নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবের উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা।
Published : 18 Jan 2025, 07:54 PM
দেশে কালচারাল প্রোগ্রাম আগের চেয়ে কমেনি বরং বেড়েছে বলে মনে করেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
শনিবার বিকালে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলায় বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।
এর আগে মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবের উদ্বোধন ঘোষণা করেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারাদেশে বেশ কিছু স্থানে মাজারে হামলা, লালন মেলা ও বাউল গানের আসর বন্ধের ঘটনা ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জেরও কয়েকটি স্থানে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
এসব ঘটনায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অবস্থান ও পদক্ষেপ নিয়ে জানতে চাইলে ফারুকী বলেন, “৫ অগাস্টের পর আমরা অন্য রকম একটা পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গেছি। প্রথম ১৫ থেকে ২০ দিন তো কোথাও ভিজিবল পুলিশ-ফোর্স দেখিনি।
“তখন মুসলমানরা হিন্দুদের মন্দির পাহারা দিয়েছি, নিজেরা নিজেদের মহল্লা পাহারা দিয়ে নিজেরাই নিজেদের পাশে দাঁড়িয়েছি। এই উদাহরণ দিলাম এইটা বোঝানোর জন্য যে, এইটাই বাংলাদেশ, এইটাই বাংলাদেশের স্পিরিট।”
ধর্মীয় পরিচয়কে বিবেচনায় না নিয়ে প্রত্যেকের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের পাশে দাঁড়াব, কার ধর্মীয় পরিচয় কী, সেইটার দিকে তাকাব না। আমি মনে করি, আমাদের সরকারেরও একই ফিলোসফি। আমরা সব ধর্ম, বর্ণ, যার যা পরিচয়; এই পরিচয়ের ভিত্তিতে কাউকে আলাদা করব না।”
তিনি বলেন, “গত তিন মাসে শিল্পকলা একাডেমির কর্মসূচি যদি আপনি দেখেন, সেখানে মাসে সারাদেশে ৪০ থেকে ৭০টি কালচারাল প্রোগ্রাম করছে। এগুলো করার পেছনে মূল কারণ, সারাদেশে সংস্কৃতির উৎসব ছড়িয়ে দেওয়া।
“সেটা আমরা ছড়াতে পারছি বলে বিশ্বাস করছি। তারুণ্যের উৎসব নামে একটা প্রজেক্ট হচ্ছে, সেখানেও অনেক কালচারাল প্রোগ্রাম হচ্ছে। ফলে কালচারাল প্রোগ্রামের সংখ্যা আগের চেয়ে কমেছে বলে আমি বিশ্বাস করি না, বরং বেড়েছে।”
তবে এর মধ্যেও যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোকে ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা হিসেবে দেখতে চান না আলোচিত এই চলচ্চিত্র পরিচালক।
ফারুকী বলেন, “বিচ্ছিন্ন দু-একটা ঘটনার কথা যে আপনি বলেছেন, সেইটা আমরা অস্বীকার করছি না। সেইসব ক্ষেত্রে আমাদের সরকারের তরফ থেকে প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম ও আরেকজন উপদেষ্টার বক্তৃতা শুনেছেন।
“বাংলাদেশ হচ্ছে বৈচিত্র্যের জায়গা। এই বৈচিত্র্য রক্ষার জন্য আমরা সব কাজ করব। এই বিষয়ে পুলিশ-প্রশাসন নির্দেশিত। আপনি নারায়ণগঞ্জের যে প্রসঙ্গের কথা বললেন সে বিষয়ে ডিসি ও এসপির সাথে ফলপ্রসূ আলাপ হয়েছে।”
প্রতিবছরের মত এবারও সোনারগাঁয়ে বড় আকারে মেলা ও লোকজ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে জানিয়ে ফারুকী এই মেলার প্রচারে বিশেষ নজর দিতে সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানান।
দেশের অন্য অঞ্চল থেকে মেলায় আসতে যাতায়াত ব্যবস্থা যাতে আরও উন্নত হয় সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন বলে জানান তিনি।
ঐতিহাসিক পানাম নগর সংরক্ষণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সংস্কৃতি উপদেষ্টা বলেন, “পানাম নগর নিয়ে এরি মধ্যে মন্ত্রণালয়ে কথা হয়েছে। কেননা আমরা মনে করি, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সাইট। এর প্রিজারভেশন (সংরক্ষণ) আমরা কীভাবে করব, রেনোভেশনের ফিলোসফি কেমন হবে, এসব ইস্যু আছে। আমরা চাই অরিজিনাল আদলটাকে ধ্বংস না করে সংরক্ষণ করতে।”
আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে উপদেষ্টা বলেন, “পাশের দেশে পালিয়ে থাকা ফ্যাসিস্ট মন্দিরে হামলার পরিকল্পনা করেছে। দেশের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার কারণে কোনো চক্রান্ত সফল হয়নি।
“আমাদের ধর্ম আমাদের সংস্কৃতির অংশ না, এটা বলে ধর্মকে সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা যদি সাংস্কৃতিক বিরোধ মেটাতে না পারি, তাহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিরোধ মিটবে না।”
‘এখনো চক্রান্ত চলছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমাদের দেশের আনাচে কানাচে বাউল শিল্পীরা আছেন। তাদের নিয়ে এক ধরনের প্রোপাগান্ডা চলছে। আপনারা সবাই মিলে এই প্রোপাগান্ডা রুখে দেয়ার মাধ্যমে প্রমাণ করতে পারেন বাংলাদেশের মানুষ কেমন এবং ইসলাম কতটা সহনশীল।”
লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক কাজী মাহবুবুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মফিদুর রহমান, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হেলালউদ্দিন, নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা, সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা রহমান ও জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক এ কে এম আজাদ সরকার।
এতে দেশের প্রখ্যাত দুজন কারুশিল্পীকে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন আজীবন সম্মাননা ও তিনজন কারুশিল্পীকে শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী পুরস্কার ২০২৪ প্রদান করা হয়।
এ বছর নকশিকাঁথা শিল্পের জন্য বেগম হোসনে আরা ও তামা-কাঁসা শিল্পের জন্য মানিক সরকার আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন। পুরস্কার হিসেবে তাদের প্রত্যেককে তিন লাখ টাকা ও দেড় ভরি ওজনের পদক দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী পুরষ্কার ২০২৪ পেয়েছেন- ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কারুশিল্পী মিলঞ্চি সিং, চিত্রিত হাতি ঘোড়া কারুশিল্পী ধীরেন্দ্র সূত্রধর ও টেপা পুতুল কারুশিল্পী সুনীল পাল৷ পুরস্কার হিসেবে তাদের প্রত্যেককে এক ভরি ওজনের পদক ও এক লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে।