ক্রিকেট ইতিহাসে এরিক হোলিস অমর হয়ে আছেন একটি বলের কারণেই। তবে ওয়ারউইকশায়ার কাউন্টি ক্লাবের জাদুঘর প্রবলভাবে জানিয়ে দিচ্ছে, এই লেগ স্পিনার স্রেফ ওই একটি ডেলিভারির চেয়েও অনেক বড় কিছু।
আমি অবশ্য হোলিসের আকর্ষণে ওই জাদুঘরে যাইনি। এজবাস্টনের ক্রিকেট জাদুঘরে গিয়েছিলাম মূলত ব্রায়ান লারার ইতিহাস গড়া ইনিংসটির ব্যাট দেখতে। যে ব্যাট হাতে ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে খেলেছিলেন অপরাজিত ৫০১ রানের সেই অতিমানবীয় ইনিংস।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সেটাই ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। ৬২ চার আর ১০ ছক্কায় ৪২৭ বলে ৫০১ রানের ইনিংসটি লারা খেলেছিলেন ১৯৯৪ সালের জুনে, এই মাঠেই।
ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে রানের বন্যা বইয়ে দেওয়ার সেই মৌসুমে ত্রিনিদাদের যুবরাজ ৮ ইনিংসে করেছিলেন ৭ সেঞ্চুরি।
কোনো একটি লেখায় পড়েছিলাম, লারার সেই ইনিংসের ব্যাটটি সংরক্ষিত আছে এই জাদুঘরে। দেখতে গেলাম তাই রোমাঞ্চে হাবুডুবু খেয়ে। কিন্তু কোথায় সেই ব্যাট!
“তুমি কিছু খুঁজছো?” কণ্ঠ শুনে চমকে দেখি হাসিমুখে তাকিয়ে মধ্যবয়সী একজন। পরিচয় দিলেন, জাদুঘরর কিউরেটর।
তাকে জানালাম কি খুঁজছি। চওড়া হাসিতে ভদ্রলোক বললেন, ‘তুমি নিশ্চয় মজা করছো!’
“মানে?”
আমার অবাক চাহনি দেখে তিনি বুঝিয়ে দিলেন হাসির কারণ। “লারা পাঁচশ রান করেছে যে ব্যাট দিয়ে, সেটা নিলামে তুললে পাঁচ অঙ্ক ছাড়ানো টাকা পাবে। জাদুঘরে কেন দেবে? আমরা অনেক চেষ্টা করেছি, পাইনি।”
সেই ম্যাচের অফিসিয়াল স্কোরকার্ড ও স্কোরবোর্ডের সামনে লারার ছবি অবশ্য জাদুঘরে আছে। তাতে কী আর মনের তিয়াস মেটে!
তবে অন্যভাবে তা ঠিকই মিটলো। মেটালেন হোলিস।
ক্রিকেটের যারা মনোযোগী অনুসারী, হোলিসের নাম শুনলেই তারা বলে দেবেন, একটি ডেলিভারিতেই ক্রিকেট ইতিহাসে চিরস্থায়ী জায়গা পেয়ে গেছেন এই লেগ স্পিনার।
১৯৪৮ সালের ১৪ অগাস্ট, স্যার ডনের ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট শুরু। প্রথম দিনই ইংল্যান্ড ৫২ রানে অলআউট।
এরপর ব্যাটিংয়ে নামল অস্ট্রেলিয়া। ১১৭ রানের উদ্বোধনী জুটি গড়লেন সিড বার্নস ও আর্থার মরিস। ৬১ রান করা বার্নসকে ফিরিয়ে জুটি ভাঙলেন হোলিস। মাঠে ঢুকলেন নতুন ব্যাটসম্যান ডন।
যদিও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ডের মাঠে খেলা, ব্যাট হাতে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দিয়েছেন ইংলিশদেরই, তবু বিদায় বেলায় সেখানেই পেলেন দারুণ সম্মান ও ভালোবাসা।
