মারধরের পর এবার বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীদের হুমকি 

গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোন্দকার নাসির উদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলার পর এবার আন্দোলন থেকে সরে যেতে ভয়-ভীতি দেখানোর অভিযোগ উঠেছে।  

গোপালগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Sept 2019, 12:12 PM
Updated : 22 Sept 2019, 03:46 PM

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, উপাচার্য সমর্থিত শিক্ষকরা তাদের ব্যক্তিগতভাবে ডেকে নিয়ে আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা বলছেন। তা না হলে তাদের সার্টিফিকেট আটকে রাখা এবং ক্লাস ও পরীক্ষার সময় ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দিচ্ছেন।

বহিরাগতদের হামলার পর উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অজানা আতঙ্ক আর হুমকির মুখে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ও কামনা করেছেন তারা।

গত ১১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস সাংবাদিক ফাতেমা-তুজ-জিনিয়াকে বহিষ্কার করা হলে এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাংবাদিকদের সমালোচনার মুখে তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তুলে তার পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়।

গত বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে শিক্ষার্থীরা ভিসির পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমরণ অনশনের ঘোষণা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে অনশন শুরু করেন।

আন্দোলন থামাতে কর্তৃপক্ষ শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়।

পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার নূরউদ্দিন আহমেদ বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

এরপর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অভিযোগ আসতে থাকে, শুক্রবার রাত থেকে হলের খাবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শনিবার সকাল থেকে হলে বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। শনিবার দুপুরে গোপালগঞ্জ শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার পথে বহিরাগতরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়ে মারধর করেছে।

এতে ২০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছে বলে তারা দাবি করেছেন।

এতে বিভিন্ন গণমাধ্যমের বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ ক্যাম্পাস প্রতিনিধিসহ ২০ শিক্ষার্থী আহত হয়। তারপরও সাধারণ শিক্ষার্থীরা পিছু না হটে চতুর্থ দিনের মতো ভিসির পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে তারা ভিসি বিরোধী শ্লোগান দিচ্ছেন তারা।

এদিকে গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান চৌধূরী এমদাদুল হক, সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব আলী খান বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার নিন্দা এবং আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন।

পরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তারা বলেন, হাই কমান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাদের নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বিদেশ থেকে আসার পর এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। ওই সময় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন তারা।

এ সময় এক নেতা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রত্যাহারের অনুরোধ জানালে শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

এ সময়  টুঙ্গিপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান সোলায়মান বিশ্বাস, গোপালগঞ্জ পৌরসভার মেয়র কাজী লিয়াকত আলী লেকু, জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এম. বদরুল আলম বদর, আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল ইসলাম মিটু, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুল হামিদসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সম্রাট বিশ্বাস বলেন, “২০১৬ সালে আমিসহ চারজনকে প্রথম তিন বছরের জন্য স্থায়ীভাবে বহিস্কার করা হয়। এ নিয়ে ভিসি আমার বাবার সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও তাকে অপমান করেন। পরে আমরা হাই কোর্টে রিট করে ছাত্রত্ব ফিরে পাই।”

তিনি আরও বলেন, “সিএসই’র শিক্ষার্থী অর্ঘ বিশ্বাস অসুস্থ থাকায় ক্লাসে ৫৮ ভাগ উপস্থিত ছিল। তাই তাকে পরীক্ষা দিতে বাধা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অর্ঘর অভিভাবকরা তাকে পরীক্ষায় বসানোর অনুরোধ করতে ভিসির কাছে যান। কিন্তু ভিসি তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে তাদের অপমান করেন। এটি সহ্য করতে না পেরে অর্ঘ আত্মহত্যা করে।”

ভিসি নাসির উদ্দিনকে স্বৈরাচারী উল্লেখ করে সম্রাট বলেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে দুর্নীতি, অনিয়ম, অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন ও লুটপাটের কারখানায় পরিণত করেছেন। তিনি কথায় কথায় শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করেন। এছাড়া নিয়ম লঙ্ঘন করে নিজের পছন্দের শিক্ষকদের বিভাগীয় চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে আসছেন।

এছাড়া ভিসি বিরোধী প্রায় শিক্ষকদেরই শোকজ করে মানসিক নির্যাতন করা হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির ছত্রছায়ায় শিক্ষার্থীদের ওপর এর আগেও হামলার ঘটনা ঘটেছে বলেও সম্রাটের অভিযোগ।  

তিনি বলেন, “এবার হামলার পর শিক্ষার্থীরা ফুঁসে উঠেছে। আগে তারা ভয়ে কথা বলত না। এখন মুখ খুলতে শুরু করেছে। ভিসির পতন না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবে বলেও ঘোষণা দিয়েছে। সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্ত করলে আমাদের কাছে যে তথ্য-উপাত্ত আছে তাতেই ভিসি ফেঁসে যাবেন।”

গোবরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান চৌধূরী টুটুল বলেন, “আমার ইউনিয়নে এ বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থান। আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিভাবক “

শিক্ষার্থীদের ওপর বহিরাহতদের হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, এ ঘটনায় তার ইউনিয়নের কেউ জড়িত নেই। ফের বহিরাগতরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার চেষ্টা করা হলে ইউনিয়নবাসীদের সঙ্গে নিয়ে তা প্রতিহত করা হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শামস্ আরা খান বলেন, “শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে। তাদের ওপর বহিরাগতরা যাতে হামলা করতে না পরে সে বিষয়টি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। তবে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগতভাবে ডেকে নিয়ে আন্দোলন থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই।” 

আন্দোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য খোন্দকার নাসির উদ্দিন বলেন, “শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগতভাবে ডেকে নিয়ে শিক্ষকরা আন্দোলন থেকে সরে যেতে হুমকি দিচ্ছেন না। এমনটি হওয়ার সুযোগ নেই।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, এমপি, শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন, জেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগকে জানানো হয়েছে। এছাড়া এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।