ভ্রমণকাহিনী: কোর্সিকার কোলে

ভ্রমণ করতে গিয়েছিলাম, ভূমধ্যসাগরের নীল জলে সারি সারি পর্বতমালাকে বুকে ধারণ করে স্বরূপে দাঁড়িয়ে থাকা অপূর্ব সুন্দরী দ্বীপ কোর্সিকাতে।

ঝিলমিল খান, ফ্রান্স থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Dec 2019, 08:57 AM
Updated : 11 Dec 2019, 08:57 AM

দেখে মনে হবে সাগরের বুকে চিরে উঠা কোন তন্বী মৎস্যকুমারী তার সবুজ চুল এলিয়ে গায়ে রোদ মাখাতে বসেছে। তার পায়ে এসে বেলায় বেলায় পূজো দিয়ে যাচ্ছে ভূমধ্যসাগরের নীল জল। তার সবুজ চুলে দোলা দিয়ে যাচ্ছে নোনা জল থেকে ভেসে আসা ভারি বাতাস।

ভূমধ্যসাগরের অপূর্ব সুন্দরী দ্বীপ কোর্সিকা ফ্রান্সের অধিকারে থাকা ১৮টি প্রদেশের মধ্য একটি। ফ্রান্সের মূল ভূখণ্ড থেকে দক্ষিণ-পূর্বে এর অবস্থান। এর পশ্চিম দিকে আছে হেলিয়ান পেনিসালা এবং খুব কাছের দ্বীপ হচ্ছে ইটালির নর্থ সারডিনিয়া। সিসিলও এদিক থেকে কাছেই। কোর্সিকার দুই-তৃতীয়াংশ জুড়েই রয়েছে পাহাড়।

কোর্সিকার রাজধানী আজাস্সিও এই দ্বীপের সবচেয়ে বড় শহর এবং অফিসিয়াল ভাষা ফ্রেঞ্চ। এর প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং কোর্সিকা স্থানীয় প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন জঁ গি তাতামনি। আয়তন ৮ হাজার ৮৬০ বর্গকিলোমিটার ও জনসংখ্যা ৩ লাখ ৩০ হাজার, ২০১৭ পরিসংখ্যান অনুসারে।

কোর্সিকার খ্যাতি বিশ্বজুড়ে, তবে যে তিনটি কারণে কোর্সিকা জনপ্রিয় বা বিখ্যাত তা হলো- ১. কোর্সিকায় আছে অসংখ্য অপূর্ব সুন্দর সৈকত। যার পানি কাঁচের মতো স্বচ্ছ এবং পানির রং কখনও নীল, কখনও সবুজ। ২. দ্বীপের মাঝখানটা জুড়ে আছে পাহাড়, পর্বতের সারি। ইউরোপের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত এই কোর্সিকাতে অবস্থিত। ৩. আর কোর্সিকা হচ্ছে মহাপুরুষ নেপোলিয়ন বোনাপার্টের জন্মস্থান। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট জন্মগ্রহণ করেন ১৫ অগাস্ট ১৭৬৯ সালে আজাস্সিওতে। মৃত্যুবরণ করেন ১৮২১ সালের ৫ মে, ইংল্যান্ডে। নেপোলিয়ন বোনাপার্টের পারিবারিক বাড়িটিই বর্তমানে কোর্সিকার জাতীয় জাদুঘর।

ফ্রান্সের মূল ভূখণ্ড থেকে দুইভাবে কোর্সিকা পৌঁছানো যায়। ১. পানিপথে এবং ২. আকাশপথে। আমরা কোর্সিকার উদ্দেশ্য যাত্রা করতে বেছে নিয়েছিলাম পানিপথকে। সেই কবে টাইটানিক মুভি দেখে ভাবতাম এত বড় জাহাজ কি সত্যই বানাবো সম্ভব! আজ এত বছর পরে যখন সেই সুযোগ নাগালের মধ্য এলো, আমি একটুও বিলম্ব করিনি তা সদ্ব্যবহার করতে। বেছে নিয়েছি এই যুগের টাইটানিক জাহাজকে, ভূমধ্যসাগর ভ্রমণের জন্য।

জাহাজ ভ্রমণের আরেকটি বড় সুবিধা হলো গাড়িসহ আমরা পৌঁছে পারবো কোর্সিকাতে। নিজের গাড়ি নিয়ে গেলে যেটা সুবিধা পাওয়া যায়, সেটা হলো কোর্সিকায় পৌঁছে আর গাড়ি ভাড়া করতে হচ্ছে না, তাই পুরো ভ্রমণের খরচও কমে আসবে।

কোর্সিকা যাওয়ার দিন আমরা সকালের সময়টাকে বেছে নিয়েছিলাম, যাতে সাগরের সৌন্দর্য প্রাণ ভরে উপভোগ করতে পারি। আমাদের কোর্সিকা পৌঁছাতে সময় লাগবে ৯ ঘণ্টা ৩০ মিনিট। আমরা ভোর ৬টায় চেকইন করলাম এবং জাহাজ ভূমধ্যসাগরের নীল জল চিরে চলতে শুরু করলো সকাল ৮টায়। টানটান উত্তেজনা, বন্দরের ব্যস্ততা, সাগরের বিশালতা আর লোনা পানির ঘ্রাণ, সব মিলিয়ে আমাকে পেয়ে বসলো সি-সিকনেসে। ১২ তলার এই জাহাজে আমাদের রুম ছিলো ৮তলায়। সুন্দরী কেবিন-ক্রুর সহযোগিতায় দ্রুত রুমে পৌঁছে বমি ভাবটা কিছুটা কমলো বললে ভুল হবে, একেবারে নাই হয়ে গেলো।

রুমের  অবস্থান এবং সৌন্দর্যে আমরা অভিভূত। এই জাহাজ ভ্রমণ করতে হলে যে রুম বুক করতেই হবে এমন নয়, রুম বুক করা ছাড়াও আপনি ভ্রমণ করতে পারবেন। লাক্সজেরিয়াস, প্রথম শ্রেণি, দ্বিতীয় শ্রেণি এবং শ্রেণি ছাড়া রুমের মধ্য থেকে আপনি বেছে নিতে পারবেন আপনার পছন্দের রুম। আমাদের দলের সদস্যসংখ্যা যেহেতু বেশি এবং তিনটা বাচ্চা আছে, তাই আমরা বেছে নিয়েছিলাম দুই রুমের একটা স্যুইট।

রুমে ঢুকেই আমরা কিছুটা বিশ্রাম এবং সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। তারপর আমরা দেখতে বসলাম সাগরকে। জাহাজের ক্যপ্টেন সাহেবের রুমের ঠিক নিচের রুম দুটিই আমাদের। দুই রুমের মাঝারি মাপের দুটো জানালা আছে এবং তাই দিয়ে আমি গোগ্রাসে গিলছি সাগরকে, এত বেশি নীল, এত বেশি নীল যে সহ্য করা যায় না। নীল জলে কয়েকবার ডলফিন দম্পতিকেও দেখেছি জলকেলি খেলছে।

দুপুরের খাবারের পর বের হলাম জাহাজটাকে ঘুরে দেখতে। যদিও আমার ছোট ভাই এর মধ্যে কয়েক চক্কর দিয়ে, জাহাজের কোন তলায় কী আছে সব হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। এটাকে আমার ঠিক জাহাজ মনে হয়নি, আমার মনে হয়েছে বিশাল একটা শপিংমল, যেখানে আবাসিক হোটেলও রয়েছে। এখানে আছে প্যানোরোমিক বার। যেখানে বসে নীল সাগরের বিশালতা দেখে আপনি ভাববেন, প্রথমত আমি তোমাকে ভাবছি, দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে ভাবছি এবং শেষ পর্যন্ত আমি তোমাকেই ভাবছি। এখানে আরও আছে বেশ কয়েকটা রেস্টুরেন্ট, স্পা ও খেলাধুলার জায়গা। তো আমরা এই ভাসমান শহরে করে নীল দরিয়া পারি দিয়ে বিকেলে এসে পৌঁছলাম সুন্দরী কোর্সিকায়।

কোর্সিকাতে দুইটি বন্দর আছে। ১. বাস্তিয়া ও ২. আজাসসিও। আমরা নেমেছি বাস্তিয়াতে। ৮ দিনের জন্য আমরা যে বাড়িটি ভাড়া করেছিলাম, বাস্তিয়া থেকে সেখানে যেতে ৩০ মিনিটের ড্রাইভ, গ্রামটার নাম সান্তালুসিয়া দুমরিয়ানি। আমরা প্রথমেই আগামী ক’দিনের জন্য খাবার কিনে ফেললাম। তারপর আমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। যেদিক দিয়েই গাড়ি চালাইনা কেনো, একদিকে পাহাড় আর একদিকে সাগর আমাদের সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে। যথারীতি আমি মুগ্ধ অভিযাত্রী দেখছি প্রাণভরে।

