কায়রোর রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়ানো দুই শিশুর গল্প

কোন এক সন্ধ্যা, হাঁটছিলাম এখানকার স্থানীয় এক বাজারের পথ ধরে। যখন গণমানুষের প্রতিদিনের কোলাহলময় জীবন অনেকটা শান্ত। কোন হৈচৈ কিংবা চিৎকার-চেঁচামেচি নেই। প্রায় জনমানবশূন্য পথ-প্রান্তর।

মোহাম্মাদ আবু জাবের, মিশর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 April 2020, 04:20 AM
Updated : 10 April 2020, 04:21 AM

রাস্তার ধারে ধারে থাকা দোকানপাটগুলো ক্রেতাশূন্য। বিক্রেতারা অলস জীবন পার করছে। কখনও দু-একজন উঁকিঝুঁকি দিয়ে আবার চলে যাচ্ছে। যে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম, বাজার তার একেবারে শেষপ্রান্তে। তবে দূর বেশি নয়। মিনিট পাঁচেকের পথ।

আমি হাঁটছি বাজারে গিয়ে কিছু কেনাকাটার উদ্দেশ্যে। অবস্থা এমন যে বাজারে গিয়ে কিছু পাব কিনা তা নিয়ে বেশ সন্দিহান আছি। এর মধ্যে হঠাৎ দেখলাম, দুটো শিশু, বয়স সাত কিংবা আট হবে। পরনে পরিষ্কার জামা। চুলগুলো সাজানো, গোছানো। চেহারা যেমন লাবণ্যময়ী, সুন্দর তেমন আকর্ষণীয়ও বটে। একবার দেখলে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। এছাড়া ওদের দেহের অনাবৃত অংশগুলোও বেশ পরিচ্ছন্ন। মনে হচ্ছে যেন মাত্রই অযু-গোসল সেরে এসেছে। দু’পায়ে স্যান্ডেল।

সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছিল কোন স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান হবে এরা। কিন্তু একটু পর যা দেখলাম তাতে এই বিশ্বাসটুকু আর রইল না। আমি দেখি, ওদের দুজনের হাতে বেশ কিছু লিফলেট। এগুলোতে পবিত্র কুরআনুল কারিমের সূরা লিখা। এগুলো হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে বাজারের দিকে এগিয়ে আসছে। একটু পর দেখি, ওরা জনমানুষের দ্বারস্থ হচ্ছে। এগুলোর বিনিময়ে দু’একটি টাকা চেয়ে চেয়ে নিচ্ছে।

ঘটনাটি কায়রোর, আরো মাস দুয়েক আগের। আমি ব্যাপারটিতে খুব আশাহত হলাম। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। জীবনে বোধহয় এমন পথশিশু প্রথম দেখলাম, যাদেরকে শুরুতে দরিদ্র বলে মনে হয়নি। যেখানে সাধারণত পথকলিরা এমন হয় না, জীর্ণশীর্ণ থাকে ওদের পোশাক। মাথার চুলগুলো থাকে আরো এলোমেলো। পুরো শরীর হয় ধুলোমাখা।

তাতে যে কারো চিনতে তেমন কোন অসুবিধে হয় না। সেখানে এদের ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রমটুকু দেখলাম। কতো সুন্দর ফুটফুটে দুটো শিশু!  কী নিষ্পাপ ওদের জীবন! আজ মাতৃকোড়েই না ওদের থাকার কথা ছিল! কিংবা অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলায় থাকত মত্ত! কিন্তু এসবের আজ কোনটিই হলো না। এটাকে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বলে, আর বলে নিয়তির বিষণ্ণতা।

ওরা আজ সামান্য ফুল-রুটির (মিশরের মানুষের অন্যতম প্রিয় খাবার) জন্য জনে জনে দ্বারস্থ হচ্ছে! মানুষে মানুষে হাত পাতছে! শুধু তাই নয়, এ বয়সেই পেটের দায়ে ওরা ওদের সামর্থের সবটুকু ঢেলে দিয়েছে। এছাড়া আর কী-ই বা করতে পারত ওরা?

আধুনিক পৃথিবীতে কত বিচিত্র পেশার মানুষ বসবাস করে। কেউ করে চাকরি। কেউ করে ব্যবসা। কেউ বা অন্যকিছু। তবে এসব কিছু যে পেটের দায়ে বৈ ভিন্ন কিছুর জন্যে নয়, তা প্রতিটি দৃষ্টিমান মানুষই অনুধাবন করতে পারেন। তাছাড়া এসব পেশায় নিয়োজিত হবার নিদৃষ্ট কিছু বয়সসীমা বোধ করি থাকে।

অনেকে আবার দারিদ্র্যের কষাঘাতে ছোটবেলা থেকেই নানা কাজে নিয়োজিত হয়। যাকে আমরা শিশুশ্রম বলি। তবে তাও বয়সের নির্দিষ্ট গণ্ডি পেরুবার পর। যখন মুখ দিয়ে ভালোভাবে কথা ফুটে বা কিছু প্রাথমিক বিদ্যা অর্জন করে। ফলত জীবনের এই এক অভিজ্ঞতা! এই এক দর্শন! এমন কিছু অবুঝ শিশুকে দেখলাম, পেটের দায়ে পেশায় হাত দিতে, যারা নিতান্তই ছোট। সবে হাঁটতে শিখেছে।

