একাত্তরের চিকিৎসক দম্পতির সুখস্মৃতি

“একাত্তরের রণাঙ্গনে চিকিৎসা দেওয়া যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকবছর পরেও বাড়ি খুঁজে বের করে ধন্যবাদ জানাতে আসতেন। সেইসব দিনগুলো খুব সুখস্মৃতিময়। মনে পড়লে ভেতরে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা বোধে আচ্ছন্ন হয়ে যাই।”

নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 July 2021, 04:50 AM
Updated : 10 July 2021, 04:43 PM

যুক্তরাষ্ট্রের বসবাসরত বীর মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসক দম্পতি শেখ বনি আমিন এবং আকতার বানুর সঙ্গে কথোপকথনের সময় এভাবেই একাত্তর নিয়ে তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন। নিউ জার্সিতে বড় মেয়ের বাসা থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধির সঙ্গে দীর্ঘসময় কথা বলেন তারা দুইজন।   

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে স্মৃতি রোমন্থনে যেন একাত্তরের দিনগুলিতে ফিরে গিয়েছিলেন এ চিকিৎসক দম্পতি।

৮২ বছর বয়সী শেখ বনি আমিনের স্মৃতি রোমন্থন করা সহজ হয় জীবনসঙ্গী আকতার বানুর (৮০) কারণে। পারষ্পরিক মতবিনিময়ে উদ্ভাসিত হয় প্রতিটি মুহূর্ত, রণাঙ্গনের স্বপ্নের দিনগুলো। দুই পুত্র এবং তিন কন্যার অভিভাবক এ মুক্তিযোদ্ধা দম্পতি বছরের বড় একটি সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়ায় ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে কাটান। বাকি সময় থাকেন বাংলাদেশে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত এবং সীমান্ত এলাকার শরনার্থী শিবিরে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন চিকিৎসক দম্পতি বনি আমিন এবং আকতার বানু। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাও করেন ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা শিবিরের মাধ্যমে। জীবন বাজি রেখে এক শিবির থেকে আরেক শিবিরে ছুটে গিয়ে মানবতার সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রাখার অবিস্মরণীয় দিনগুলো এখনও তাদের স্মৃতির আয়নায় ভেসে বেড়ায়।

বিশ্বখ্যাত ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে এবার স্নাতক পাস করা একমাত্র নাতনী এমিলি সাদীর সাথে মুক্তিযোদ্ধা বনি আমিন।

শেখ বনি আমিনের বাড়ি বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলায়। ৫০ বছর আগের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি জানার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা কুষ্টিয়া শহরে আমাদের ক্লিনিক বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় পতাকা উড্ডীন হবার ৩ সপ্তাহ পর অর্থাৎ বাহাত্তরের ৪ জানুয়ারি মুক্ত-স্বাধীন বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় ফিরেছি।”

“বিধ্বস্ত ক্লিনিক পুননির্মাণ করি এবং চিকিৎসা পেশায় মনোনিবেশ করেছিলাম। সৌদী আরবে কিছু চিকিৎসক নেওয়া হবে শুনে ১৮৪ জনের সাথে আমরা দুইজনও ইন্টারভিউতে অংশ নেই। বাছাইকৃত ১৮ জনের আমরাও ছিলাম। টানা ১৩ বছরের মত সৌদী আরবে কাজ করেছি। এরপর বাংলাদেশে ফিরে আরও কিছুদিন চিকিৎসাসেবায় ছিলাম।”

১৯৯৪ সালে এ দম্পতি স্থায়ীভাবে চিকিৎসাসেবা থেকে অবসর নেন বলে জানান।  এরপর নিজ গ্রামে অর্থাৎ ফকিরহাট উপজেলার সাতশৈয়া গ্রামে বাবার নামে ‘শেখ আব্দুল হামিদ জুনিয়র বিদ্যালয়’ এবং নিজ নামে ‘মুক্তিযোদ্ধা ডা. বনি আমিন জুনিয়র বালিকা বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। দুইটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষক-কর্মচারীর বেতনসহ যাবতীয় অর্থ সহায়তা দিচ্ছেন এ দম্পতি।