প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তেই আমার জন্য অপেক্ষা করছে চমক। আমরা আমাদের ভাড়া করা বাড়িটিতে পৌঁছালাম। ফরাসিদের বাড়িগুলো যেমন হয়, এই বাড়িটিও তেমনি। তিন বেডরুমের একটা বাড়ি, তবে চমকটা হচ্ছে আমাদের বাড়িটি থেকে মাত্র দুই মিনিট হাঁটলেই সৈকত। আমার বরের প্রতি আবেগ আবার উথলে উঠলো। সৈকতের কোলঘেষা বাড়ি, তেমন একটা বাড়ির রাত্রিযাপনের শখ আমার অনেকদিনের। ওই যে প্রথম যৌবনে মাসুদ রানাতে পড়া, রানা আত্মগোপন করে আছে নির্জন দ্বীপে, নিরিবিলি সৈকতের কোন বাড়িতে!

রাতের খাবার শেষে আমরা হাঁটতে বের হলাম। উদ্দেশ্য ভরা পূর্নিমায় সমুদ্র দেখবো। ও হ্যাঁ, তখন ঠিক ভরা পূর্ণিমা ছিলো। আমাদের বাড়ি থেকে সমুদ্রে যাওয়ার জন্য ছোট একটা পায়েহাঁটা রাস্তা, ঠিক যেমন রাস্তা দিয়ে মাসুদ রানাও রোজ সৈকতে যেতো। রানার পায়েহাঁটা রাস্তায় ঝোপঝাড় থাকতো আর আমাদের এই পায়ে হাঁটা রাস্তায় ঝোপঝাড়েরর মাঝে আমার ছোট ভাই আবিষ্কার করেছে লাউ গাছ। আমি ভাবছি এই আমি কোথায় এসে পড়লাম! খুশিতে নাচতে নাচতে ছোট ভাই আর বরের উদ্দেশ্য ঘোষণা দিলাম কাল রাতের মেন্যু হবে গরম ভাত, সাথে লাউ পাতা ভর্তা অথবা লাউ শাকভাজি।

ওই যে বললাম মুগ্ধতা আমার পিছু ছাড়ে না, আবারও তার প্রমাণ মিললো। চাঁদের আলোয় সৈকত ধরে হাঁটছি আর হাঁটছি, ঘরে ফেরার কোন তাড়া নেই! ভূমধ্যসাগরের নীল জল চাঁদের আলোয় করছে ঝিকিমিকি, পায়ে এসে  হুমড়ি খেয়ে বলছে কেমন আছো মিতা? এতদিন পরে বুঝি তোমার সময় হলো, আমরা সেই কতকাল ধরে তোমার পথ চেয়ে আছি! কিছুদূর আগাতেই নিরবতা ভেঙে গেলো। আসলে নিরবতা নয়, সমুদ্রের সাথে কথপোকথনে ছন্দপতন ঘটলো। সৈকতে চলছে বিচ-পার্টি, লাইভ মিউজিকসহ তারুণ্যের উন্মাদনা। বয়স আমার ঢের হলো, তবুও মন যে এখনো সবুজ। কিছুক্ষণ লাইভ মিউজিক উপভোগ করে বাড়ির পথ ধরলাম। কাল আবার সকাল সকাল বের হতে হবে, শহর ঘুরে দেখবো যে!

পরের দিন আমরা এই শহর দেখার জন্য বের হলাম। প্রথমেই গেলাম ট্যুরিজম  অফিসে, টুরিস্ট গাইড সংগ্রহের জন্য। অতি বিনয়ী ভদ্রমহিলা অনেকগুলো টুরিস্ট গাইড এবং ম্যাপ ধরিয়ে দিলেন আমাদের। এদিক প্যারিস থেকে আমাদের সাথে এই ট্যুরে যোগ দিতে আসছেন আমাদের প্রিয় এক বড় ভাই। তো তাকে আনতে আমরা এয়ারপোর্ট যাবো দুপুরে। বলে রাখা ভালো কোর্সিকাতে এয়ারপোর্ট আছে দুটি। একটি আজাসসিওতে এবং অপরটি বাস্তিয়ায়।

