হার্ভার্ডে বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্প

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয় এমন সংবাদ-বিশ্লেষণের সমালোচনা করে একে বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রার বড় অন্তরায় বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিনারের আলোচকরা। 

নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Sept 2019, 02:31 PM
Updated : 19 Sept 2019, 03:38 PM

সোমবার বস্টনে হার্ভার্ড ইউনিভাসিটির উদ্যোগে গুতম্যান করফারেন্স সেন্টারে দিনব্যাপী এ কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়।

সেমিনারের উদ্বোধনী পর্বে হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের বেলফার সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের সিনিয়র ফেলো ইকবাল কাদির তার আলোচনায় গত দশকের বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোকপাত করেন।

তিনি বলেন, “বিনিয়োগে আগ্রহীদের জন্যে অপূর্ব পরিবেশ বিরাজ করছে।”

তবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের ইমেজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়-এমন সংবাদ-বিশ্লেষণের সমালোচনা করে কাদির বলেন, “চলমান উন্নয়ন-অভিযাত্রায় এ এক বড় অন্তরায়।“

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর বিভিন্ন পথ-পরিক্রমায় বাংলাদেশ যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে মনে করেছি, সেসময় আমি আমেরিকার বেশ কটি কোম্পানির সাথে কথা বলেছি বাংলাদেশে যাবার জন্য। সকলেই নাকচ করেছেন আমার অনুরোধ। এক পর্যায়ে নরওয়ের টেলিফোন কোম্পানি আমার অনুরোধে সাড়া দেয়। সেই কোম্পানির বর্তমানে বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিমাণ ৭ বিলিয়ন ডলার।”

“তবে এখনও পশ্চিমা দেশগুলোয় নেতিবাচক ধারণা রয়েছে বাংলাদেশ সম্পর্কে। তারা বাস্তবতার আলোকে বিবেচনায় আগ্রহী নয়। এমন অবস্থার উত্তরণে আমার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এখনও একই প্রক্রিয়ায় রয়েছি বলে মাথার চুল কম দেখতে পাচ্ছেন। আমি আজ স্বস্তি পাচ্ছি এজন্যে যে, হার্ভার্ডে মিত্তাল ইন্সটিটিউটের পরিচালক এবং হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ড. তরুণ খান্না বাংলাদেশ নিয়ে এ কনফারেন্সের আয়োজন করলেন।”

“শিক্ষাবিদ, উন্নয়ন অর্থনীতি নিয়ে গবেষণারতরাই এখানে এসেছেন। আমি সর্বান্তকরণে আশা করছি, পশ্চিমাদেশসমূহে বিরাজিত নেতিবাচক মনোভাব অবসানে এ আলোচনা বড় ধরনের একটি প্রভাব ফেলবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিশ্বে দুই শতাধিক দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০ এ। এবং জনসংখ্যাগতভাবে বাংলাদেশের অবস্থান দশম।”

ইকবাল কাদির অত্যন্ত প্রত্যয়ের সাথে উল্লেখ করেন, “বর্তমানের ধারা অব্যাহত থাকলে তিন দশকের মধ্যেই বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ভিতওয়ালা দেশের মধ্যে ২০তম স্থান দখলে সক্ষম হবে।”

তিনি বলেন, “গত তিন দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার অব্যাহত থাকার প্রশংসাও উচ্চারিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।”

করফারেন্স সেন্টারে দিনব্যাপী এ কনফারেন্সে অংশ নেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তাসহ এমআইটি, ব্রাউন, কর্নেল, ক্যানসাস, প্রিন্সটনের স্কলার, বিশ্বব্যাংকের সাবেক চিফ ইকনোমিস্ট, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা।

ছিলেন এসডিজি বিষয়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধান সমন্বয়কারী আবুল কালাম আজাদ, অর্থ সচিব আব্দুর রৌফ তালুকদার, বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী, বিজিএমইএর প্রেসিডেন্ট রুবানা হক, উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশিদের তথ্য-প্রযুক্তি সেক্টরে কর্মসংস্থানে দীর্ঘদিন যাবত কর্মরত ‘পিপল এন টেক’ এর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও ইঞ্জিনিয়ার আবুবকর হানিপ।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং বর্তমানে কর্নেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক কৌশিক বসু ২০১৫ সালে ঢাকা সফরের আলোকে বলেন, “ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোকে পেছনে ফেলে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি মানুষের জীবন-মানের উন্নয়নেও উদাহরণ তৈরি করেছে দেশটি। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ভারতের চেয়েও বেশি। এসব সম্ভব হচ্ছে উন্নয়ন-অভিযাত্রায় সমগ্র জনগোষ্ঠিকে একীভূত করায়।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এসডিজি বিষয়ক প্রধান সমন্বয়কারী আবুল কালাম আজাদ আলোচনা করেন এমডিজির পথ ধরে বাংলাদেশ কীভাবে এসডিজি-তেও অগ্রগতি সাধন করছে সে বিষয়ে।

‘কাউকে পিছিয়ে থাকতে দেয়া হবে না: ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে’ শীর্ষক আলোচনাটি ছিল মধ্যাহ্নভোজের পর।

