মহামারী পরবর্তী মালয়েশিয়ায় কেমন আছেন প্রবাসীরা

ভিসা জটিলতা ও দেশে যাতায়াতে বিমান টিকিটের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কিছুটা কষ্টে আছেন তারা। মালয়েশিয়ায় দ্রব্যমূল্য বাড়াতে মাসিক খরচ বেড়েছে, আবার দেশেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে আগের চেয়ে বেশি টাকা পাঠাতে হচ্ছে।

রফিক আহমদ খানমালয়েশিয়া থেকে
Published : 27 Dec 2022, 11:48 AM
Updated : 27 Dec 2022, 11:48 AM

প্রায় ৩৯ মাস পর মালয়েশিয়া এলাম। এ তিন বছর তিন মাসে মালয়েশিয়া বদলে গেছে অনেকখানি। বদলে গেছে মানে উন্নতই হয়েছে বলবো।

তাহলে মালয়েশিয়া কি আগে উন্নত ছিলো না! হ্যাঁ ছিল। তবে এখন আরও উন্নত। বেড়েছে নতুন সড়ক। হুহু করে বেড়েছে আকাশচুম্বী দালানকোঠা, নান্দনিক সব ইমারত, একটার চেয়ে আরেকটা সুন্দর। বেড়েছে বড় শপিংমলের সংখ্যা। এতো শপিংমল, এতো হোটেল হচ্ছে, দেখে অবাক লাগে।

তবে এ দেশেও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, পোশাকের দাম বেড়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানলাম মানুষের আয়ও বেড়েছে। পণ্যমূল্যের বৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের বেতন বৃদ্ধির মধ্যে একটা সমন্বয় আছে এখানে। বড় কথা মানুষের কাজ আছে, বেকার মানুষ নেই। বরং এ দেশে এখনও কর্মীর যথেষ্ট অভাব রয়েছে। বাংলাদেশ এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ‘সিন্ডিকেট’ ভেঙে দিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে লোক পাঠালে দ্রুত বেশি কর্মী পাঠানো সম্ভব।

এক প্রবাসী বাংলাদেশির সঙ্গে দেখা হতেই বললেন, ‘কি ভাই, সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার কথা বলেন, আমি সিন্ডিকেটে কোটি টাকা দিয়ে বসে আছি, সিন্ডিকেট ভাঙলে তো আমরা মারা যাবো!’ যাক, সিন্ডিকেট ভাঙবে নাকি আরও শক্ত হবে সেটা বলা যায় না। কারণ, সিন্ডিকেট সদস্যরা অনেক শক্তিশালী এতে কোনো সন্দেহ নেই। উভয় দেশের সরকার চাইলেই কেবল এ সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব।

মহামারীর পর মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা কাজকর্ম করে মোটামুটি ভালোই আছেন মনে হলো। শুধু বিপাকে আছেন যথারীতি ভিসা সংক্রান্ত জটিলতায়। লোকজনের ভিসার সমস্যা থাকায় কুয়ালালামপুরে বাংলা মার্কেটখ্যাত কোতারায়ায় বেচাকেনায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। এখানে বাংলাদেশি দোকানগুলোতে আগের মতো ক্রেতা নেই। ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা এ মালয়েশিয়ায় সারাজীবনই লেগে থাকে!

এখন প্রবাসী কর্মীদের ৫/৬ নম্বর ভিসা (পারমিট) লাগছে না। লাগবে কি লাগবে না এখনো ঠিক জানেন না প্রবাসীরা। তবে আশা করা যায় দেরিতে হলেও লাগবে। ২০১১ সালে যারা পারমিট (ভিসা) করেছিলেন, তাদেরও ১১/১২ নম্বর ভিসা করাতে জটিলতা পোহাতে হচ্ছে। অন্যদিকে গত বছর থেকে যারা নতুন করে ভিসার জন্য আবেদন করেছেন, তাদেরও ভিসা পেতে বেশ সময় লাগছে। খুব ধীরগতিতে পারমিটের কাজ চলছে। এসব সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ হাই কমিশনের পক্ষ থেকে মালয়েশিয়া সরকারকে আহ্বান করা হয়েছে বলে জানালেন মালয়েশিয়া প্রবাসী সাংবাদিক মোস্তফা ইমরান রাজু।

১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ হাই কমিশন আয়োজিত অভিবাসী দিবসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত মালয়েশিয়ার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের উদ্দেশে হাই কমিশনার তার বক্তব্যে এ আহ্বান জানান। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা সাংবাদিক মোস্তফা ইমরান রাজু বিষয়টি আমাকে জানান। তবে একথা সত্য যে, মালয়েশিয়ায় ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত কাজ বরাবরই ধীরগতিতে চলে। শ্রমিকদের ভিসা ‘হচ্ছে…হচ্ছে…’ করেই মাস ছয় চলে যায়। এমনকি বছর দুয়েকও অতিবাহিত হয় কখনও।

