ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসেন চৌধুরী ওরফে মাসুদ চৌধুরী তিনবার সাভার ইসলামিয়া কামিল মাদরাসার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
Published : 27 Oct 2024, 01:36 PM
শিক্ষক নিয়োগ, এমপিওভুক্তি, বিএড স্কেল যোগ, ঋণের সুপারিশ এমনকি এনটিআরসিএর সুপারিশে চাকরিতে যোগদান করতে গেলেও সাভার ইসলামিয়া কামিল মাদরাসার সভাপতিকে টাকা না দিয়ে কোনো উপায় ছিল না বলে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসেন চৌধুরী ওরফে মাসুদ চৌধুরী পরপর তিনবার মাদরাসার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে হয়ে উঠেছিলেন প্রতিষ্ঠানটির ‘সর্বেসর্বা’। অনিয়ম আর দুর্নীতির কাজে তাকে সহায়তা করতেন সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তাইজুল ইসলাম ও সহকারী শিক্ষক নাসির উদ্দিন আহম্মেদ।
৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর সভাপতি ও ওই দুই শিক্ষক আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পর তহবিল তছরুপের মত অভিযোগ সামনে আসায় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, আশরাফ ছিলেন খুবই ‘প্রভাবশালী’, প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। ফলে তখন কেউ ভয়ে মুখ খোলার সাহস পাননি। ক্ষমতায় পালাবদলের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা ইউএনওসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে এ বিষয়ে অভিযোগ দিয়েছেন।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তাইজুল ইসলাম গা ঢাকা দেওয়ার পর মাদরাসার অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক আবু জাফর মো. সালেহ। তবে মাদরাসার পরিচালনা পর্যদ এখনো পুনর্গঠিত হয়নি।
অধ্যক্ষ বলছিলেন, “মাসুদ চৌধুরীর নির্দেশে শিক্ষক নিয়োগ নাসির উদ্দিনের মাধ্যমে হত। তাইজুল ইসলামের কাছে থাকত আর্থিক হিসাব। মাদরাসার সাড়ে ১২ লাখ টাকার হিসাবের কোনো হদিস নেই। হিসাব তারা বুঝিয়েও দেননি।”
মাদরাসায় না আসায় এরই মধ্যে তাইজুল ইসলাম ও নাসির উদ্দিনকে কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়ে তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু বকর সরকার বলেন, “আমার কাছে কয়েকজন অভিযোগ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তদন্ত করে পরবর্তীতে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সাভারের ইউএনওর কাছে ভুক্তভোগী যে কয়জন অভিযোগ দিয়েছেন তার মধ্যে রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটি সাবেক গণিত শিক্ষক মো. আসাদুল ইসলামের পরিবার। তিনি ২০১৮ সালের ১০ মার্চ মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা যান।
আসাদুলের স্ত্রী খাদিজা আক্তার অভিযোগ করে বলেন, আসাদুল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর গণিত শিক্ষক হিসেবে মাদরাসায় যোগদানের নিয়োগপত্র পান। তখন সহকারী শিক্ষক নাসির উদ্দিন আহম্মেদ রাজনৈতিক প্রভাব দেখিয়ে তাকে যোগদানে বাধা সৃষ্টি করেন। পরে আসাদুল সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে যোগদান করেন।
এর কিছুদিন পর আসাদুল বিএড স্কেল প্রাপ্তির জন্য আবেদন করেন। তখন নাসির আবার ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন এবং আসাদুল সেই টাকা দিতে বাধ্য হন।
খাদিজার অভিযোগ, টাকার দুঃশ্চিন্তা থেকেই আসাদুল মাদরাসায় অনুষ্ঠান চলাকালে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা যান। তখন মাদরাসা কর্তৃপক্ষ পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর কথা বললেও কেউ কোনোদিন খোঁজও নেয়নি।
সাভার ইসলামিয়া কামিল মাদরাসার সাবেক সহকারী মৌলভী আশরাফ লিখিত অভিযোগে বলেছেন, গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এনটিআরসিএর সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে মাদরাসায় যোগদান করতে এলে আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদ চৌধুরীর কথা বলে শিক্ষক নাসির উদ্দিন আহম্মেদ তাকে যোগদানে বাধা দেন।
পরে যোগদান ও এমপিও বাবদ তার কাছ থেকে ৯০ হাজার টাকা জোর করে নেওয়া হয়। এ ছাড়া নাসির উদ্দিন আহম্মেদ তার ৩০ মাসের বেতন না দিয়ে নিজেই আত্মসাৎ করেছেন বলেও অভিযোগ করেন আশরাফ।
মাদরাসার সাবেক সহকারী গ্রন্থাগারিক এ কে এম ইউসুফ ইউএনওর কাছে দেওয়া অভিযোগে বলেছেন, তিনি প্রায় আট বছর মাদরাসায় দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৫ সালের ১৭ অক্টোবর যখন তার নিয়োগ হয় তখন নাসির উদ্দিন তাকে যোগদানে বাধা দেন। পরে দেড় লাখ টাকা নিয়ে তাকে যোগদান করতে দেওয়া হয়।
অভিযোগে তিনি বলেছেন, ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর অগ্রণী ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের কাছে আবেদন করেন। তখন নাছির রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আবেদনটি সরিয়ে ফেলে। পরে ঋণের প্রক্রিয়াবাবদ তিনি ১০ হাজার টাকা নেন। ঋণের আবেদনে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের স্বাক্ষর ও সিল দিয়ে তা হস্তান্তর করেন। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, আবেদনের স্বাক্ষরটি জাল। তিনি আর ঋণ পাননি।
মোহাম্মদ আলমাস বিন আনোয়ার সাভার ইসলামিয়া কামিল মাদরাসার বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। তার যোগদানের সময়ও তার কাছ থেকে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এক লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। পরে এমপিওভুক্তির জন্য আরও দেড় লাখ টাকা দাবি করেন শিক্ষক নাছির উদ্দিন।
মোহাম্মদ আলমাস বিন আনোয়ার বলেন, “টাকা না দেওয়ার আমাকে হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন। এমনকি জঙ্গি আখ্যা দিয়ে হুমকি দেন। পরে জীবন রক্ষার্থে মাদরাসা থেকে পালিয়ে যাই।”
এখন তিনি তার হারানো চাকরি ফিরে পাওয়া এবং দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সাভারের ইউএনওর কাছে আবেদন করেছেন।
সাভার ইসলামিয়া কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ আবু জাফর মো. সালেহ বলেন, অভিযোগের বিষয় তদন্তে ২ অক্টোবর তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে আহ্বায়ক এবং উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এবং উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তাকে সদস্য করা হয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তাইজুল ইসলাম বলেন, “আমি কাঠের পুতুল ছিলাম। আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদ চৌধুরী আমাকে যেভাবে বলত সেইভাবেই সবকিছু করতাম। আমার নিজস্ব কোনো ক্ষমতা ছিল না।”
মাদরাসায় যান না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তারা এই পরিস্থিতিতে মাদরাসায় যেতে বারণ করেছেন, তাই সরে আছি।”
মাদরাসার সভাপতি আশরাফ হোসেন চৌধুরী ওরফে মাসুদ চৌধুরী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থী হত্যার একাধিক মামলায় আসামি হয়েছেন। তিনি পলাতক থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।