এক মৌয়াল বলেন, “সুন্দরবনের গহিন থেকে মধু সংগ্রহ করা বেশ কষ্টসাধ্য। তারপরও বাপ-দাদার পেশা লাভ-লোকসান মিলিয়ে আগলে আছি।”
Published : 01 Apr 2024, 07:55 PM
মধু আহরণ মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দলবেঁধে সুন্দরবনে ছুটছেন উপকূলীয় এলাকার মৌয়ালরা।
সোমবার ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় বাজারসদাই নিয়ে দলবেঁধে নৌকায় সুন্দরবনে মধু আহরণে যাচ্ছেন বনসংলগ্ন এলাকার এসব মৌয়াল।
দেশের প্রাকৃতিক মধুর সবচেয়ে বড় উৎস সুন্দরবনের গাছে গাছে এখন ফুল ফোটার মৌসুম। এরই মধ্যে খলিশা, গরান, হরকোচা, পশুরসহ বহু গাছে শোভা পাচ্ছে ফুল।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো জানান, ১ এপ্রিল থেকে মধু আহরণ মৌসুম শুরু হওয়ায় সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলের মৌয়ালরা সুন্দরবনে প্রবেশ করেছেন। বিভিন্ন ফরেস্ট স্টেশন থেকে অনুমতি নিয়ে বনে গেছেন তারা। মধু আহরণ মৌসুম চলবে আগামী ৩১ মে পর্যন্ত।
মিহির বলেন, বনসংলগ্ন একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বংশ-পরম্পরায় মধু সংগ্রহ করে। এদের মৌয়াল বলা হয়। আর মৌয়ালরা সুন্দরবনের মধু আহরণের ক্ষেত্রকে ‘মধুমহল’ বলে থাকেন। ১৮৮৬ সালে সুন্দরবন থেকে মধু আহরণের জন্য অনুমতি দেওয়ার এ প্রচলন শুরু হয়।
তিনি বলেন, এ বছর সুন্দরবন পশ্চিম ও পূর্ব বিভাগে মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার কুইন্টাল। আর মোম সংগ্রহের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৭৫০ কুইন্টাল।
বন সংরক্ষক আরও জানান, মৌয়ালদের জন্য মোট নয়টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- সংরক্ষিত অভয়ারণ্য থেকে মধু আহরণ করা যাবে না। কোনো অবস্থাতেই মৌচাকের সম্পূর্ণ অংশ সংগ্রহ করা যাবে না। মৌমাছি তাড়াতে অগ্নিকুণ্ডু, মশাল বা কোনো দাহ্যপদার্থ এবং রাসায়নিকদ্রব্য ব্যবহার করা যাবে না।
এছাড়া প্রতিটি নৌকায় ১০ থেকে ১২ জন মৌয়াল অবস্থান করতে পারবেন।
একজন মৌয়াল ১৪ দিনের জন্য সর্বোচ্চ ৫০ কেজি মধু ও ১৫ কেজি মোম আহরণ করতে পারবেন। টানা ১৪ দিনের বেশি কেউ সুন্দরবনে অবস্থান করতে পারবেন না। এসব নির্দেশনা অমান্য করলে মৌয়ালের বনে ঢোকার অনুমতি তাৎক্ষণিক বাতিল করা হবে।
পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন জানান, বৃষ্টির সঙ্গে মধুর একটা সম্পর্ক আছে। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হলে ফুল ঝরে যায় ও ফুলে মধুর পরিমাণও কমে আসে। এ বছর এরই মধ্যে কয়েকদফা বৃষ্টি হয়েছে। তাই এবার বেশ ভালো পরিমাণ মধু সুন্দরবন থেকে আহরিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মৌয়ালদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মৌসুমের শুরুতে সুন্দরবনে খলিশা ফুলের মধু আসে। এর পর আসে গরান এবং সবশেষে আসে কেওড়াসহ অন্যান্য ফুলের।
এই তিন প্রজাতির ফুলের মধুর মধ্যে সবচেয়ে দামি খলিশার মধু।
সুন্দরবনে গিয়ে এই মধু ভালো পাওয়া গেলে লাভ হয়। কম পাওয়া গেলে লোকসানের শঙ্কা থাকে মৌয়ালদের।
সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর এলাকার মৌয়াল আব্দুল গনি সরকার জানান, সোমবার ভোরে তিনি ছয় সদস্য নিয়ে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে রওনা দিয়েছেন। সুন্দরবনের বানিয়াখালি, তেঁতুল তলা, ফুলতলা, সরদার ঘাট, নুয়ানি, চার নম্বর কয়রা, সিংগাসহ নানা স্থান থেকে তারা মধু সংগ্রহ করবেন।
গনি বলেন, এক মৌসুমে মধু আহরণ করতে একেকজন মৌয়ালের খরচ হয় ১৫ থকে ২০ হাজার টাকা। স্থানীয় মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়েই অধিকাংশ মৌয়াল এসব খরচ মেটান। তবে বনের মধুমহলে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত মধু না পেলে লোকসান গুনতে হয়। তখন তাদের ঋণের বোঝা টেনে বেড়াতে হয়। গেল বছর মধুর সময় বৃষ্টি হয়নি, তাই মধুও বেশি পায়নি মৌয়ালরা।
একই উপজেলার মদিনাবাদ গ্রামের মৌয়াল আবুল কালাম গাজী জানান, সোমবার ভোরে নৌকায় প্রয়োজনীয় বাজারসদাই নিয়ে সুন্দরবনে মধু আহরণে রওনা দিয়েছেন তারা।
কালাম বলেন, “সুন্দরবনের গহিন থেকে মধু সংগ্রহ করা বেশ কষ্টসাধ্য। তারপরও বাপ-দাদার পেশা লাভ-লোকসান মিলিয়ে আগলে আছি।”
বন বিভাগের তথ্য মতে, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে ৫ লাখ ৮০ হাজার ২৪০ কেজি মধু ও মোম সংগ্রহ করা হয়। মধু ও মোম থেকে রাজস্ব আদায় হয় ৪৬ লাখ ৮৬ হাজার ৪১৩ টাকা। এর মধ্যে ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৩১৫ কেজি মধু থেকে ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ৩৬৩ টাকা এবং এক লাখ ৩৩ হাজার ৯০৫ কেজি মোম থেকে ১৩ লাখ ৩৯০ হাজার ৫০ টাকা রাজস্ব আয় হয়।
২০২২ সালে সুন্দরবনের মধু থেকে রাজস্ব আয় হয় ৩৬ লাখ ৯৩ হাজার ৬০০ টাকা এবং মোম থেকে ১৫ লাখ ৩১ হাজার ২০০ টাকা। সে বছর সুন্দরবন থেকে ২ হাজার ৩২০ কুইন্টাল মধু ও ৬৯৬ কুইন্টাল মোম পাওয়া যায়।
২০২৩ সালের ১ হাজার ২২৫ কুইন্টাল মধু ও ৩৬৭ দশমিক পাঁচ কুইন্টাল মোম আহরণ করা হয়। আর এ থেকে ২৭ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকা সরকারের রাজস্ব আসে।