রবিন হুডের জঙ্গলে ক্রিকেটের মাঠ

‘ওয়েলকাম টু রবিন হুড ক্রিকেট গ্রাউন্ড, ফ্রেন্ডস!’

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 June 2019, 07:41 AM
Updated : 24 June 2019, 09:11 AM

চারপাশের নির্জনতা ভেদ করে ভেসে এলো ভরাট কণ্ঠ। চমকে তাকাতেই দেখি আকর্ণ বিস্তৃত হাসিতে তাকিয়ে আছেন মধ্যবয়সী একজন। 

পাশেই আরেকজনকে চোখে পড়ল। জিহ্বা বের করে সতর্ক চোখে আমাদের পরখ করতে করতে সমানে লেজ নাড়ছেন। যেন বুঝতে চেষ্টা করছেন- অনাহূত এই অতিথিদের নিয়ে তার কী করা উচিত।

সম্ভাষণের জবাবে ধন্যবাদ জানিয়ে আমার চোখ আবার ফিরে গেল পাশের মাঠের দিকে। আসলেই এর নাম রবিন হুড ক্রিকেট গ্রাউন্ড?

গল্পের রবিনহুডকে নিয়ে যেমন চলে কল্পনা আর বাস্তবের দোলাচল, সত্যি-মিথ্যার ঘোর, এই মাঠ ঘিরেও আমার কেমন ঘোর লেগে গেল। রবিন হুডের যুগে ক্রিকেট ছিল? কোনোভাবে কি রবিন হুডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই মাঠ?

ঘোর কাটল আমাদের স্বাগত জানানো সেই মানুষটির হাসিতেই। দর্শনার্থীদের ধন্দে ফেলে যেন খুব মজা পাচ্ছেন!

বোঝা গেল, মাঠের সত্যিকারের নাম এটি নয়। তাতে অবশ্য কিছু যায়-আসে না। রবিন হুডের রাজ্যে সবই চলে তার নামে। ক্রিকেট মাঠও যদি রবিন হুডের নামে হয়, তাতে আর বিস্ময়ের কি।

বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সংবাদ নিতে এবং দিতে আমরা বাংলাদেশের চার সংবাদকর্মী গিয়েছিলাম নটিংহ্যামে। আমরা গিয়েছিলাম রবিন হুডের রাজ্য।

লোককাহিনীর রবিন হুড যেমন সুদর্শন, তেমনি সাহসী। ধনুক আর তলোয়ারে দক্ষতায় তার জুড়ি মেলা ভার। অত্যাচারী ধনীদের কাছ থেকে সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে তিনি বিলিয়ে দিতেন গরীবের মাঝে।মধ্যযুগের শেষ ভাগে নটিংহ্যামের শেরউডের জঙ্গলে ছিল তার সগর্ব বিচরণ।

আর এখন গোটা নটিংহ্যামশায়ারই যেন রবিন হুডের রাজ্য। শহরে আছে তীর ছুঁড়তে উদ্যত রবিন হুডের ভাস্কর্য। বার, পাব, রেস্তোরাঁ, রাস্তা, বাড়ি, হোটেলসহ নানা কিছুর নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে কিংবদন্তি এই চরিত্রের নাম।

রবিন হুড বলে কেউ সত্যিই ছিলেন? এ নিয়ে যুগে যুগে গবেষণা হয়েছে বিস্তর। তাকে নিয়ে সবচেয়ে পুরোনো যে গাঁথার সন্ধান মেলে, সেটি সেই ১৪০০ সালের।

ইতিহাসবিদদের গবেষণায় নিশ্চিত কিছু মেলেনি।তবে মিথ ক্রমে ডালপালা ছড়িয়েছে। জমেছে গল্পের পর গল্প। বেড়েছে জনপ্রিয়তা। তাকে নিয়ে হয়েছে চলচ্চিত্র, টিভি সিরিজ, কার্টুন স্ট্রিপ।

প্রতিবছর বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে লাখ লাখ পর্যটক রবিন হুডের ‘স্মৃতির’ সন্ধানে ছুটে আসেন শেরউডের জঙ্গলে। নটিংহ্যাম থেকে সাউথ্যাম্পটনে যাওয়ার পথে আমাদের মনে হলো, এত কাছে এসে শেরউডের জঙ্গলে না গেলে অন্যায় হয়ে যায়! ব্যস, প্রসঙ্গ উঠতে দেরি, সিদ্ধান্ত নিতে দেরি নয়।

