রাজশাহীর টিপু রাজাকারের ফাঁসির রায়

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় রাজশাহীতে অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যার মত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বোয়ালিয়ার সাবেক শিবির নেতা মো. আব্দুস সাত্তার ওরফে টিপু সুলতানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে যুদ্ধাপরাধ আদালত।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Dec 2019, 05:59 AM
Updated : 11 Dec 2019, 08:47 AM

বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বুধবার আসামির উপস্থিতিতে এ মামলার রায় ঘোষণা করে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে স্থানীয় যে রাজাকাররা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল, তাদের মধ্যে টিপু সুলতানই  কেবল বেঁচে আছেন। একাত্তরের সেই ভূমিকার জন্য এলাকার অনেকে তাকে চেনে টিপু রাজাকার নামে।

১৭৭ পৃষ্ঠার রায়ে আদালত বলেছে, আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা দুটি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিটি অভিযোগেই সর্বসম্মতিক্রমে আসামিকে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে একত্রিত হয়ে ইসলামী ছাত্রসংঘ যে আলবদর ও রাজাকার বাহিনী গড়ে তুলেছিল, সে বাহিনী ছিল হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর মত। আজকের রায়ের মধ্য দিয়ে সে কথাগুলোই উঠে এসেছে।”

তিনি বলেন, “আসামির বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ ছিল। তা প্রমাণে মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ১৪ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাথে দালিলিক প্রমাণাদি দিয়ে দুটি অভিযোগই আমরা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। ফলে তাদের অপরাধ বিবেচেনা করে আদালত মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে; এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।”

অন্যদিকে আসামির পক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম বলেন, “এই রায়ে আমার মক্কেল সংক্ষুব্ধ। তিনি এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন। আশা করি আপিলে তিনি খালাস পাবেন।”

আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন অনুযায়ী, যুদ্ধাপরাধ মামলায় দণ্ডিত আসামি রায়ের এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পান।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় আসা ৪১টি মামলার ১০৩ জন আসামির মধ্যে ছয়জন বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। মোট ৯৫ জনের সাজা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৬৮ যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে।

রায় ঘোষণার আগে এজলাশে বসেই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান শাহিনুর ইসলাম এদিন বঙ্গবন্ধু, শহীদ বুদ্ধিজীবীসহ মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

তিনি বলেন, “বিজয়ের মাস চলছে। আর পাঁচ দিন পরেই জাতি মহান বিজয় দিবস, তিন দিন পর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করতে যাচ্ছে। রায় প্রদানের প্রাক্কালে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা জানাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি। মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রম হারানো দুই লাখ মা-বোন ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি।

“পাশাপাশি তাদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। আশা করছি তাদের মহান আত্মত্যাগের মহিমাকে সামনে রেখে দেশ-জাতি এগিয়ে যাবে।”

মামলা বৃত্তান্ত

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ২০১৭ সালের ২ মে টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরু করে। তদন্ত শেষে গতবছর ২৭ মার্চ ছাত্রশিবিরের এই সাবেক নেতার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেয় প্রসিকিউশনের তদন্ত দল।

গত বছর ২৯ মে প্রসিকিউশনের দেওয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়ে ৮ অগাস্ট অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে টিপু সুলতানের বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ১৪ জন এ মামলার শুনানিতে প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষ্য দেন। এছাড়া রাজশাহী জেলার রাজাকার তালিকা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক অধিশাখা এবং ১৯৭১ সালে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনও জব্দ তালিকার সাক্ষী হিসেবে তুলে ধরা হয়।

প্রসিকিউশন ও আসমি পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে গত ১৭ অক্টোবর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রেখেছিল ট্রাইব্যুনাল।

কে এই টিপু সুলতান

নাটোরের লালপুর উপজেলার গোপালপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে অবসরে যাওয়া টিপু সুলতানকে (৬৮) একত্তরের ভূমিকার জন্য রাজশাহীর অনেকে চেনে ‘টিপু রাজাকার’ নামে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় টিপু ছিলেন জামায়াতে ইসলামী ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের স্থানীয় কর্মী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই ছাত্রসংঘ নাম বদলে হয় ইসলামী ছাত্রশিবির। টিপু শিবিরের রাজনীতিতেও যুক্ত ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলার অভিযোগপত্রে।

সেখানে বলা হয়, ১৯৮৪ সালের পর টিপুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার আর তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয়ভাবে তিনি জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক হিসেবে পরিচিত।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে লেখাপড়া করা টিপু সুলতান ১৯৮৪ সালে নাটোরের গোপালপুর ডিগ্রি কলেজে যোগ দেন সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। ২০১১ সালে সেখান থেকেই তিনি অবসরে যান।

১৯৭৪ সালের ১০ অগাস্ট টিপু সুলতানকে গ্রেপ্তার করা হলেও পরে তিনি ছাড়া পেয়ে যান। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি বিস্ফোরক আইনের এক মামলায় মতিহার থানার পুলিশ তাকে ফের গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

যেসব অভিযোগে প্রাণদণ্ড

অভিযোগ-১: একাত্তরের ২৬ সেপ্টেম্বর দুপুর দেড়টা থেকে পরদিন মধ্যরাত পর্যন্ত আসামি মো. আব্দুস সাত্তার ওরফে টিপু সুলতান ওরফে টিপু রাজাকার স্থানীয় অন্যান্য রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা বোয়ালিয়া থানার সাহেব বাজারের এক নম্বর গদিতে (বর্তমানে জিরো পয়েন্ট) হামলা চালিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা বাবর মণ্ডলকে আটক করে।

তাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুজ্জোহা হলে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে দিনভর নির্যাতন করার পর গুলি করে হত্যা করে লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়।

অভিযোগ-২: একাত্তরের ২ নভেম্বর রাত আনুমানিক ২টায় আসামি টিপু সুলতান, স্থানীয় রাজাকার এবং ৪০ থেকে ৫০ জন পাকিস্তানি সেনা বোয়ালিয়া থানার তালাইমারী এলাকায় হামলা চালায়।

সেখান থেকে আওয়ামী লীগ নেতা চাঁদ মিয়া, আজহার আলী শেখসহ ১১ জনকে আটক করে নির্যাতন চালানো হয়। তালাইমারী এলাকার ১২ থেকে ১৩টি বাড়ি লুটপাটও চালানো হয়।

পরে আটক ১১ জনকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলে বসানো অস্থায়ী ক্যাম্প ও টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ৪ নভেম্বর মাঝরাতে নয় জনকে গুলি করে হত্যার পর লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়। 

সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যাওয়া বাকি দুই জনের মধ্যে একজন এখনও জীবিত আছেন। তিনিও এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন বলে তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন জানান।