কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি ‘বিলুপ্তির’ খবরে ক্যাম্পাসে অস্ত্রের মহড়া

শুক্রবার রাতে কমিটি বিলুপ্তির বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবার তুলে নেওয়া হয়; আর এতে বিভ্রান্তি তৈরি হয়।

কুমিল্লা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Oct 2022, 05:31 PM
Updated : 1 Oct 2022, 05:31 PM

ছাত্রলীগ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটি ‘বিলুপ্তির’ খবরে দুই পক্ষের অনুসারীরা ক্যাম্পাসে শোডাউন করে অস্ত্রের মহড়া দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে ছাত্রলীগের একটি পক্ষের নেতা এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজা-ই-এলাহীর অনুসারীরা অর্ধশতাধিক মোটরসাইকেল নিয়ে ক্যাম্পাসে শোডাউন ও হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।

এর পর পরই ছাত্রলীগের ‘বিলুপ্ত কমিটি’র সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজের অনুসারীরা ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে রামদা, ছেনিসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়। এতে ক্যাম্পাসে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে ক্যাম্পাসে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ থানার ওসি দেবাশীষ চৌধুরী রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘটনা শুনে আমি অতিরিক্ত পুলিশ নিয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থান নেই। রাত ৯টায় আমি থানায় ফিরে এসেছি। তবে, ক্যাম্পাসে এখনও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।”

বিকেলে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন, “এই ঘটনা নিয়ে আমরা প্রক্টরিয়াল বডির সদস্য ও অন্যান্য হলের প্রভোস্টদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করবো। উপাচার্য মহোদয় ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী সময়ে পদক্ষেপ কী নেওয়া যায়, সেটি দেখছি।“

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ছাত্রলীগের উভয় পক্ষই মহড়ার বিষয়টি অস্বীকার করে অপরপক্ষের ওপর দোষ চাপিয়েছেন।

ইলিয়াস হোসেনের এক অনুসারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে দাবি বলেন, “ক্যাম্পাসে হল দখল করতে এবং শিক্ষার্থীদের মনে আতঙ্কিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থাকা রেজা-ই-এলাহীর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের ওই পক্ষ এমন কাজ করেছে।”

তবে প্রতিপক্ষের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ২০১৫ সালে ঘোষিত ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রেজা- ই-ইলাহী।

আগামী কমিটিতে সভাপতি পদের দাবিবার এই ছাত্রলীগ নেতা বলেন, “এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আমাদের কেউ সেখানে যায়নি। তারাই (ইলিয়াস অনুসারীরা) অস্ত্রের মহড়া দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে আমাদের ওপর দায় চাপাচ্ছে।”

কমিটির ‘বিলুপ্তি’ নিয়েই ‘বিভ্রান্তি’

ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৮ মে মো. ইলিয়াস মিয়াকে সভাপতি ও রেজাউল ইসলাম মাজেদকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রলীগের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর একই বছরের ২৫ নভেম্বর ১৬১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়।

এক বছরের জন্য গঠিত কমিটি প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর ধরে চলেছে। ওই কমিটির নেতাদের অনেকের এখন আর ছাত্রত্ব নেই; অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে গেছেন। কেউ আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করছেন। সভাপতি ইলিয়াস মিয়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী, তারও ছাত্রত্ব নেই। তিনি ১৫ বছর ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলে একা একটি কক্ষে থাকছেন বলেও অভিযোগ আছে।

এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার রাত ১১টা ৪৯ মিনিটে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ফেইসবুক পেইজে সংগঠনের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে মেয়াদোত্তীর্ণ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আধা ঘণ্টার মধ্যেই ছাত্রলীগের ফেইসবুক পেইজ থেকে তা আবার সরিয়ে নেওয়া হয়।

আর এতেই ‘বিভ্রান্তির’ সূচনা ঘটে। ‘বিলুপ্ত’ কমিটির বিরোধীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, প্রেস বিজ্ঞপ্তি সঠিক, কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। আবার ‘বিলুপ্ত’ কমিটি বলছে, এটি ভুলে চলে এসেছে। সামনে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি দেওয়া হবে।

তবে এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য শনিবার বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা করেও ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলো। সেই সঙ্গে নতুন কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে আগ্রহী পদপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে জীবনবৃত্তান্ত জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।”

ছাত্রলীগের কর্মসূচি ও পরিকল্পনা সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন, উপ-গণশিক্ষা সম্পাদক নাহিদুল ইসলাম নাহিদ এবং উপ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক ফাহিম ইসলাম লিমনের কাছে জীবনবৃত্তান্ত জমা দেওয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।

বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর পরই ‘বিলুপ্ত’ কমিটির সভাপতি ইলিয়াস হোসেন নিজের ফেইসবুক পেজে সেটি আপলোড করে এতে যাতে কেউ বিভ্রান্ত না হন সে ব্যাপারে পোস্ট দেন। রাতে তিনি এ নিয়ে পর পর তিনটি পোস্ট দেন। শনিবারও এ নিয়ে তিনি পোস্ট দেন।

তিনি লেখেন, “এটাতে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না। কমিটি বিলুপ্ত বা সম্মেলনের তারিখ হলে আমরা জানিয়ে দিবো।… এই কাগজ চুয়েটের প্রেস বিজ্ঞপ্তি… ভুল করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এসেছে।“

তবে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ‘বিলুপ্ত করে’ নতুন কমিটির জন্য সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে আগ্রহীদের যাদের কাছে জীবনবৃত্তান্ত জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে তাদের একজন ছাত্রলীগের উপ-সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক ফাহিম ইসলাম লিমন বলেন, “কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি (ইলিয়াস হোসেন) বিভ্রান্তিকর পোস্ট দিয়েছেন। চুয়েটের সঙ্গে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি মিলাচ্ছেন। কিন্তু চুয়েটের সেটাতে আমরা তিন জন নাই। কুমিল্লারটা আলাদা।”

একই দায়িত্বপ্রাপ্ত ছাত্রলীগের কর্মসূচি ও পরিকল্পনা সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনও বলেন, “এখন পর্যন্ত যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এটিই লিগ্যাল, কমিটি বিলুপ্ত। যদি পরবর্তী সময়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসে তাহলে আমরা জানাবো। এখন পর্যন্ত এটিই ঠিক।“

ইলিয়াস হোসেনের দাবির ব্যাপারে জানতে চাইলে সাদ্দাম হোসেন বলেন, “চুয়েটের জায়গায় কুবি আসছে এটি হাস্যকর। এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত তিনজন নেতার নাম, যোগাযোগের নাম্বার সবই কি ভুল ছিল? এগুলো তো হাস্যকর। এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় থেকে এটিই সিদ্ধান্ত এসেছে যে, কমিটি বিলুপ্ত।”

তবে কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক ইন্দ্রনীল দেব শর্মা রনি বলেছেন ভিন্ন কথা।

তিনি বলেন, “কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি এখনও। প্রেস বিজ্ঞপ্তিটি ভুলে হয়েছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি হবে। তারিখ নির্ধারণ হলে শিগগিরই জানানো হবে।”

২০০৭ সালের ২৮ মে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয় ‘ছাত্ররাজনীতি মুক্ত’ ছিলো। প্রতিবছর ভর্তির সময় শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতি ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ধূমপান করবে না বলে অঙ্গীকারনামা দিয়ে ভর্তি হয়।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ প্রকাশ্যে ছাত্ররাজনীতি শুরু করে।