আমরা যেহেতু বাস্তিয়াতেই আছি, তাই আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে বাস্তিয়া এয়ারপোর্টে যাবো। তার আগে আমাদের হাতে প্রায় ৪ ঘণ্টা সময় আছে। বলে নেওয়া ভালো যে, আমরা সময়ের ব্যবহারে খুবই সচেতন ছিলাম। তাই টুরিস্ট গাইড দেখে আমাদের অবস্থানের কাছেই একটা পাহাড়ি ঝর্না দেখতে গাড়ি ঘোরালাম। ৩ থেক ৪ ঘণ্টা লাগবে ঝর্না দেখে বাস্তিয়া এয়ারপোর্টে যেতে।

ফ্রেঞ্চ সাইকেল ট্যুর যেমন আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে যায়, ঠিক তেমনি আঁকাবাঁকা সরু পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে, সাগরের মায়াবি হাতছানিকে পেছনে ফেলে আমরা চলে এলাম পাহাড়ের চূড়ায়। সুন্দরী ঝর্না দর্শনের আগে, দেখা হয়ে গেলো পাহাড়ি ছাগলের সাথে। এরা দলবেধে চলাচল করে এবং এদের বিশেষত্ব হলো বাহারি শিং। আমিতো ভাবছি ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল দেখেছি। এমন সরু পাহাড়ি রাস্তা, এমন চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ওরা চলাচল করছে, কিন্তু নিচে পড়ে যাচ্ছে না!

হাঁটতে হাঁটতে একটা পাথরের টানেল পার হয়েই ঝর্নার শব্দ পেলাম। পানি পড়ার শব্দ সেতো সবসময়ই অন্যরকম অনুভূতি তৈরি করে। ঝর্নার বেলায়ও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। টুরিস্টরা সবাই নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি রেখে, হেঁটে হেঁটে পাথুরে টানেল পার হয়ে ঝর্নার কাছে আসছে। পানি পড়ার সেই অদ্ভুত ঝিরঝির শব্দ, একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে গ্রাম ছাড়িয়ে নীল সমুদ্র, এটাকেই হয়তো ভূস্বর্গ বলে! অনেকে ঝর্নার পানিতে গিয়ে গোসলও করছে। আমরা যদিও সেই পথ মারাইনি, কারণ আমাদের এখন ছুটতে হবে বাস্তিয়া এয়াপোর্টে।

বন্দর শহর বাস্তিয়া ঘুরে দেখলাম এবং দুপুরের খাবার খেলাম। সাধারণত বন্দর শহরগুলো যেমন হয় বাস্তিয়াও তেমনি। তবে অনেক পুরনো শহর, সাথে আছে লোনাপানির ঘ্রাণ আর বিভিন্ন রঙে রাঙানো বাড়ি। বন্দরে নোঙ্গর করা আছে বিভিন্ন ধরনের জলযান, সামর্থ্য ও রুচি অনুযায়ী আপনি ভাড়া করতে পারবেন। আমার মনে হয়েছে এ যেনো শিল্পীর ক্যানভাসে বিভিন্ন রঙে আঁকা প্রাচীন একটা বন্দরনগরীর পোট্রেট। বাস্তিয়া এয়াপোর্ট গিয়ে প্যারিস থেকে আসা বড় ভাইকে তুলে নিয়ে আমরা যাত্রা করলাম সান্তালুসিয়া ডুমরিয়ানির উদ্দেশ্যে।

যথারীতি রাতের খাবার খেয়ে, চাঁদের আলোয় সৈকতে হাঁটাহাঁটি এবং চমৎকার ঘুমের পর আমরা তৈরি হচ্ছি আরেকটি রৌদ্রজ্জ্বল দিনে কোর্সিকার রূপ দেখবো বলে। আজকের গন্তব্য ছিলো আজাসসিও। কোর্সিকার সবচেয়ে বড় শহর এবং রাজধানী। সাড়ে তিন ঘণ্টা ড্রাইভ করে আমরা যখন আজাসসিও পৌঁছলাম, তখন সূর্য মধ্যগগনে। আমি আগেই বলেছি এই দ্বীপটার মাঝখানে শুধুই পাহাড়। সেই উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ, হাত দিয়ে প্রায় ছুঁয়ে দেখার মতো মেঘবালিকার দল আর রবিনহুডের শেরউড জঙ্গল পাড়ি দিয়ে আমাদের আসতে হয়েছে রাজধানী আজাসসিওতে। আজাসসিও হচ্ছে সেই বিখ্যাত শহর, যেখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন জগৎখ্যাত নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, ১৭৬৯ সালের ১৫ অগাস্ট। নেপোলিয়ন বোনাপার্টের পৈতৃক বাড়িটিই এখন কোর্সিকার জাতীয় জাদুঘর।

আজাসসিওতে এসে আমরা পুরো শহরটাও ঘুরে দেখেছি প্রথমে। সবকিছু সাজানো-গোছানো পরিপাটি বন্দর শহর। যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই ভালো লাগা। পুরো শহরজুড়ে আছে নেপোলিয়নের বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য। জাতীয় জাদুঘরেও আছে দেখার অনেককিছু, আছে বিভিন্ন ধরনের বোট বা বিলাসতরী ভাড়া করে সাগরে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ। সাগরের অগভীর পানিতে আছে মাছের প্রজনন কেন্দ্র, সেটাও দেখে আসা যায়। স্কুবাডাইভিং অথবা সারফিং সরঞ্জাম ভাড়া পাওয়া যায় যত্রতত্র। আছে হেলিকপ্টার নিয়ে পুরো দ্বীপ ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ। আর বিভিন্ন ধরনের ছোট বড় মাঝারি সৈকত এবং সৈকতঘেষা বাড়ি, প্রাইভেট জেটি বোটসহ হোটেল, রেস্টুরেন্টের তো অভাব নেই এই দ্বীপে।

পানির রং কখনো নীল, কখনও সবুজ। আমরা আজাসসিও দেখতে দেখতে চলে এসেছি, একদম এর শেষ সীমানার বাতিঘরে। বাতিঘর মানেই আমার কাছে, হলিউড মুভির সেই চুম্বক অংশ। প্রচণ্ড ঝড়ের রাত, উত্তাল সাগর, বাইরে ওত পেতে থাকা শত্রু এবং নায়ক-নায়িকার বাতিঘরে আশ্রয়! এই ভাবতে ভাবতে যখন যাচ্ছি হঠাৎ নাকে তীব্র, ঝাঁঝালো একটা গন্ধে ঘোর কেটে গেলো। আমার স্পাউস জানালেন, ইহা মৃত মানুষ পোড়ানো গন্ধ। আমরা যাচ্ছি আজাসিয়োর সিমিট্রির পাশ দিয়ে। গন্ধ পাওয়ার কারণ হলো, এখানে মৃতদেহ পোড়ানো হয়। সব ধনী ব্যবসায়ীদের আর পুরনো ঐতিহাসিক পরিবারের পারিবারিক নামে একেকটা সিমিট্রি। কি অদ্ভূত! জীবনের এত আয়োজন, বিলাসিতার এত সব উপকরণ ছেড়ে চলে যেতে হবে, চলে যেতে হয়।

এর মাঝেই চোখ পড়লো এই গরমে নীলস্যুট পরিহিত এক সুদর্শন পুরুষের উপর। আমি যখন কোথাও ভ্রমণ করি, তখন আশপাশের মানুষদের আমি ভীষণ লক্ষ্য করি। তাদের বৈচিত্র কোথায় সেটা বোঝার জন্য। গত কয়েকদিন ধরেই আমি দেখেছি এই দ্বীপের স্থানীয় লোকজন তামাটে বর্ণের, রুক্ষ চুলের অধিকারী এবং মিষ্টিভাষী। আর টুরিস্টরা সব অতি উৎসাহী, যেমনটা হওয়া উচিত। চারদিক দেখছে, ছবি তুলছে আর শপিং করছে।

তো এই নীল সূট্যের সুদর্শন পুরুষের দিক দৃষ্টি আটকে গেলো, কারণ দামি গাড়ি আর দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত হবার কারণে। কোর্সিকার পাশের দ্বীপই সিসিল, মাফিয়াদের স্বর্গরাজ্য। উনি নিশ্চয় মাফিয়া ডন হবেন! গডফাদার দেখার পর থেকেই সিসিলের প্রতি আমার তীব্র আকর্ষণ। যেতে হবে সিসিল, যেতে হবে, মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে ভাবছি। লোকাল ফুড খেয়ে এসব ভাবতে ভাবতে ৭ দিনের অস্থায়ী বাড়ির পথ ধরলাম।

মাঝখানের দুটি দিন আমরা বাড়িতেই কাটালাম। আমার বর প্রতি সকালেই সাগরে মাছ ধরতে যান, মাছ তেমন না পেলেও স্কুইড ধরে নিয়ে বাড়ি ফিরেন। আমার ছোট ভাই আবার মহাউৎসাহে ওই স্কুইড ফ্রাই করেন এবং ভক্ষণ করেন। দুপুরে সবাই মিলে হৈ হৈ করতে করতে রান্না করি, আমাদের যেনো রোজ চড়ুইভাতি চলছে। দুপুরের তপ্ত দাবদাহ শেষে সবাই মিলে বিকেলে সমুদ্রস্নান।

এই সময়টা সবচেয়ে বেশি উপভোগ করে আমার বাচ্চারা। এর মাঝে দিয়ে কিছু শপিং সেতো করতেই হবে। কোর্সিকার সূভিন্যর, পোস্টকার্ড, বিভিন্ন ধরনের ম্যাগনেটসহ কত শত বাহারি জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন দোকানিরা। সবাই কথা বলছেন ফরাসি, কোর্সিকার লোকাল ভাষায়। কেউ কেউ ইংরেজিতেও নিজের পণ্যের বর্ণনা করেছেন ক্রেতার কাছে। আমি কিছু সূভিন্যর আর পোস্টকার্ড নিলাম বন্ধুদের জন্য। আর নিলাম কোর্সিকানদের তৈরি জনপ্রিয় বিয়ার, আমার ফরাসি বন্ধুদের গিফট করবো বলে।

আনন্দের দিন দ্রুত চলে যায়, আমাদেরও দিন ফুরিয়ে আসছে। হাতে আর একদিন আছে, ফিরে আসার আগের দিনটা তাই উপভোগ করতে আমরা চলছি ইলরোস নামে পাশের আরেকটা শহরে। ইলরোস নামের অর্থ হলো ‘লাল দ্বীপ’। ছোট ছোট টিলা আর প্রাচীন, পুরাতন বাতিঘর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইলরোস। ইলরোসে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো এর সৈকত। স্বচ্ছ সবুজ পানির এই সৈকত টুরিস্টদের কাছে অন্যতম আকর্ষনীয় স্থান।

যতটা সম্ভব ইলরোস শহর দেখে, আমরা তৈরি হয়ে গেলাম কাঁচের মতো স্বচ্ছ সবুজ জলে ভেসে বেড়াবো বলে। অসংখ্য টুরিস্টদের মাঝে খানিকটা জায়গাও বের করে ফেললাম নিজেদের আস্তানার জন্য। কোন সৈকত এবং সৈকতের পানি এত সুন্দর,  এত স্বচ্ছ, এত সবুজ হতে পারে, আমার জানা ছিলো না। মনে হচ্ছে কাঁচের উপর দাঁড়িয়ে আছি। তিনটা বাচ্চা আর চারজন এডাল্ট সদস্য নিয়ে আমাদের সাতজনের এই গ্রুপের কারও এই স্বচ্ছ পানির লেগুনা ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছে না। শিশু, তরুণ, বৃদ্ধ সবাই যেনো উন্মাদনৃত-রত এই অপূর্ব সুন্দরী সবুজ লেগুনার সন্ধান পেয়ে। এ আমি কোথায় এসে পড়েছি, এতো আমার চিরচেনা পৃথিবী নয়। ধন্য ধন্য আমার জীবন প্রিয়তম!

আমরা যখন কোর্সিকা ভ্রমণে আসার পরিকল্পনা করি, তখন আমাদের বন্ধুরা বলেছিলো, এক ট্রিপে কোর্সিকা দেখে শেষ করতে পারবে না। কথা সত্য! খুবই সত্য। অনেককিছু দেখার বাকি রয়ে গেলো। আবার আসতে হবে, অবশ্যই আসতে হবে। আমার বরতো অবসরের পর কোর্সিকা এসে পাকাপাকিভাবে থাকবেন বলে মনস্থির করেই ফেললেন।

আজ শেষের দিন, ফিরতি পথে আমরা রাতের জার্নি বেছে নিয়েছি। কিছুটা ঘুমিয়ে, আড্ডা দিয়ে, গল্পের বই পড়ে একটা সুদীর্ঘ মন খারাপের রাত্রি আমরা যাপন করলাম ভূমধ্যসাগরের বুকে। আমরা ফিরে যাচ্ছি সেই চিরচেনা পৃথিবীতে, সেই পরিচিত রুটিনের জীবনে। সাথে সঞ্চয় করে নিয়ে যাচ্ছি অপার শক্তি। এই শক্তি প্রতিদিনের রুটিন জীবনে ম্যাজিকের মতো কাজ করবে। ভ্রমণ করুন, আত্মাকে তৃপ্ত করুন!

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!