কোভিড-১৯ আক্রান্ত ৭ই মার্চের ভাষণ রেকর্ডকারী প্রবাসী নাসার ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি আবেদন

যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফোন কল আসলো। নাম উঠেছে- নাসার ভাই। তখন জার্মানিতে বৃহস্পতিবার বিকাল। নাসার ভাইয়ের পুরো নাম নাসার আহমেদ চৌধুরী। কল ধরতেই বুঝলাম- ভাই নয়, ভাবি ফোন করেছেন। তিনি জানালেন, তারা দুজনেই কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আছেন।

মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দ্দার, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 July 2020, 02:31 PM
Updated : 27 July 2020, 10:40 AM

ভাবির ফুসফুসে জল জমেছে। তিনি হাসপাতালের তৃতীয় তলায় আর ভাই আছেন চতুর্থ তলায়। আমাকে বললেন, আমি যেন দেশবাসীকে তাদের জন্য শুভকামনা করার অনুরোধ জানাই। তার কাছে জানলাম যে, তাদের দুজনকে আলাদা তো রেখেছেই এবং একজনকে আরেকজনের সাথে দেখা করতেও দিচ্ছেনা।

এই খবর পাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। তাৎক্ষণিকভাবে কোন কিছু লেখার মত শক্তি আমি পাচ্ছিলাম না। এজন্য একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসলাম। কিন্তু আমার উদ্বিগ্নতা কাটছিল না মনটা খুবই খারাপ হয়েছিল। এর আগে মিসেস চৌধুরীর সঙ্গে আমার টেলিফোনে সামান্য কিছু কথা হলেও তিনি আমাকে কখনো ফোন করেননি, এই প্রথম। এবং এই ব্যাপারটাই আমার উদ্বিগ্নতার কারণ। হয়তো পরিস্থিতি ,এতোটাই খারাপ যে তিনি আমাকে ফোন করেছেন।

এই দম্পতি আমার খুবই শ্রদ্ধার। তাদের কাছ থেকে কোনও টেলিফোন পাওয়া আমার মত মানুষের জন্য সৌভাগ্যের চেয়েও বেশি। আমি বাইরে থেকে ঘোরাঘুরি করে এসে কিছু লিখব চিন্তা করছি, ঠিক তখন আরেকবার ফোন আসলো। ধরে দেখি নাসার ভাই নিজেই কথা বলছেন। তাঁকে খুব দুর্বল মনে হচ্ছিল। তিনি অবশ্য প্রথমে আমাকে অসুস্থতার কথা কিছু বলেন নাই।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে, ভাই আপনি এখন কেমন বোধ করছেন?

তিনি জানালেন- এখন একটু ভালো। চারদিন ধরে তিনি ফ্লোরিডার ওসসিওলা রিজিওনাল মেডিকেল সেন্টারের কক্ষ নম্বর বি ৪২৫ এ আছেন। 

আমি যখন তাঁকে বললাম আপনি তো হাসপাতালের চারতলায় আছেন আর ভাবি তিনতলায় উনি আশ্চর্য হয়ে গেছেন। জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কীভাবে জানলাম? তাকে বললাম যে, ভাবি আমাকে ফোন করেছিলেন।

তিনি আমাকে বললেন, মমতাজুল তুমি তো আমার জন্য অনেক করেছো। আমি সাথে সাথে তার কথার প্রতিবাদ করে বিনয়ের সঙ্গে বলেছি, ‘ভাই আপনার জন্য আমি কিছুই করিনি। আমার একটা দায়িত্ব ছিল জাতির প্রতি। আপনার সঙ্গে আমি কিছু কথা বলেছি এবং যে ব্যাপারগুলো ঐতিহাসিক সত্য সেটা আমার লেখায় তুলে ধরেছি মাত্র। আপনার মত একজন মানুষের যা পাওয়া উচিত তার কিছুই আমি বা আমরা করতে পারিনি। আমি যা করেছি সেটা হয়তো আমার স্বার্থেই আমার লেখার স্বার্থে।’

যাহোক নাসার আহমেদ খুবই বিনয়ী মানুষ। আমি সামনাসামনি তাকে কোনদিন দেখিনি, তবে টেলিফোনে তার বিনয়ী আচরণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। অসম্ভব নিরহংকারী মানুষ তিনি, কখনও নিজেকে জাহির করেন না। যে স্নেহের পরশ আমি পেয়েছি তার কাছ থেকে তা জীবনে ভুলবো না।

যখন তার সঙ্গে কথা বলি তাকে ভীত বা অসহায় মনে হয়নি। তবে তিনি আশা করছেন, কিছু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন কিভাবে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে? তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং তার সব কাগজপত্র আছে। তবে সরকারি সুবিধাগুলো এখনো তিনি পান না। এ ব্যাপারে এর আগেও আমি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে লিখেছি ৭ই মার্চ ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে “৭ই মার্চের পূর্ণাঙ্গ ভাষণ কি হারিয়ে গেছে?” ও “স্বীকৃতি পাক ৭ই মার্চ ভাষণের ধারক নাসার আহমেদ চৌধুরীর দু:সাহস” নিবন্ধ দুটিতে। আর আমার গ্রন্থ ‘৭ই মার্চের ভাষণ: জানা অজানা তথ্য’ সেখানেও বিস্তারিত তার সম্বন্ধে উল্লেখ করেছি।

একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে যে সুবিধাগুলো তার পাওয়া উচিৎ তার কিছুই তিনি পান না। এই বয়সেও প্রবাসে তাকে কাজ করতে হয়। তিনি রাষ্ট্রের একজন সম্মানিত জ্যেষ্ঠ নাগরিক। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদান অবিস্মরণীয়।

শুধু তাই না তার পরিবারের অন্যদের অবদানও অপরিসীম মুক্তিযুদ্ধে। তার চাচা হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে জাতীয় সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। স্বাধীনতার যুদ্ধে তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

নাসার চৌধুরীর দুঃসাহসিক অবদানের কারণেই জাতি ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ রেডিওতে শুনতে পেরেছিল। তৎকালীন সময়ে রেডিও সর্বাধিক জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল জনগণের কাছে খবর খবর পৌঁছানোর জন্য। আর কেউ অস্বীকার করতে পারবে না বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জনগণকে ঝাঁপিয়ে পড়তে ৭ই মার্চের ভাষণ সর্বোচ্চ উদ্দীপকের ভূমিকা পালন করেছিল। ৭ই মার্চের ভাষণ ছাড়া দেশ স্বাধীন হতো না কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আর সেই ভাষণ ধারণে ও প্রচারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা যে ব্যক্তি পালন করেছিলেন তিনি হলেন নাসার আহমেদ চৌধুরী। আজ হোক কাল হোক প্রত্যেকটা মানুষকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমরা জানি না কে কখন বিদায় নেব। তবে কিছু কিছু মানুষের কাছে আমাদের বড় ধরনের ঋণ থাকে বা আছে। যা কোন কিছুর মাধ্যমে শোধ করা সম্ভব না। তবে এইসব মানুষকে যোগ্য সম্মানটা প্রদান করা দেশ জাতি এবং সরকারের কর্তব্য। আমরা যদি আজকে সেই সম্মান এবং সম্মানী প্রদানে ব্যর্থ হয় তাহলে জাতি এবং রাষ্ট্র সরকার চিরদিনের জন্য দায়ী হয়ে থাকবে, সেই সকল বীরদের কাছে। নাসার আহমেদ চৌধুরী সেই সকল বীরদের অন্যতম।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে দুটো নিবন্ধে আমি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। নাসার চৌধুরীকে তার যোগ্য সম্মান প্রদানের জন্য। কিন্তু আজ পর্যন্ত সরকারের কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী তার সাথে যোগাযোগ করেননি এবং কোনো স্বীকৃতি তাকে দেওয়া হয়নি। আমি আজকে নাসার ভাইয়ের সাথে কথা বলে বুঝেছি তার সাহায্যের প্রয়োজন। তবে তিনি সরাসরি আমাকে কোন কিছু বলেননি। শুধু জিজ্ঞাসা করেছেন সরকারের কিভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়? তার মুক্তিযোদ্ধার ভাতা বা কোন কিছুই তিনি পান না। আমি তাকে জানালাম- আমি কেবল আপনার জন্য লিখতে পারি এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাথে আমার যোগাযোগ আছে কথা বলে দেখতে পারি।

আমাদের এই পরম সম্মানীয় জ্যেষ্ঠ নাগরিক মুক্তিযুদ্ধে যার অবদান অপরিসীম, তিনি প্রবাসী এবং হাসপাতালে শয্যাশায়ী। তার সার্বিক খোঁজখবর নেওয়ার দায়িত্ব যতটা ধারণা করি বর্তমান পরিস্থিতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যে মন্ত্রী আছেন তিনি নাসার আহমেদ চৌধুরী সাহেবের এলাকার মানুষ। আমার বিশ্বাস পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশ্চয়ই তাকে চেনেন এবং জানেন। তার প্রতি অনুরোধ থাকবে তিনি যথাযথ এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন জনাব চৌধুরীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে। আর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী জনাব আ ক ম মোজাম্মেল হকের কাছে অনুরোধ থাকবে তিনি দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন যাতে নাসার আহমেদ চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারী সুবিধাগুলো পান।

সর্বোপরি মানবতার প্রতীক, গণতন্ত্রের প্রতীক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আবেদন থাকবে, মুক্তিযুদ্ধের এই দুঃসাহসী বীর যেন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চিকিৎসাসহ সকল সুবিধাদি পান সে ব্যবস্থা নেবেন। নাসার আহমেদ চৌধুরী অবহেলিত হলে জাতি দায় এড়াতে পারবে না। জাতীর সংকীর্ণতার প্রকাশ পাবে।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!