নটিংহ্যাম শহর থেকে ৪৫-৫০ মিনিটের ড্রাইভ শেরউডের জঙ্গল। দূর থেকে দেখে মনে হয় বনের সবুজ যেন মিশে গেছে আকাশের নীলে। কাছে যাওয়ার পর অবশ্য জঙ্গলের চিরায়ত রূপটিই ধরা দিল।

ইচ্ছে হলো জিপিএসকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইচ্ছে মতো জঙ্গলে ঘুরি। বনের গভীরে গিয়ে চারপাশের স্তব্ধতায় কেমন শিহরণ খেলে গেল মনে। মনে খেলে গেল ভাবনা, হয়তো একসময় সেখানেই লিটল জন, উইল স্কারলেটদের নিয়ে শেরিফের কাছ থেকে অধিকার আদায়ের রণপরিকল্পনা সাজাতেন রবিন হুড। সদাবিদ্রোহী জীবনের শত ব্যস্ততা ও সতর্কতার ফাঁকে এখানেই হয়তো তার আনন্দময় সময় কেটেছে প্রেয়সী মারিয়ানের সঙ্গে!

কিংবা কে জানে, শতবর্ষী গাছগুলো হয়তো নীরবে আমাদেরই উপহাস করছে। কল্পনার রবিন হুড নয়, কালের সাক্ষী হয়ে তারাই তো শেরউডে অস্তিত্বমান।

ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। ক্রিকেট রিপোর্টার জঙ্গলেও মঙ্গল খোঁজে ক্রিকেট আনন্দে। শেরউডের জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর সময়ই চোখে পড়ে অদ্ভুত সুন্দর এক মাঠ!

অবহেলায় পড়ে থাকা কোনো প্রান্তর এটা নয়, রীতিমত যত্নে গড়ে তোলা ক্রিকেট মাঠ। চারপাশের সবুজের সঙ্গে ক্রিকেট মাঠের সবুজ মিলিয়ে সৌন্দর্যের আধার যেন!

মাঠে উইকেট আছে, প্র্যাকটিস উইকেট আছে। চমৎকার করে ছাঁটা ঘাস, আছে সাইট স্ক্রিন, সীমানা দড়ি। খেলা উপভোগের জন্য সীমানার বাইরে কাঠের বেঞ্চও আছে।

একপাশে একটি ঘরও চোখে পড়ল। সেই ঘরের সামনে থেকেই আমাদের স্বাগত জানিয়েছিলেন সেই মাঝবয়েসী ভদ্রলোক। তার কাছ থেকেই জানা গেল, সেটি আসলে একটি ক্লাব ঘর।

রাজকীয় খেলা ক্রিকেটকে রবিন হুডের রাজত্বে নিয়ে এসেছে এই ক্লাবই, বনের লাগোয়া গ্রামের নামে নাম- ‘এডউইনস্টো ক্রিকেট ক্লাব।’

মাঠের এক পাশে দেখা গেল রবিন হুডের ভাস্কর্য, লড়াই করছেন শত্রুর সঙ্গে। আরেকপাশে ছোট্ট একটি পার্ক, শারীরিক কসরতের নানা আয়োজন সেখানে। গাছে ওঠা, খানা-খন্দ পার হওয়া, এসব পরীক্ষার মধ্য রবিন হুডের সময়টায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা।

এই এডউইনস্টো ক্লাবের ইতিহাসও কম পুরোনো নয়। ১৮০০ সাল থেকে এই অঞ্চলে ক্রিকেট খেলার প্রমাণ মিলেছে অনেক। সেই যুগের কিছু ম্যাচের স্কোরকার্ডও সংরক্ষিত আছে।

সেসবসহ শত বছরের পুরোনো আরও কিছু নিদর্শন রাখা আছে ক্লাব ঘরে। তবে ক্লাব তখন বন্ধ, তাই ইতিহাসের পাঠ এর বেশি হলো না।

ক্লাব সদস্যরা সপ্তাহান্তে এই মাঠে খেলতে আসেন। স্থানীয় ডিস্ট্রিক্ট লিগের খেলাও নিয়মিত হয় এই মাঠে। ক্লাব ঘরের দরজার ওপরে দেখা গেল ডিজিটাল স্কোরকার্ড। জঙ্গলের মাঝে আধুনিকতার ছোঁয়া।

হঠাৎ মনে হলো, রবিন হুড তার রাজত্বে ক্রিকেট দেখলে কী করতেন? তলোয়ার ফেলে ব্যাট চালনায় নেমে যেতেন?

পরমুহূর্তে মনে হলো, হাস্যকর ভাবনা। ব্যাট-বলের বিনোদন রবিন হুডের জন্য নয়। গল্পের শেরউডের বীর তো তীর-ধনুক আর তলোয়ার হাতে নিয়েছিলেন জীবনের জন্য!