু সুলতানকে একত্তরের ভূমিকার জন্য রাজশাহীর অনেকে চেনে ‘টিপু রাজাকার’ নামে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে স্থানীয় যে রাজাকাররা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা চালিয়েছিল, তাদের মধ্যে টিপু সুলতানই বেঁচে আছেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় টিপু ছিলেন জামায়াতে ইসলামী ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের স্থানীয় কর্মী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই ছাত্রসংঘ নাম বদলে হয় ইসলামী ছাত্রশিবির।

টিপু শিবিরের রাজনীতিতেও যুক্ত ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলার অভিযোগপত্রে।

সেখানে বলা হয়, ১৯৮৪ সালের পর টিপুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পৃক্ততার আর তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয়ভাবে তিনি জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক হিসেবে পরিচিত।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে লেখাপড়া করা টিপু সুলতান ১৯৮৪ সালে নাটোরের গোপালপুর ডিগ্রি কলেজে যোগ দেন সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। ২০১১ সালে সেখান থেকেই তিনি অবসরে যান। ১৯৭৪ সালের ১০ অগাস্ট টিপু সুলতানকে গ্রেপ্তার করা হলেও পরে তিনি ছাড়া পেয়ে যান।

পরে ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি বিস্ফোরক আইনের এক মামলায় মতিহার থানার পুলিশ তাকে ফের গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

টিপুর বিরুদ্ধে অভিযোগসমূহ

১. একাত্তরের ২৬ সেপ্টেম্বর দুপুর দেড়টা থেকে পরদিন মধ্যরাত পর্যন্ত আসামি মো. আব্দুস সাত্তার ওরফে টিপু সুলতান ওরফে টিপু রাজাকার স্থানীয় অন্যান্য রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা বোয়ালিয়া থানার সাহেব বাজারের এক নম্বর গদিতে (বর্তমানে জিরো পয়েন্ট) হামলা চালিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা বাবর মণ্ডলকে আটক করে। তাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুজ্জোহা হলে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে দিনভর নির্যাতন করার পর গুলি করে হত্যা করে লাশ মাটিচাপা দেয়া হয়।

২. একাত্তরের ২ নভেম্বর রাত আনুমানিক ২টায় আসামি টিপু সুলতান, স্থানীয় রাজাকার এবং ৪০ থেকে ৫০ জন পাকিস্তানি সেনা বোয়ালিয়া থানার তালাইমারী এলাকায় হামলা চালায়। সেখান থেকে আওয়ামী লীগ নেতা চাঁদ মিয়া, আজহার আলী শেখসহ ১১ জনকে আটক করে নির্যাতন চালানো হয়। তালাইমারী এলাকার ১২ থেকে ১৩টি বাড়িতে লুটপাটও চালানো হয়।

পরে আটক ১১ জনকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলে বসানো অস্থায়ী ক্যাম্প ও টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ৪ নভেম্বর মাঝরাতে নয় জনকে গুলি করে হত্যার পর লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়। সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যাওয়া বাকি দুই জনের মধ্যে একজন এখনও জীবিত আছেন। তিনিও এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন।