“আমার জেলে কার্ড নেই। সরকারি কোনো সাহায্যও পাইনি। পরিস্থিতির শিকার হয়ে মাছ ধরতে হয়। মাছ না ধরলে কিস্তি দিতে পারি না”, বলেন এক জেলে।
Published : 01 Nov 2024, 09:55 PM
প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞার পরও পদ্মা ও মেঘনা নদীতে থামছেই না মৎস্য শিকার। প্রতিদিন অভিযান চালাচ্ছে প্রশাসন। জেলেদের আটকের পাশাপাশি করা হচ্ছে জেলা-জরিমানাও। তারপরও সুযোগ পেলেই জাল ও নৌকা নিয়ে নদীতে ছুটছেন জেলেরা।
তবে জেলেদের দাবি, পেটের দায়েই মাছ শিকারে যান তারা। মাছ শিকারে জেলেদের সঙ্গে মৎস্য কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে, এমন অভিযোগও উঠেছে।
তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়েছে শরীয়তপুর মৎস্য বিভাগ। তাদের দাবি, অন্য বছরের তুলনায় এ বছর অভিযান সফল হয়েছে।
মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, মা ইলিশ রক্ষায় এ বছর ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত নদীতে সব ধরনের মাছ শিকারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার।
নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নদীতে নামলে আটক ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ দুই বছরের জেল, পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।
শরীয়তপুর জেলার চারপাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা ও মেঘনা নদী। এ ছাড়া জেলার ভেতরে দিয়ে বয়ে গেছে কীর্তিনাশা, জয়ন্তিকাসহ পদ্মার অসংখ্য শাখা নদী। নদী বেষ্টিত জেলা হওয়ায় নদীপাড়ে বসবাসরত অধিকাংশ মানুষেরই পেশা মাছ শিকার।
মাছ শিকারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য আড়ত ও মৎস্য ব্যবসায়ী। জেলার প্রায় ৮৭ কিলোমিটার নদীর মধ্যে চাঁদপুরের সাটনল থেকে শরীয়তপুরের কাঁচিকাটা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার এলাকাকে ইলিশের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে।
প্রতি বছরের মতো এবারো নিষেধাজ্ঞার সময় জেলেদের খাদ্য সহায়তা হিসেবে ২৫ কেজি করে চাল দেওয়া হয়।
তবে জেলেদের দাবি, ২৫ কেজি চাল দিয়ে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে চলা কষ্টকর হয়ে যায়। এক রকম বেঁচে থাকার তাগিদে নিষিদ্ধ উপেক্ষা করে নদীতে মাছ শিকারে যান তারা।
তবে অনেকেই বলছেন, জেলে হলেও কার্ড না থাকায় সরকারের দেওয়া খাদ্য সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেকে।
তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, নদীতে নামা জেলেদের ইলিশ শিকারের সঙ্গে মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে।
জেলা মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, নিষেধাজ্ঞার প্রথম দিন থেকে শুক্রবার পর্যন্ত নদীতে ২৯৫টি অভিযান চালিয়ে ২৫১ জেলেকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৫ বার ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জরিমানা করা হয়েছে এক লাখ পাঁচ হাজার ৪০ টাকা। এ ছাড়া মামলা দেওয়া হয়েছে ৩১৮টি।
মাছ শিকারে জেলেদের সঙ্গে মৎস্য কর্মকর্তাদের যোগসাজশের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন শরীয়তপুরের মৎস্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. হাদিউজ্জামান।
নড়িয়া উপজেলার ঈশ্বরকাঠি গ্রামের বাসিন্দা মীর কাশেম বলেন, “সম্প্রতি নদীতে মাছ ধরার সময় মৎস্য কর্মকর্তার গাড়ি চালকসহ অন্যরা একটি ট্রলার আটক করেন। পরে মৎস্য অফিসার ফোন করে সেই ট্রলার ছেড়ে দিতে বলেন।
“জেলেরা মৎস্য অফিসারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে নদীতে মাছ ধরছে। মৎস্য অফিসাররা যদি ঘুষ খায়, তবে কে কী বলব বলেন?”
জেলে ছায়েদুল রহমান বলেন, “মাছ না ধরলে তো আমরা ভাত খেতে পারব না। আমাদেরকে তো কেউ খাবার দেবে না। নদীতে জাল না পেতে কী করব?”
আরেক জেলে আব্দুল হক বলেন, “আমার জেলে কার্ড নেই। সরকারি কোনো সাহায্যও পাইনি। পরিস্থিতির শিকার হয়ে আমাদের মাছ ধরতে হয়। মাছ না ধরলে কিস্তি দিতে পারি না।”
জেলে ওহিদুজ্জামান বলেন, “আমার পরিবারে সদস্য সংখ্যা সাত। সরকারি কোনো সহযোগিতা পাইনি। আমার পেশাই মাছ ধরা। ১২ মাস মাছ ধরে চলি। ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার এই সময় সরকার যদি সব জেলেকে ভালোভাবে সাহায্য করত, তাহলে মাছ না ধরেও পারতাম।
“বাড়িতে বৃদ্ধ মা-বাবা, কিস্তি, সংসার খরচসহ ইত্যাদি কারণে বাধ্য হয়েই ইলিশ শিকার করতে হয়।”
মৎস্য কর্মকর্তা হাদিউজ্জামান বলেন, ১৩ অক্টোবর শুরু হওয়া অভিযান ৩ নভেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। দিন-রাত নদীতে অভিযান জোরদার করা হয়েছে।
অভিযান সফল করতে জেলা প্রশাসন, পুলিশ, নৌ-পুলিশ, কোস্ট গার্ডসহ সবাই সহযোগিতা করছে। এ বছরের অভিযান অন্যান্য যে কোনো বছরের তুলনায় সফল হয়েছে।
তিনি বলেন, “মৎস্য কর্মকর্তা ঘুষ লেনদেন করেন, এমন কোনো বিষয়ে আমাদের জানা নেই। যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাই, তবে তদন্ত করে দেখা হবে।
“নদীতে কোনো জেলে নৌকা নেই। তবে একেবারেই প্রত্যন্ত জায়গায় থাকতে পারে। সেটাও অভিযানের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করে যাচ্ছি।”