ওভালের পুরো গ্যালারি উঠে দাঁড়াল। মাঠে ইংলিশ অধিনায়ক নর্মান ইয়ার্ডলি গোটা দলকে পাশে নিয়ে সম্মান জানালেন টুপি খুলে ও থ্রি চিয়ার্স দিয়ে। তাদের সঙ্গে করমর্দন করে উইকেটে গেলেন ডন।
মাত্র ৪ রান করলেই তার টেস্ট ব্যাটিং গড় হয়ে যাবে পারফেক্ট হান্ড্রেড- ঠিক একশ। স্রেফ একটি শটের ব্যাপার।
অনেক ইতিহাসের জন্ম দেওয়া ব্যাটে নতুন ইতিহাসের রচনা দেখতে পিনপতন নিরবতায় তাকিয়ে গ্যালারি। প্রথম বল করলেন হোলিস, অর্থোডক্স লেগব্রেক। রান হলো না।
পরের বলটি পিচ করালেন আরেকটু সামনে। ডন সামনে পা বাড়িয়ে খেলতে চাইলেন। কিন্তু গুগলির মতিগতি পড়তে পারলেন না। মিস করলেন বলের লাইন। স্টাম্পে বলের আঘাতের শব্দ এলো তার কানে।
ইংল্যান্ড ম্যাচ হারল ইনিংস ব্যবধানে। দ্বিতীয় ইনিংস তাই ব্যাট করার সুযোগ পেলেন না ডন। ব্যাটিং গড় ১০০ করারও কোনো সুযোগ তাই হলো না।
ডনের ব্যাটিং গড় ৯৯.৯৪, সম্ভবত ক্রিকেটের সবচেয়ে আলোচিত সংখ্যা।
ক্রিকেটে দুনিয়ার সেরা ব্যাটসম্যান কোনো ম্যাচে শূন্য রানে আউট হতেই পারেন। কিন্তু সেই সাধারণ বোধকে ছাপিয়ে গিয়েছিল ডনের আউট। ব্যাট হাতে অকল্পনীয় সব কীর্তির নায়ক জীবনের শেষ ইনিংসে রান করতে পারেননি!
ক্রিকেট রোমান্টিকদের অনেকে বলেন, পারফেক্ট হান্ড্রেড না হয়েই ভালো হয়েছে। ডন পারেননি বলেই না যুগে যুগে কত গল্প রচনা, কত কাব্য লেখা হয়েছে ৪ রানের আক্ষেপ নিয়ে। হয়েছে বিস্তর গবেষণা।
ডন আউট হওয়ার পর বিবিসির ধারাভাষ্যে কিংবদন্তি ধারাভাষ্যকার জন আর্লট যা বলেছিলেন, তার সারমর্ম এরকম- চারপাশের যে আবহ, আবেগের উথাল-পাথাল ঢেউ, সেসবে হাবুডুবু খেয়ে বল ঠিকমতো দেখতে পারেননি ডন।
আবেগ স্পর্শ করার গল্পটাকে আরও গভীরে নিয়ে যান স্যার লেট হাটন। সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন এই ইংলিশ ছিলেন মাঠে। ডনের শূন্য নিয়ে পরে বলেছিলেন, “চোখে পানি নিয়ে ব্যাট করা সহজ নয়!”
হোলিস অবশ্য ডনের উইকেটকে দেখতেন নিজের পরিকল্পনার জয় হিসেবে।
ম্যাচের জন্য ওভালে রওনা হওয়ার আগে হোলিস নাকি তার এক সতীর্থকে বলেছিলেন, “ডন প্রথম বলেই গুগলি আশা করতে পারে। আমি প্রথম বলটি লেগ ব্রেক করে, দ্বিতীয়টি করব গুগলি।”
ওই ম্যাচে যে ক্যাপ পরে খেলেছিলেন, সেটি পরে হোলিস উপহার দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার আর্থার মরিসকে। অনেক বছর পরে ওই ক্যাপ নিলামে তোলা হয়েছিল মেলবোর্নে।
আয়োজকদের আশা ছিল, অন্তত ২৩ হাজার ডলার মিলবে। কিন্তু কেউ কেনেনি সেই ক্যাপ! তখন বলা হয়েছিল, ব্র্যাডম্যানকে বঞ্চিত করা ‘অপরাধী’ বলে হোলিসের ক্যাপ কেনেননি কোনো অস্ট্রেলিয়ান!