তবে এর চেয়েও দুঃখের যে বিষয়টিতা হলো, শিশু দুটো এর কাছে বা ওর কাছে যাচ্ছে। সবার নিকটেই ছোট ছোট হাতগুলো দিয়ে লিফলেট বিক্রির চেষ্টা করছে। একজন যখন তাড়িয়ে দিচ্ছে তো ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকছে কিছুক্ষণ। তারপর হন্য হয়ে ছুটছে অন্য এক ব্যক্তির দিকে। সেও যখন কিছু কিনছে না, তখন ওরা শুধু কাকুতি-মিনতি করছে। যেন একটি হলেও লিফলেট তিনি খরিদ করেন। তার কোনই সাড়া-শব্দ যখন নেই, তখন ওরা আরেকবার জোর আবদার করল।

এ পর্যায়ে ওদের ছোট্ট কানে শুনতে হলো একটি বিশ্রি  কর্কশ ধমক। কাজেই এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। অতি অবুঝ শিশু হলেও এ বাস্তবতা ওরা অনুধাবন করতে পারল। এজন্য ওদেরকে অবশ্য ধন্যবাদ দিতে হয়। নইলে পিঠের উপর পড়তে পারতো কিছু চড়-থাপ্পড়। যা তাদের সহ্য-ক্ষমতার বাইরে ছিল। যাক, হয়তো বিধাতাই আপন কুদরতে ওদের রক্ষা করে চলছেন।

নিরুপায় হয়ে তার কাছ থেকে সরে এসে দৌড়ালো অদূরে বসে থাকা অপর এক ব্যক্তির দিকে। মনে ছোট্ট আশা, যেন একটি হলেও লিফলেট বিক্রি করা যায়। যার মূল্য ১০ টাকা। এই সামান্য টাকা দিয়ে কী খাবে ওরা! কিন্তু ছোট্ট মনে একটু হলেও সান্ত্বনা খুঁজে পাবে। এই একমাত্র চাওয়া। তার কাছে গিয়ে তেমন কোন কথা মুখে ফুটল না। কেবল হাত বাড়িয়ে ইাশারা করল। যার অর্থ ‘একটি ক্রয় করুন’।

লোকটা হাত ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিতে চাইল। কিন্তু ওরা যে নাছোড়বান্দা! আজ অন্তত একটি হলেও যে নিতেই হবে! ক্ষিধের কষ্ট যে আর সইছে না! ছোট্ট এই জীবনে আর কতই না দুঃখ-যাতনা সইবে ওরা! এখন যৎসামান্য কিছু দিয়ে হলেও কেবল পেটের জ্বালাটা নিবারণ করা। অবুঝ শিশু এসব আর সইবে কত? কিন্তু কে শোনে কার কথা? চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। ওরা যখন বারবার পীড়াপীড়ি করছিল, লোকটা জোরে ঘাড় ধাক্কা দিল। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ওদের একজন। অন্যজন হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।

পাঠক! এরপর কি হল, সেটি না হয় আর লিখলাম না। বিবেকবোধ সম্পন্ন মাত্র প্রতিপাদ্য বিষয় এইটুকু থেকেই খুঁজে নেবেন। আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থায় চারদিকে যখন মানবতার অধিকার নিয়ে হৈচৈ রৈ রৈ, সর্বত্রই শোনা যায় অধিকারের মুহুর্মুহু শ্লোগান, আর মানবাধিকার নিয়ে বিপ্লবী ধ্বনি। এছাড়া এ নিয়ে গড়ে উঠেছে কত সংস্থা, কত সংঘ, কত কমিশন। বিশ্বজুড়ে রয়েছে আন্তর্জাতিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। ওয়ার্ড হেলথ অর্গানাইজেশান। নামে-বেনামে আরও কত কিছু! তথাপি এ জাতীয় পথশিশুদের অধিকার নিয়ে কোন কথা হয় না। কেউ কিছু বলে না, লিখে না। মিডিয়াতেও আসে না। কোন সভ্য সমাজেও ওদেরকে নিয়ে কেউ মুখ খোলে না। কাজেই ওরা সুবিধাবঞ্চিতই রয়ে গেল।

সব দেশে, সব সমাজে ওদের এ এক করুণ পরিণতই বিরাজমান। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর মানুষের স্বচ্ছলতার প্রশংসা করতে হয়। একটি সময় ছিল, যখন মানুষের একবেলার আহারের ব্যবস্থা করতে কত কত বেগ পোহাতে হতো। তখন ছিল না তেমন কোন বাসস্থান কিংবা পরিধান করার মতো কোন পোশাক।

সে অনেক আগের কথা। সে দিন এখন আর নেই। গত হয়েছে বহুকাল হলো। এখন মানুষের অর্থবিত্তের অভাব নেই। যেখানে সেখানে অবলীলায় টাকা খরচ করে মদ-গাঁজা, জুয়ার আসর থেকে নাইট ক্লাব, সর্বত্রই মিলিয়ন মিলিয়ন টাকার ছড়াছড়ি।

কিন্তু এসব পথশিশুরা সেই অন্ধকার যুগেই রয়ে গেল। দিনের পর দিন যায়, কিন্তু ওদের এক মুঠো খাবার জোটে না। অনাহারে অর্ধাহারেই কাটে ওদের দিন-রাত। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সবকিছুই কাটে ওদের রাস্তার ধারে কিংবা ফুটপাতে। গায়ে জড়ানোর মতো একমাত্র সম্বল-ছেঁড়াফাড়া কোন পোশাক বা পুরাতন জীর্ণশীর্ণ একটি জামা। তবে আর কতদিন চলবে এমন? কতদিন এভাবে ক্ষুত-পিপাসায় কাতর থাকবে ওরা? বিনিদ্র রজনী যাপন করবে আর কতকাল? ওদের ভাগ্যাকাশের তারা কি আদৌ জ্বলবে না? পৃথিবী থেকে মানবতা মনুষ্যত্ব দূর হলো কেন?

লেখক:  প্রবাসী শিক্ষার্থী, আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!