“একদিন রাতে আমাকে বেধড়ক মারধর করেছে। বাথরুমে ঢুকিয়ে মাথায় মাঙ্কি টুপি পরিয়ে মুখে সবসময় পানি মেরেছে।”
Published : 02 Jan 2025, 08:32 PM
“আমাকে আল্লাহ বাঁচাইছে ভাই, এই জন্যই ফিরে এসেছি। নেওয়ার পর থেকে ওরা আমাকে হাত-পা বেঁধে বাথরুমে রেখেছে। সেখানে পানিতে ভিজিয়ে রেখেছে।”
এভাবেই অপহরণের সময়কালের বর্ণনা দিচ্ছিলেন পটুয়াখালী সদরের ১৪ নম্বর মৌকরণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী রাইসুল ইসলাম সেলিম।
মঙ্গলবার গভীর রাতে দুমকি উপজেলার লেবুখালী বাসস্যান্ড থেকে গ্রিন লাইন পরিবহনের একটি বাসে করে ঢাকা ফেরার পথে কেরাণীগঞ্জ এলাকায় সেলিমকে অপহরণ করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে।
পরে পুলিশ ও চেয়ারম্যান সেলিমের স্বজনরা জানান, বাসটির গতিরোধ করে ডিবি পুলিশ পরিচয় একদল লোক বাসে উঠে পড়ে। পরে তারা চেয়ারম্যান সেলিমকে অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়।
স্বজনরা ধারণা করেছিল, ইউপি চেয়ারম্যান সেলিমকে ঢাকার কেরাণীগঞ্জের কোনো স্থানে লুকিয়ে রেখেছে অপহরণকারীরা।
পরে বৃহস্পতিবার বেলা ২টার দিকে কেরাণীগঞ্জের দোলেশ্বরপাড়া এলাকা থেকে সেলিমকে উদ্ধার এবং পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের খবর জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার মো. মিজানুর রহমান। ৃ
কাজী রাইসুল ইসলাম সেলিম মৌকরণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বের পাশাপাশি ঢাকার রমনা থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বেও রয়েছেন।
উদ্ধারের পর ঘটনার বর্ণনায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সেলিম বলেন, “রাত তখন সাড়ে ৩টা। আমি কম্বল মুড়ি দিয়েছিলাম। হঠাৎ করেই আমার কম্বল উঠিয়ে ফেলে। তাকিয়ে দেখি বাসে ৭-৮ জনের একটি দল লোক দাঁড়িয়ে বলছে, ‘আপনারা ভয় পাবেন না। আমরা প্রশাসনের লোক, ওকে নিয়ে যাব।’ তখন আমি তাদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু করি এবং যাত্রীদের বলতে থাকি ওরা প্রশাসনের কেউ না, ওরা আমাকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। আপনারা আমাকে একটু সাহায্য করুন।
“কিন্তু কেউই ভয়ে প্রতিবাদ করেনি। তিন-চার জনে প্রতিবাদ করলেই আমাকে ওরা নিতে পারত না, কারণ অন্তত ১০ মিনিট আমি একাই ওদের সঙ্গে লড়াই করেছি।”
সেলিম বলেন, “এরপরে আমাকে নামিয়ে একটি প্রাইভেট কারে তুলে একটি চর এলাকায় নিয়ে যায়। সঙ্গে বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেলে অন্তত ৩০-৪০ জন ছিল। আমার গলায় একটি মোটা স্বর্ণের চেইন ছিল, তারা সেটা নিয়ে গেছে; যার মূল্য প্রায় ৫ লাখ টাকা। তাছাড়া মানিব্যাগসহ আমার সঙ্গে যা যা ছিল সব নিয়ে গেছে।”
“কিন্তু অন্ধকার থাকায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা চিনতে পারিনি। এরপর ভোর ৬টার দিকে কেরাণীগঞ্জের ধলেশ্বর এলাকায় একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে যাওয়ার পথে এক দোনাকদারকে দেখে বলি, ওরা আমাকে অপহরণ করে নিয়ে আসছে। কিন্তু ওই দোকানদার নিরব দাঁড়িয়ে ছিল। এরপর ওই বাড়িতে ঢুকিয়ে আমার হাত-পা বেঁধে বেধড়ক মারধর শুরু করে।”
ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, “একদিন রাতে আমাকে বেধড়ক মারধর করেছে। বাথরুমে ঢুকিয়ে মাথায় মাঙ্কি টুপি পরিয়ে মুখে সবসময় পানি মেরেছে যাতে আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কারণ, তাহলেই আমার পরিবার টাকা দিয়ে দেবে।