অর্থাৎ অনেকেই পরিশ্রান্ত কিংবা ঘুম কাতুরে ছিলেন। এ অবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটাতে উন্নয়নের ধারাবিবরণী উপস্থাপনে বড় পর্দায় একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখান তিনি। সেটি ছিল ‘উন্নয়নের জয়যাত্রা’র আলোকে। আর এর মধ্যদিয়েই সকলে ফেরেন স্বাভাবিক অবস্থায় এবং গভীর মনোযোগ দিয়ে নানা ক্ষেত্রে অগ্রযাত্রার তথ্য-চিত্রসমূহ অবলোকন করেন।

স্বল্পভাষী আজাদ বলেন, “গত ১০ বছরে বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের জীবনে অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। বাংলাদেশের কোন গ্রামেই এখন খালি পায়ে কাউকে হাঁটতে দেখা যায় না। স্কুল-কলেজগামী ছাত্র-ছাত্রীদের কটি পোশাক রয়েছে, সে কথাও সরাসরি জানা সম্ভব হয় না। অথচ একসময়ে একজন ছাত্রের একটির বেশি শার্ট অথবা প্যান্ট ছিল না। বাজার-ঘাটে জুতা-স্যান্ডেল পায়ে খুব কম মানুষকেই দেখা যেত। এসব সম্ভব হয়েছে সমগ্র জনগোষ্ঠিকে উন্নয়নে উদ্বুদ্ধ করায়।”

তিনি বলেন, “বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি এবং অনিয়ম অথবা স্থবিরতা থাকলেও সর্বক্ষেত্রে নয়। দুর্নীতি রোধে কঠোর পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ঢালাও অভিযোগ এখন করা সমীচিন নয়। কারণ, আমি নিজেও একজন আমলা। কিন্তু আমি সকল মানুষের সাথে বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলি। তাদের পরামর্শ গ্রহণ করি। প্রবাসীরাও এগিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশে। তাদের মেধা-অভিজ্ঞতাকেও বাংলাদেশ কাজে লাগাতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।”

কনফারেন্সের সঞ্চালনা করেন নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশি রেশমা হুসাম। সনোফিল্টারের উদ্ভাবক হুসামের কন্যা রেশমা হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে রয়েছেন। মেধাবী এই বাংলাদেশী আমেরিকানও বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং অভিবাসন নিয়ে কথা বলেছেন।

এবারই প্রথম হার্ভার্ডের নিজস্ব উদ্যোগে বাংলাদেশ নিয়ে কনফারেন্স হলো এবং আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্নরা এতে গবেষণা-পর্যবেক্ষণমূলক বক্তব্য উপস্থাপন করলেন।

কেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবেন-এ আলোকে অনুষ্ঠিত সেমিনারে বক্তৃতাকালে ব্রুমার অ্যান্ড পার্টনারের ম্যানেজিং পার্টনার খালিদ কাদির অভিযোগ করে বলেন, “বাংলাদেশের আমন্ত্রণে অনেকে সেখানে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আমলাদের আন্তরিক সহযোগিতা পাননি। এমন পরিস্থিতির অবসান ঘটানো উচিত।”

এসময় বাহরাইনের আসমা ক্যাপিটল পার্টনার নামক একটি কোম্পানির অধিকর্তা আবু বকর হানিপ বলেন, “বিদেশি বিনিয়োগকারি হিসেবে আমি (বাংলাদেশে) সকলের সহায়তা পাচ্ছি। সুতরাং ঢালাওভাবে অভিযোগ করা সমীচীন নয়।”

এ পর্বে অর্থ সচিব আব্দুর রৌফ তালুকদার বলেছেন, “বিদেশি বিনিয়োগকারিদের সাদর আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রণোদনাও দেওয়া হয়েছে। আগের অবস্থানে নেই বাংলাদেশ। সেজন্যই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে সর্বক্ষেত্রে। উন্নয়নের মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।”

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরীও কোন কোন ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার প্রসঙ্গ টানলেও সামগ্রিক অর্থে বাংলাদেশে বিনিয়োগের চমৎকার একটি পরিবেশ বিরাজ করছে বলে মন্তব্য করেন।

বিদেশি বিনিয়োগকারিদের আকৃষ্ট করতে ১০০টি রপ্তানি উন্নয়ন জোন প্রতিষ্ঠা করার কথাও তিনি জানান।

ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মুসা সবচেয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ঘনবসতিপূর্ণ ছোট্ট একটি জনপদের মানুষ কীভাবে উন্নয়নের ছোঁয়া পেয়েছে তা আলোচনা করেন।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি এনজিওগুলোর কার্যক্রমকেও গুরুত্ব দেন তিনি।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঘাতকদের বর্বরতা নিয়ে পর্বের সঞ্চালনা করেন বিবিসি নিউজের মাহফুজ সিদ্দিকী। এতে অংশ নিয়ে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যাপক গ্যারি ব্যাস নানা যুক্তিতর্কের মাধ্যমে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্তদের সমর্থনকারি রাজনৈতিক দল অর্থাৎ জামায়াতে ইসলামীকে গণতান্ত্রিক পরিবেশে স্বাভাবিক কাজকর্ম পরিচালনার পক্ষে মত দেন।

অবশ্য কনফারেন্সে উপস্থিত আর কেউই এমন মত সমর্থন করেননি। বিপরীতে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্তদের বিচার কার্যক্রমেরই প্রশংসা উচ্চারিত হয়েছে বাকি বক্তাদের কণ্ঠে।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!