এবার মালয়েশিয়া এসে দেখলাম এক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ছাড়া বাকি সব উল্টো। এখানে মানুষের বেতন বেড়েছে, সেটা ধারণার চেয়েও বেশি। বেকারত্ব কমেছে। এদেশে এখন কাজ আছে, কিন্তু কাজ করার কর্মীর অভাব। যে কাজে আগে বেতন ছিল হাজার-বারশ রিঙ্গিত, সে কাজে এখন বেতন প্রায় দুই হাজার রিঙ্গিত।

মহামারীর আগে দেশটিতে যেসব বড় বড় অবকাঠামোর কাজ শুরু হয়েছিল, সেগুলো যথারীতি শেষ হয়েছে। কোনো কোনোটা এখনও চলমান, যেগুলো দীর্ঘ মেয়াদের কাজ৷ যেমন হাংতুয়া-টাইমস স্কয়ারের মাঝখানে লালাপর্ট বুকিত বিনতান সিটি সেন্টারের কাজ শেষ হয়ে চালু হয়ে গেলো দারুণ সুন্দর শপিংমল, হোটেল কাম পার্ক। বড়ই নান্দনিক। লেভেন চারে পার্ক। এ পার্ক থেকেই পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার, কেএল টাওয়ার, টিআরএক্স টাওয়ার, টাইমস স্কয়ারসহ কুয়ালালামপুরের সব কয়েকটি বড় টাওয়ার দেখা যায়। 

এ রঙিন শপিংমলে শুধু ফ্যাশন পণ্য ও নামিদামি রেস্টুরেন্টে ভরপুর তা নয়, এখানে আছে ‘এক্সেস বুক’ নামে সুবিশাল বইয়ের দোকান। এ বইয়ের দোকানটি এতো শৈল্পিকভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যে দেখে মুগ্ধ হওয়ার মতো। এর আগে কুয়ালালামপুরে এতো সুন্দর ও বিশাল বুকশপ আর দেখিনি, বুকশপের ভেতরেই আছে ছোটোখাটো ফুডকোর্ট।

বুকিত বিনতাং সিটি সেন্টার থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরত্বে ১১৮ তলা টাওয়ার ‘পিএনবি মারদেকা ১১৮’ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেছে সম্পূর্ণ, বাকি আছে শুধু অল্পকিছু কাজ। বাকি মানে কাজ দ্রুত চলছে। নীল রঙের এ টাওয়ারটি হতে যাচ্ছে মালয়েশিয়ার সর্বোচ্চ টাওয়ার, যার উচ্চতা ৬৭৮.৯ মিটার বা ২ হাজার ২২৭ ফিট। বছরখানেকের মধ্যে ‘মারদেকা-১১৮’ চালু হয়ে গেলে কুয়ালালামপুরের চেহারা আরেকবার বদলে যাবে। শুধু কুয়ালালামপুর বদলে যাবে তা নয়, যে মালয়েশিয়া দীর্ঘদিন ধরে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের জন্য বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিতি পেয়ে আসছে, সে দেশটি নতুন করে পরিচিত হবে মারদেকা-১১৮ টাওয়ারের দেশ হিসেবে, বাড়বে আন্তর্জাতিক পর্যটকের ভিড়।

এবার মালয়েশিয়ায় এসে সবচেয়ে ভাল লাগলো চায়নাটাউন আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে দেখে। বিদেশি পর্যটকে জমজমাট এখন চায়নাটাউন, যেখানে অনেক বাংলাদেশি ব্যবসা করতেন আগে, এখনও করছেন অনেকেই। অন্যদিকে হাংতুয়া কেনেঙ্গা হোলসেইল সিটিতেও ভাল ব্যবসা করছেন বাংলাদেশি প্রবাসীরা। টাইমস স্কয়ার, বুকিত বিনতাং এলাকাও মহামারীর আগের অবস্থায় ফিরেছে। মোটামুটি ভালোই আছেন বলা চলে বাংলাদেশিরা। শুধু ভিসা জটিলতা ও দেশে যাতায়াতে বিমান টিকিটের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কিছুটা কষ্টে আছেন তারা। অন্যদিকে মালয়েশিয়ায় দ্রব্যমূল্য বাড়ার ফলে মাসিক খরচ বেড়েছে, আবার দেশেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে এখন আগের চেয়ে বেশি টাকা পাঠাতে হচ্ছে পরিবারের জন্য।

তবে গত ৩৯ মাসে মহামারীর দুর্ভোগ ছাড়া মালয়েশিয়ায় যত চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছে তা দেশটির রাজনীতিতে। এ সময়ের মধ্যে মালয়েশিয়ায় চার ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা হলেন- মাহাথির মোহাম্মদ, মহিউদ্দিন ইয়াসিন, ইছমাইল সাবরি ইয়াকুব ও আনোয়ার ইব্রাহিম (চলমান)। কথা হচ্ছে, যতই রাজনৈতিক সংকট থাকুক, মালয়েশিয়ার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ঠিকই এগিয়ে গেছে। মালয়েশিয়া এগিয়ে যাক, তবেই আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধারা ভালো থাকবেন। তারা ভালো থাকলে আমাদের অর্থনীতির চাকাও সচল থাকবে।