“এক পর্যায়ে কৌশলের আশ্রয় নেই। সন্ত্রাসীদের মধ্যে যেটা মূল তাকে বলি, ‘টাকা আনতে হলে আমার স্ত্রীকে ফোন দাও।’ এরপর সে আমার ও তার মোবাইল ফোন দিয়ে কল করে। পরে ওই ফোন কলের সূত্র ধরেই পুলিশ অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১২টার দিকে উদ্ধার করে। এ সময় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।”
বাস থামিয়ে ইউপি চেয়ারম্যানকে ‘অপহরণ’, মুক্তিপণ দাবি
সেলিমের ছোট ভাই কাজী শাহিন সমাপ্তি বলছে, গ্রেপ্তারদের মধ্যে একজন পটুয়াখালীর বাসিন্দা কার্তিকপাশা হাওলাদার বাড়ির রাজ্জাক হাওলাদারের ছেলে রিপন হাওলাদার। তিনি ওই এলাকায় রংমিস্ত্রির কাজ করেন। বাকি চারজন ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা।
শাহিন বলছিলেন, “ধলেশ্বর ইউনিয়নের ধলেশ্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের একটি পুরাতন ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি রুমে ভাইকে আটটে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে। তারপর অপহরণকারীরা মুক্তিপণ আদায়ের জন্য নানান কৌশলের আশ্রয় নেয়। পরে কেরাণীগঞ্জ থানার পুলিশসহ ডিবি-ডিএমপি ওই ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি বাথরুম থেকে তাকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করেছে।”
এর আগে পটুয়াখালী সদর থানার ওসি ইমতিয়াজ আহম্মেদ বলেন, “মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে সেলিম দুমকি উপজেলার লেবুখালী বাসস্যান্ড থেকে গ্রিন লাইন পরিবহনের একটি বাসে ঢাকা ফিরছিলেন।
“পথে গভীর রাতে ঢাকার কেরাণীগঞ্জ এলাকায় একটি মাইক্রোবাস বাসটির গতিরোধ করে একদল লোক ডিবি পুলিশ পরিচয় উঠে বাসে পড়ে। পরে সেলিমকে অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়।”
এ ঘটনায় জড়িতদের চিনতে পেরেছেন বলেও উদ্ধার হওয়া ইউপি চেয়ারম্যান সেলিমের দাবি। তিনি বলছিলেন, “আমি চিনতে পারলেও তদন্তের জন্য আপাতত নাম বলছি না। তবে এতটুকু বলতে চাই, আমার এলাকার লোকও এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত আছে।”
এদিকে সেলিমকে উদ্ধারের ঘটনায় প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তার স্ত্রী ফারহানা খানম। এর আগে সেলিমকে অপহরণ করে পরিবারের কাছে কোটি টাকার ‘চান্দা’ দাবি করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি।
সেলিমকে উদ্ধারের পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “প্রসাশনের পরিশ্রম, কৌশল এবং দক্ষতাকে আমি স্যালুট জানাই। তারা দিন-রাত অভিযান চালিয়ে আমার স্বামীকে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে উদ্ধার করেছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করা হোক, এই দাবি জানাই।”
পটুয়াখালী সদর থানার ওসি ইমতিয়াজ আহম্মেদ বলেন, “মৌকরণ ইউনিয়ন পরিষদের সেলিমকে উদ্ধার করা হয়েছে এতটুকু জানিতে পেরেছি। যেহেতু ঘটনাস্থল কেরাণীগঞ্জ তাই ঢাকার কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ বিষয়টি ভাল বলতে পারবে। তবে কেরাণীগঞ্জ থানার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। আমাদের কাছে যদি কোনো সাহায্য চায়, সেটা আমরা করতে প্রস্তুত।”