ইতোমধ্যে গ্রামে ১০ শয্যার একটি শিশু ও মাতৃসদন হাসপাতালকে ৮০ শতাংশ জমিও দান করেছেন তারা। সেটির নাম হবে ‘মুক্তিযোদ্ধা আকতার বানু মা ও শিশু কল্যাণ হাসপাতাল’। এছাড়াও গরীব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের অনুদান দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন।

ফকিরহাট উপজেলার সাতশৈয়া গ্রামে স্থাপিত বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা।

চলতি বছরের জুলাই থেকে মাসিক সম্মানী ভাতা বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা করায় বীর মুক্তিযোদ্ধা বনি আমিন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, “সরকারের সম্মানী ভাতা বাবদ পাওয়া টাকার পুরোটাই প্রতিবেশী গরিব-দুখীদের মধ্যে বিতরণ করে আসছি।”

বনি আমিন এবং আকতার বানু সমস্বরে বলেন, একাত্তরে যে চেতনায় তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, সেই চেতনায় ফিরেছে বাংলাদেশ। জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন, তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে নিচ্ছেন। এটি বাঙালি হিসেবে অত্যন্ত গৌরবের একটি অধ্যায়।

তারা বলেন, বহু ত্যাগের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সঠিক ট্র্যাকে ফেরা বাংলাদেশ যেন একইধারায় সম্মুখে চলতে পারে, এ জন্য দরকার নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানানো। আর এ জন্য স্কুল-কলেজের পাঠ্যে বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির অসাধারণ ভূমিকা নিয়ে আরও বেশি বিষয়বস্তু রাখতে হবে বলে মনে করেন এ দম্পতি। 

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্যসহ উন্নতবিশ্বে বসবাসরত প্রবাস-প্রজন্মকেও বাঙালির এগিয়ে চলার ইতিহাস ভালো ভাবে জানানোর প্রয়োজন আছে বলে তারা মন্তব্য করেন।

মুক্তিযোদ্ধা এ চিকিৎসক দম্পতির দুই ছেলে এবং তিন কন্যা। ছেলে ও মেয়েদের সঙ্গে প্রবাসে একটি নির্দিষ্ট সময় কাটানোর পর মূলত তারা বাংলাদেশে অবস্থান করেন জনহিতকর কাজের জন্য।

মুক্তিযোদ্ধা দম্পতির অর্থে তৈরি ফকিরহাট উপজেলার সাতশৈয়া গ্রামে স্থাপিত জুনিয়র হাই স্কুল ভবন।

তাদের জ্যেষ্ঠ পুত্র সানি, জ্যেষ্ঠ কন্যা জুডি ও মেঝ কন্যা এ্যানি বাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রে। নাজমা ও টনি থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। অর্থাৎ বিশ্বের তিন প্রান্তে পুত্র-কন্যারা বাস করায় এক অর্থে তারা এখন বিশ্বনাগরিক।

পুত্র-কন্যাদের সবাই প্রতিষ্ঠিত। রয়েছে ৮ নাতি এবং এক নাতনি। মুক্তিযোদ্ধা এ চিকিৎসক দম্পতিরও প্রচুর সম্পদ রয়েছে বাংলাদেশে।

প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাস চিকিৎসায় এ চিকিৎসক দম্পতির জ্যেষ্ঠ জামাতা আরেক প্রবাসী বাংলাদেশী রায়ান সাদীর নেতৃত্বে সম্প্রতি আবিষ্কৃত একটি ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর (এফডিএ) এর ছাড়পত্র পাওয়ার পর ক্লিনিক্যাল-ট্রায়ালে রয়েছে। রায়ান সাদীর নিউ জার্সির বাড়িতেই এ দম্পতি বর্তমানে রয়েছেন।

৫০ বছরের বাংলাদেশ প্রসঙ্গে অভিমত জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা দম্পতি সবাইকে আরও আন্তরিকতা নিয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের অনুরোধ জানান।

অন্যের সমালোচনার বদলে দেশের জন্য নিজের করণীয় এবং দায়িত্ব পালনের ব্যাপারটি প্রত্যেকের বিবেচনায় রাখা দরকার বলে উল্লেখ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা বনি আমিন এবং আকতার বানু।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!