ওই আউট নিয়ে এভাবেই ছড়িয়েছে নানা মিথ। এখনও সেসব জাগায় কৌতূহল, বিস্ময়। প্রতিবারই হোলিসের নাম আসে অবধারিতভাবে।
১৩ টেস্টে ৪৪ উইকেট, এমন সাদামাটা যার রেকর্ড, তকে ক্রিকেট বিশ্ব কেন মনে রাখবে? হোলিস অমর হয়ে আছেন ব্র্যাডম্যান ট্র্যাজেডির নায়ক কিংবা খলনায়ক হিসেবে।
তবে ওয়ারউইকশায়ারে তিনি মহানায়ক। কেবল ব্র্যাডম্যানকে আউট করার জন্য নয়, এ কাউন্টির হয়ে খেলে অবিস্মরণীয় সব সাফল্য তিনি এনে দিয়েছেন। টেস্ট ক্রিকেটে নিজের সামর্থ্য দেখাতে পারেননি, তবে কাউন্টি ক্রিকেটে রাজত্ব করেছেন দুই যুগ।
বলে টার্ন খুব বেশি ছিল না তার। তবে টপ স্পিন ছিল দুর্দান্ত। গুগলিও অনেক সময় ছিল দুর্বোধ্য। ধারাবাহিকভাবে বল রাখতে পারতেন একই লেংথে। এক প্রান্ত থেকে ক্লান্তিহীন বোলিং করে যেতে পারতেন দিনভর। ধরতেন একের পর এক শিকার।
১৯৪৬ সালে ঘরের মাঠ এজবাস্টনে নটিহংহ্যামশায়ারের বিপক্ষে ইনিংসে ১০ উইকেটের সবকটি নিয়েছিলেন কোনো ফিল্ডারের সাহায্য ছাড়া। ৪৯ রানে ১০ উইকেটের সাতটি ছিল বোল্ড, তিনটি এলবিডব্লিউ। এছাড়া ৯ উইকেট নিয়েছেন দুইবার, আটবার পেয়েছেন ৭ উইকেট।
১৯৫১ সালে ওয়ারউইকশায়ারকে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ জেতানোর পথে মৌসুমে নিয়েছেন ১৪৫ উইকেট। ১৯৫৫ সালে তাকে ‘বর্ষসেরা ক্রিকেটার’ মনোনীত করে উইজডেন।
প্রায় প্রতি মৌসুমেই বল করেছেন হাজারের বেশি ওভার। ১৯৫৭ সালে ক্যারিয়ারের শেষ মৌসুমেও বোলিং করেছেন সবার চেয়ে বেশি, ১ হাজার ১৫৭ ওভার। লেস্টারশায়ারের বিপক্ষে ম্যাচে এক পর্যায়ে তার টানা ৭৮ বলে কোনো রান নিতে পারেনি ব্যাটসম্যানরা।
এসব পরিসংখ্যানের চেয়েও বড় কথা, মাঠে হোলিস ছিলেন বিনোদনের উৎস, তাই ছিলেন দারুণ জনপ্রিয়। তার বোলিং দেখতে লোকে ভিড় করত মাঠে। তাকে নিয়ে ছড়িয়েছে অনেক কিংবদন্তি।
নিজেদের মহানায়কের স্মৃতি ধরে রাখতে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দেওয়ার সব আয়োজনই আছে এজবাস্টনে। জাদুঘরে হোলিসের প্রবল উপস্থিতি তো আছেই, মাঠের একটি স্ট্যান্ডও তার নামে। মাঠের সবচেয়ে উৎসবমুখর ও আকর্ষণীয় স্ট্যান্ড সেটি।
লোকে যতোই তাকে একটি বলের জন্য মনে রাখুক, ওয়ারউইকশায়ারে তিনি এক জীবনের নায়ক, অনেক জীবনের প্রেরণা।