নিউ ইয়র্কে করোনাভাইরাসে প্রাণ হারানো এক বাংলাদেশির আখ্যান

কোভিড-১৯ মহামারীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শহরের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক; সেখানে এক লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত এবং ১৩ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 April 2020, 02:48 PM
Updated : 20 April 2020, 05:30 PM

যাদের প্রাণ গেছে, তাদের মধ্যে অর্ধশতাধিক বাংলাদেশিও রয়েছেন। তাদেরই একজনের জীবনের গল্প শুনিয়েছেন সিএনএনের কলামনিস্ট জন অ্যাভলন।   

তিনি লিখেছেন, এখন নিউ ইয়র্কে এক দিনে যত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, তা সংখ্যায় গত এক বছরের সব হত্যাকাণ্ডের চেয়ে বেশি। নাইন-ইলেভেনের হামলায় নিহতদের চার গুণের বেশি মানুষ ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসে মারা গেছে।  

“এসব সংখ্যার প্রত্যেকের নাম আছে, তারা পরিবার রেখে গেছেন, যারা তাদের স্মরণ করছে। অনেক গল্প তারা পেছেনে ফেলে গেছেন, যা বলা দরকার।”

এ রকমই একটি গল্প রয়েছে বাংলাদেশি মোহাম্মদ জাফরের। ৫৬ বছর বয়সী এই অভিবাসী বাবা ট্যাক্সি চালিয়ে নিজের সন্তানদের যুক্তরাষ্ট্রের সেরা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আমেরিকান স্বপ্ন পূরণে সম্ভাব্য সব কিছু তিনি করেছেন।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ১ এপ্রিল মারা যান জাফর। নিউ ইয়র্কের ব্রঙ্কসের গান হিল সড়কের কাছে একটি অ্যাপার্টমেন্টে তিন সন্তানকে রেখে গেছেন তিনি।

জাফরের প্রতিদিনের কাজ শুরু হত মেয়ে সাবিহাকে ম্যানহটনের ট্রিনিটি স্কুলে নামিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। নামকরা ওই স্কুলের সেকেন্ড গ্রেডের ছাত্রী সে। সারা দিন ভাড়া টেনে আবার স্কুল ছুটির পর মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফিরতেন জাফর।

তার এই পরিশ্রমের সুফলও আসছিল। বড় ছেলে মাহতাব শিহাব হার্ভার্ডে পড়েছে। বড় মেয়ে সাবিহাও সেই পথেই যাচ্ছিল।

করোনাভাইরাসের মহামারীতে হারিয়ে ফেলা বাবার সংগ্রামের গল্প মাহতাব শুনিয়েছেন জন অ্যাভলনকে।

“উনি সারা জীবন কাজ করে গেছেন, আমাদের অনেক দিয়ে গেছেন। উনার খুব ভালো কোনো চাকরি বা কাজ ছিল না। কখনও ম্যাকডোনাল্ডসে কাজ করেছেন, খাবার ডেলিভারি দিতেন। উনি ক্যাব চালিয়েছেন। কিন্তু সব সময় চাইতেন পরিবারের, এখানে আমরা যারা আছি এবং বাংলাদেশে যারা আছে, কারও যেন অভাব না থাকে। সেই চাওয়া পূরণ করতে গিয়ে তিনি নিজের কথা ভাবেননি।”

অ্যাভলন লিখেছেন, আমেরিকায় প্রায় প্রতিটি অভিবাসীর জীবন এরকম সংগ্রামের এক একটি গল্প।

“তারা এখানে আসেন কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে একটু উন্নততর জীবন গড়তে, যাতে ছেলে-মেয়েদের ভালো সুযোগ-সুবিধা দিতে পারেন। এবং প্রায়ই তারা আমেরিকার গুণগান করেন আমেরিকানদের চেয়েও বেশি।”

মোহাম্মদ জাফরের আমেরিকার জীবন শুরু হয় ১৯৯১ সালে। বাংলাদেশ থেকে এসে প্রথমে তিনি কুইনসের জ্যাকসন হাইটসের একটি জনাকীর্ণ অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন। টাকা বাঁচিয়ে দেশে বাবা-মাকে পাঠাতেন।

পরে দেশে ফিরে মাহমুদা খাতুনকে বিয়ে করেন। নিউ ইয়র্কে ফেরার আগে তাদের প্রথম সন্তান মাহবুব রবিনের জন্ম হয়।

