“হঠাৎ চিৎকার শুনে পিছনে তাকাই। দেখি অনেকে রাস্তায় পড়ে আছে। রথের উপর থেকে কেউ কেউ লাফিয়ে নামছে।”
Published : 08 Jul 2024, 11:45 PM
বগুড়া শহরে বৈদ্যুতিক তারের সঙ্গে রথের চূড়া লেগে আহতদের অনেকেই শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। তাদের প্রায় সবার হাত-পা, পেট ঝলসে গেছে।
আহতরা বলছেন, তাদের কেউ রথ ধরে ছিলেন, কেউবা যারা রথ ধরে ছিল তাদের পাশে ছিলেন। রথের চূড়া উপরের বৈদ্যুতিক তার স্পর্শ করামাত্র চারদিকে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। তারপরই তারা মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান।
এদিকে পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে বলে বগুড়া সদর থানার ওসি সাইহান ওয়ালিউল্লা জানান।
রোববার বিকালে প্রতিবছরের মত শহরের সেউজগাড়ী পালপাড়ার ইসকন মন্দির থেকে রথযাত্রা বের হয়। হাজার হাজার মানুষ এতে অংশ নেন। রথটি সেউজগাড়ী আমতলা মোড়ে এলে এর চূড়া বৈদ্যুতিক তারে লেগে পাঁচজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। আহত হয় অন্তত ৪০ জন।
আহতদের অধিকাংশ শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কয়েকজন সরকারি মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
সোমবার দুপুরে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের দেখতে গিয়ে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. রোকেয়া সুলতানা।
নিহতরা হলেন- সারিয়াকান্দী উপজেলার সাহাপাড়ার বাসিন্দা বাসুদেবের স্ত্রী সবিতা (৪০), আদমদীঘি উপজেলার কন্দুগ্রাম থানার ভবানী মোহন্তের ছেলে নরেশ মোহন্ত (৬০), পুরান বগুড়ার হিন্দু পাড়ার বাসিন্দা ননী কেশর সরকারের স্ত্রী অতসি রানী সরকার (৪৫), সদর উপজেলার গোহাইল মাসিন্দা এলাকার বাসিন্দা সুদেব মোহন্তের স্ত্রী রঞ্জিতা মোহন্ত (৫৫) এবং ছোট বেলঘড়িয়া এলাকার মৃত নরেন্দ্রনাথের ছেলে অলক কুমার (৪০)।
সোমবার দুপুরে সেউজগাড়ী পালপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে সুনসান নিরবতা। শোকের পরিবেশ। রাস্তায়, গলির মাঝে চার-পাঁচজন জটলা করে এ নিয়ে আলোচনা করছেন। পাড়ার কয়েকটি মুদি দোকান, সেলুন, স্টেশনারি দোকানেও একই আলোচনা শোনা গেল।
ইসকন মন্দিরে গিয়ে দেখা যায়, মন্দিরের ফটকে পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। মন্দিরের অধ্যক্ষ ক্ষুরাজিতা কৃষ্ণ দাশ তার কক্ষে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন। পাশেই চলছে রান্নার কাজ। কেউবা মন্দিরে এসেছেন ভক্তি জানাতে। সেবকদের কেউ কাপড় শুকাতে দিচ্ছেন।
অধ্যক্ষ ক্ষুরাজিতা কৃষ্ণ দাশও ঘটনার সময় রথের উপরেই ছিলেন। তিনি বসেছিলেন একটি কাঠের বেঞ্চে। সে কারণে তিনি দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যান।
অধ্যক্ষ বলছিলেন, “আমিও রথে ছিলাম। লোহার তৈরি রথটি ২০ বছর আগের তৈরি। যখন রথের চূড়া বৈদ্যুতিক তারের সঙ্গে লাগার উপক্রম হয় তখন কয়েকজন সেবক সেটি নামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক সেটি নামেনি। তাই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।”