মাহতাব শিহাবের জন্ম হয় ২০০০ সালে এলমহার্ট হাসপাতালে। ওই হাসপাতাল এখন নিউ ইয়র্কে করোনাভাইরাস ছড়ানোর অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

বাবাকে স্মরণ করে মাহতাব বলেন, “তিনি চাইতেন আমরা যেন আমেরিকায় থাকার সুবিধাগুলো বুঝতে পারি এবং সেজন্য কতটা কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত তা যেন মাথায় রখি।

“তিনি চাইতেন এখানে যত সুযোগ-সুবিধা আছে তা যেন আমরা কাজে লাগাই। তার অংশ হিসেবেই তার চাওয়া ছিল আমাদের লেখাপড়াটা যেন ভালো হয়।”

জাফরের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শুরু হয় ব্রঙ্কসের একটি প্রাইমারি স্কুলে। পরে তিনি প্রিপ ফর প্রিপ নামের একটি অলাভজনক রিক্রুটমেন্ট প্রোগ্রামের কথা জানতে পারেন, যার মাধ্যমে নিউ ইয়র্কের অশেতাঙ্গ ছেলে-মেয়েদের খ্যাতনামা ও ব্যয়বহুল বেসরকারি স্কুলে পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। সপ্তম গ্রেডে উঠে মাহতাব ট্রিনিটি স্কুলে ভর্তি হন।

২০১৬ সালে ক্যান্সারে মাহতাবের মা মাহমুদার মৃত্যু এ পরিবারের জন্য বিরাট ধাক্কা হয়ে আসে। পরের বছর মাহতাব ভর্তি হন হার্ভার্ডে, একই বছর ছোট্ট সাবিহার ট্রিনিটি স্কুলে কিন্ডারগার্টেন শুরু হয়।

নিজেদের নিয়ে গর্ব ছিল তাদের; সামনে সুন্দর ভবিষ্যতের হাতছানি। কিন্তু আবার এল বিষাদের পর্ব।

করোনাভাইরাসের বিস্তার বাড়তে থাকায় মার্চে হার্ভার্ড বন্ধ হয়ে গেলে বাসায় ফেরেন মাহতাব। ততক্ষণে তার বাবা সেলফ-কোয়ারেন্টিনে। ট্যাক্সিচালকের চাকরিটা ঠিক রাখতে একবারই তিনি বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন।

কয়েক দিন ধরে হালকা জ্বরের পর জাফরের তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ছেলে-মেয়েরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।

এক সপ্তাহ সেখানে ভেন্টিলেশনে রাখা হয় জাফরকে। তাতে অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল বলেও মনে হয়েছিল। কিন্তু তার মৃত্যু হল।

পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশে জীবন বদলের সংগ্রামে লিপ্ত এক বাংলাদেশি অভিবাসীর জীবন থেমে গেলে ৫৬ বছর বয়সে।

কিন্তু হতাশার মধ্যেও জীবন আশার আলো দেখায়। 

জন অ্যাভলন লিখেছেন, জাফরের মৃত্যুর খবর পেয়ে ছুটে আসেন মাহতাবের বন্ধুরা। শুরু হয় ওই পরিবারের জন্য সাহায্য সংগ্রহের পর্ব।     

যেসব পেশায় জাফর কাজ করেছেন জীবনের বিভিন্ন সময়ে, সব কমিউনিটি থেকেই চাঁদা এলো। কারও চাঁদা কম, কারও বেশি। ট্রিনিটি, প্রিপ ফর প্রিপ, হার্ভার্ডও বাদ গেল না।   

মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে জাফরের সন্তানদের জন্য উঠে গেল আড়াই লাখ ডলার!

জন অ্যাভলন লিখেছেন, শত কষ্টের মধ্যেও ওই পরিবার একটা ‘লাইফলাইন’ পেল। সমাজের ওপর তাদের আস্থাটাও টিকে গেল।

“সঙ্কটের সময় যখন মানুষ মিলিত হয়, সেটাই সবচেয়ে ভালো ফল দেয়; এমনকি সেই সময়ও, যখন বেঁচে থাকার জন্যই মানুষকে আলাদা থাকতে হচ্ছে।”

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!