শহরের নাড়ুলী এলাকার কৃষ্ণা কুমারী এসেছেন ইসকন মন্দিরে প্রণাম করতে।
তিনি বলছিলেন, “আমি রথে উঠতে চেয়েছিলাম; কিন্তু আমাকে উঠতে দেয়নি। তবু রথের সঙ্গে যাচ্ছিলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর হঠাৎ চিৎকার শুনে পিছনে তাকাই। দেখি অনেকে রাস্তায় পড়ে আছে। রথের উপর থেকে কেউ কেউ লাফিয়ে নামছে।”
মন্দিরের সেবক শুভ বসাক বলেন, “রথযাত্রায় ১০০ সেবক ছিলেন। কিছু ছিলাম রথে। তবে রথ যারা ধরে যাচ্ছিল তারাই আহত কিংবা নিহত হয়েছে।”
সেউজগাড়ীতে মুদি দোকানের সামনে কয়েকজন যুবক দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
তাদের মধ্যে রঞ্জন পাল বলছিলেন, “রথ রওনা দিয়ে সেউজগাড়ী আমতলা কাইল্যার বাজারে পৌঁছানোর আগে থেকে চূড়া নামানোর চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু নামাতে পারেনি। অনেক বছর আগের তৈরি লোহার রথে হয়ত সমস্যা হয়েছিল।
“বিদ্যুতের তারে লাগার পরই ধোঁয়া ওঠে। অনেকেই লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। মন্দিরের অধ্যক্ষসহ কয়েকজন সেবক কাঠের বেঞ্চে বসেছিলেন। এ কারণে তারা বেঁচে যান। এ সময় ভয়ে আশপাশের দোকানও বন্ধ হয়ে যায়।”
শহরের বনানী শিব মন্দিরে লোহার তৈরি রথটি রাখা হয়েছে। সেখানে তিন পুলিশ সদস্যকে সেটি পাহারা দিতে দেখা গেছে।
সেখান থেকে বেরিয়ে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে কথা হয়, শিবগঞ্জ উপজেলার রামচন্দ্রপুরের আহত ১০ বছরের শিশু সুষ্মিতার মা সমাপ্তি রানীর সঙ্গে। একটি বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে সুষ্মিতা। তার হাত-পা পুড়ে গেছে।
সমাপ্তি রানী বলেন, “হঠাৎ দেখি ধোঁয়া, মেয়ে রথ ধরেছিল। মেয়ে রাস্তায় পড়ে যাওয়ার পর তার উপর আরও পাঁচ-ছয়জন পড়েছে। চিৎকার করছিলাম। তখন একজন এসে আমার মেয়েকে তুলে নেয়। পরে আমরা মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে আসি।”
শহরের চকসুত্রাপুরের বাসিন্দা সীমা দাশ জানালেন, তিনি রথ ধরেছিলেন। হঠাৎ ঝিনঝিন অনুভব করলেন। তারপর আর কিছু বলতে পারেন না। জ্ঞান ফেরার পর দেখেন হাসপাতালের বিছানায়।
দুর্ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে ইসকন মন্দিরের সভাপতি দিলীপ কুমার বলেন, “২০ বছর আগের তৈরি রথ; প্রতিবছর চেক করা হয়। বাংলাদেশের সব রথই ঢাকা থেকে এসে তৈরি করে দেওয়া হয়। ভারতের পুরির জগ্ননাথ দেবের মন্দিরের রথ কাঠের হয়। প্রতি বছরই নুতন রথ তৈরি করা হয়। আমাদের এখানে তা হয় না।”
তিনি বলেন, “রথ টানছিল ১০ হাজারের বেশি ভক্ত। সেউজগাড়ী আমতলায় এসে রথের চূড়া নামানোর চেষ্টা করলেও তা নামানো সম্ভব হয়নি।”
বগুড়া জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি সাগর কুমার বলেন, “এ ঘটনায় আমরা শোকাহত।”
আরও পড়ুন:
বগুড়ায় রথযাত্রায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ৫ জনের মৃত্যু
বগুড়ায় রথযাত্রায় আহতদের খোঁজ নিতে হাসপাতালে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী