প্রবাস জীবনে বাঙালি লোকাচার

প্রবাস জীবনের একঘেয়েমিতে আমরা আমাদের জীবনযাত্রার কোন না কোন একটা সময়ে হাঁপিয়ে উঠি। মনে হয় সব ছেড়ে ছুড়ে বৈরাগী হই, কিন্তু বাস্তবতার কষাঘাতে জর্জরিত জীবন সেই সুযোগ আমাদের দেয় না।

মো. ইয়াকুব আলী, সিডনি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Sept 2019, 09:48 AM
Updated : 6 Sept 2019, 09:48 AM

তখন দরকার হয় একটা ধাক্কার। অনেকদিন পরই তেমনই একটা ধাক্কা খাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। শ্যালিকা পলি এবং ভাইরা ভাই রাজিব প্রথমবারের মতো মাতা পিতা হতে যাচ্ছেন। সেই উপলক্ষকে সামনে রেখে শম্পা আপু এবং নাসের ভাই বাংলাদেশের লোকাচার মেনে একটা ‘সাধ’ আয়োজন করলেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী জীবনে সাধকে অবশ্য বেবি শাওয়ার বলা হয়। বেবি শাওয়ারের পাশাপাশি অনেকে মেয়ের কান ফোঁড়ানোর অনুষ্ঠানও করে থাকেন সেটাকে বলা হয়ে থাকে ‘ইয়ার পিয়ারচিং’।

তবে এই বেবি শাওয়ারের আয়োজনটা ছিলো একেবারেই অন্যরকম। আগের দিন রাত থেকে শম্পা আপুদের গ্যারেজের দেয়ালে আল্পনা আঁকার কাজ শুরু করে দিলেন নাসের ভাই। রাজিব দাদা আগেরদিন রাত দশটার সময় ফোন দিয়ে বললেন, এসে পড়েন। আমি জানি আপনি এইসব কাজ উপভোগ করেন। যেয়ে দেখি সারা দেয়ালজুড়ে সবে সাদা রঙের বেসটা আঁকা হয়েছে। এখন চলছে তার উপর নকশার কাজ।

নিজাম ভাই, আনোয়ার ভাই, মাহিন, মিশু সবাই হাত লাগিয়েছেন। আর গ্যারেজের দরজাটা এবং সামনের মেঝেটাকে নাসের ভাই এমনভাবে সাজিয়েছেন হঠাৎ দেখে মনে হতে পারে আপনি বাংলাদেশের কোন সনাতন ধর্মাবলম্বীর বাড়িতে চলে এসেছেন। সামনের মেঝেটাতে বিভিন্ন রঙের সমন্বয়ে সাজিয়েছেন আর গেটটাতে সাদা, লাল এবং হলুদ রং দিয়ে একেবারে সনাতনি ঘরে ঢোকার দরজার আকার দিয়েছিলেন।

এমনকি প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি পর্যন্ত নাসের ভাই বাদ দেন নাই। সনাতনীদের ঘরের দরজায় সোলার তৈরি কদম ফুল ঝুলিয়ে রাখা হয় সেটা পর্যন্ত উনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন। এছাড়া রঙের মধ্যে বাংলাদেশের মতো করে ছোট ছোট ফোঁটা দিয়েছিলেন যেটা সাধারণত আতপ চাল পাটায় বেটে পানিতে গুলিয়ে সেটা দিয়ে দেয়া হয়। গ্যারেজের বিপরীত পাশে মাটির উপরে মঞ্চ বানানো হয়েছে, কিন্তু সামান্য একটু কাজ বাকি, কারণ করাতটা ভেঙে গেছে।

আমি আমাদের প্রতিবেশী নাজমুল ভাইকে ফোন দিয়ে করাত আছে কিনা জিজ্ঞেস করাতে উনি বললেন আরো কিছু লাগলে জিজ্ঞেস করো উনাদের। আমার কাছে সাউন্ড সিস্টেমও আছে। নাজমুল ভাই আমাদের যে কোনো জরুরি প্রয়োজনের আশ্রয়স্থল। উনার কাছে গেলেই সব সমাধান হয়ে যায়। আমি করাত নিয়ে ফিরে এসে আনোয়ার ভাইয়ের সাথে মিলে মঞ্চের পাটাতনের হার্ডবোর্ডের বাড়তি অংশ ছাড়িয়ে দিলাম। তারপর সামনের খোলা অংশ ঢাকার জন্য তিনটা স্ট্রিপ কেটে দিলাম। আনোয়ার ভাই পেরেক ঠুকে সেগুলো বসিয়ে দিলেন, ফলে মাটি আর মঞ্চের ফাঁকা জায়গাটা ঢেকে গেলো। শ্যালিকা শুক্লার কাজ থাকাতে উনি আসতে পারেননি, কিন্তু পরেরদিন অনুষ্ঠানে আসবেন।

তাহিয়া, রায়ান, জেভিয়ার ছোটরা সবাই নিজেদের মতো করে খেলে বেড়াচ্ছিলো। আইভি আপু দায়িত্ব নিয়ে সবগুলো বাচ্চাকে নুডলস রান্না করে খাইয়ে দিলেন। এরপর আমিও আল্পনাতে হাত লাগালাম। নাসের ভাই সাদা বেসের মধ্যে লাল, নীল, হলুদ বিভিন্ন রঙের বর্ডার দিয়ে সেগুলো রঙ দিয়ে পূরণ করতে বলে দিলেন। আমরা সবাই মিলে সেগুলো পূরণ করছিলাম একে একে। এভাবেই একসময় অবাক হয়ে দেখি গ্যারেজের দেয়ালটা ঢাকার চারুকলার দেয়ালের রূপ পেয়ে গেছে।

কি নেই সেখানে? বাঙালি উৎসব অনুষঙ্গের সব উপকরণ মূর্ত হয়ে উঠেছে গ্যারেজের দেয়ালে। সত্যি কথা বলতে কি আমার শুরুতে এমন ধারণা ছিলো না, কারণ তখন শুধু সাদা রঙের বেস আঁকা হয়েছিল। নাসের ভাই একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। পড়েছেন বাঙলায়, তাই উনার এই সাংস্কৃতিবোধটা সহজাত। আর উনি পেশায় একজন ফটোগ্রাফার। সিডনিতে উনার ফটোগ্রাফির যথেষ্ট কদর আছে।

রঙ করতে করতে মাঝরাত পেরিয়ে গেলো। পলি এবং রাজীব দাদাকে তাদের লিভারপুলের বাসায় ফিরতে হবে মিন্টো থেকে। তাই উনারা বেরিয়ে গেলেন এগারোটার দিকে। একটুপর দেখি রাজীব দাদা ফিরে এসেছেন। এসে বললেন পলিকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে আসলাম। আমরা বললাম ভালোই করেছেন। আপনি না থাকলে খালি খালি লাগে। তারপর সবাই মিলে আবারো অল্পনাতে হাত লাগলেন। ইতোমধ্যে শম্পা আপু বড়দের জন্য বাসার পাশের ফুড চেইনশপ অপরতো থেকে বার্গার আর কোক নিয়ে আসলেন। বড়দের সাথে ছোটরাও সেগুলো একেবারে হালুম হালুম করে খেয়ে নিলেন। রাত বেশি হয়ে যাওয়াতে আর সাদা রংটা পুরোপুরি না শুকানোর কারণে অন্য রংগুলো আর বসছিলো না। তাই নাসের ভাই বললেন আজকের মতো বাদ থাক। বাকিটা কাল সকালে দেখা যাবে। আমরা রাজীব দাদাকে উনার বাসায় নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরে আসলাম। 

নাসের ভাই পরের দিন দুপুর বারোটার মধ্যে যাওয়ার কথা বলে দিয়েছিলেন, কারণ রঙের বাকি কাজটা ছাড়াও মঞ্চসজ্জার কাজ তখনও বাকি ছিলো। কিন্তু হঠাৎ ক্যানবেরা থেকে আমাদের অতি আপন একটি পরিবার চলে আসাতে আমাদের যেতে একটু দেরি হয়ে গেলো। যেয়ে দেখি অতিথিরা সবাই ইতোমধ্যে এসে পড়েছেন। সেদিনটা আবার ছিলো অস্ট্রেলিয়ার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বসন্ত কালের প্রথম দিন, তাই সবাইকে বাসন্তী পোশাক পরে আসতে বলা হয়েছিলো। ছেলেদের জন্য সাদা পাঞ্জাবি আর মেয়েদের জন্য হলুদ শাড়ি। এই পোশাক পরে সবাই যখন আল্পনা করা দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলো আমার তখন মনে হচ্ছিলো আমি যেন চারুকলার বকুলতলায় বসে তরুণ-তরুণীদের প্রাণোচ্ছল আনন্দ উদ্দীপনা উপভোগ করছি।

তবে সবচেয়ে সুন্দর লাগছিলো বাচ্চাগুলোকে। সাদা পাঞ্জাবি আর লাল শাড়িতে ওদের দেখে মনে হচ্ছিলো যেন আকাশ থেকে একঝাঁক পরী নেমে এসেছে। জানি না পরীদের মধ্যে পুরুষগুলোকে কি বলে? তবে মানহা সবার নজর করেছিলো। এতটুকু একটা মেয়েকে শাড়িতে দেখে আমার প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। সে আবার পটপট করে কথাও বলে। জেভিয়ারকে মানহার সাথে দাঁড় করিয়ে যুগল ছবি তোলা হলো। আমি সামনে যেয়ে একটু স্টাইল করে দাঁড়াতে বলতেই সে একেবারে পেশাদার মডেলদের মতো করে দাঁড়িয়ে পোজ দিয়ে দিলো।

কিন্তু মানহার ভাই এসে বাংলা সিনেমার স্টাইলে জেভিয়ারকে একটা ঘুসি দিলে বলল দিস ইজ নট ফেয়ার। এটা দেখে আমরা বড়রা হাসতে হাসতে শেষ। আসলেই বাংলাদেশের ভাইয়েরা আবহমানকাল ধরে তাদের বোনদেরকে এমন নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে এসেছে। জেভিয়ার অবশ্য মন খারাপ করেনি তবুও আমরা ওকে একটু সান্ত্বনা দিলাম। 

ছবি তোলার পর সবাই খাবার নিয়ে নিলেন। খাবারের পদগুলোতেও ছিলো ষোলআনা বাঙালিয়ানার ছোঁয়া। টিনা আপুর হাতের বিরিয়ানি সবাই হাপুস হুপুস করে খেলেন আর নিজাম ভাইয়ের বারোমিশালি সবজির প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ। আমি নিজে সবজিটা খেয়েছি বেশ কয়েকবার। কাঁচকলা, মুলা, বরবটি, মিষ্টি কুমড়া, শালগম কি নেই সেই সবজিতে। আর সবার শেষে মিষ্টান্ন হিসেবে ছিলো পায়েশ। খাবারগুলোর সবই নিজেদের রান্না করা। অতনু, এনি, প্রণতি, পার্থ সবাই এসেছিলো তাদের পরিবার নিয়ে বান্ধবী পলির এই অনুষ্ঠানকে পূর্ণতা দিতে।  

খাবার শেষে শুরু হলো আসল মজা। মোক্তার ভাই ছিলেন এই আনন্দ আয়োজনকে পূর্ণতা দেয়ার জন্য। উনার গান শুরু হবার আগেই মঞ্চের উপর বসে ছবি তোলার সময় আমরা বিভিন্ন রকমের গান ছেড়ে দিলাম ছবির বিষয়বস্তুর সাথে মিল রেখে। সেটা মোবাইলের ইউটিউব হয়ে মোক্তার ভাইয়ের সাউন্ড বক্সের মাধ্যমে বেজে উৎসবের পরিবেশটাকে মুখরিত করে রাখছিলো। সেই আশির দশকের বাংলা হিন্দি গান থেকে শুরু করে হালের বাংলা হিন্দিসহ সব রকমের গানই বাজানো হচ্ছিলো। যেমন সব মেয়েরা যখন মঞ্চে উঠে সবাই মিলে কালো চশমা পরে ছবি তুলছিলো তখন ছেড়ে দেয়া হলো হালের হিন্দি গান কালো চশমা। এরপর একসময় ছবি তোলা শেষ হয়ে গেলে পলি আর রাজিব দাদা মাইল আমার গরুর গাড়িতে গানটার সাথে মূকাভিনয় করে সবাইকে আনন্দ দিলেন।

এরপর কখনও ছাড়াছাড়াভাবে এবার কখনও দলগতভাবে চললো বিভিন্ন প্রকার গানের সাথে নেচে চলা। তারপর মোক্তার ভাই তার গান শুরু করলেন। সবাই কণ্ঠ মিলিয়ে সেই গানগুলোকে অন্যমাত্রা দিলেন। এরপর আবারো শুরু হলো গানের সাথে ক্ষেমটা নৃত্য। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিলো বাংলাদেশের বিয়েবাড়িতে একদল কিশোর কিশোরী নেচে গেয়ে বাঁধভাঙা আনন্দ উল্লাস করছে। সবশেষে শুরু হলো বালিশ খেলা। গানের তালে তালে এবার বালিশ নেচে চললো এক হাত থেকে অন্য হাতে। আর যেই গান থেমে যাচ্ছিলো সাথে সাথে থেমে যাচ্ছিলো বালিশের নাচ। বালিশ খেলায় চ্যাম্পিয়ন হলেন মিষ্টি শ্যালিকা টিনা আপু।

এভাবে একসময় অনেক রাত হয়ে গেলো, কিন্তু আমাদের আনন্দ আয়োজন যেন শেষই হতে চাইছিলো না। সবাই মিলে হাত লাগিয়ে সবকিছু গোছগাছ করে আবারো সবাই মিলে খেতে বসে গেলো। খাবার শেষে সবাই শম্পা আপু আর নাসের ভাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিলেন। 

প্রবাস জীবনে এমন মুহূর্তগুলো আসে একটু দুদণ্ড স্বস্তিতে বসে নিঃস্বাস নেয়ার জন্য। আর ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য এটা ছিলো খুবই আনন্দের। অনেকদিন পর ক্যাম্পাস জীবনের মতো করে বাধাহীন আনন্দ করার সুযোগ পেলাম। এই আনন্দ আয়োজনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিলো এর প্ৰত্যেকটা উপকরণে ছিলো ষোলআনা বাঙালিয়ানার ছোঁয়া, এমনকি ছোট বাচ্চাদের পোশাক পরিচ্ছদেও ছিলো তার ছোঁয়া। তাই বড়দের পাশাপাশি ছোটরাও প্রাণভরে উপভোগ করেছিলো।

প্রবাসী হবার পর রাতারাতি নিজেদেরকে অজি প্রমাণ করতে যেখানে সবাই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সেখানে এমন আনন্দ আয়োজন সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। আপনি যদি নিজের দেশের সংস্কৃতিকে ভালোবাসেন এবং চর্চা করেন তাহলে আপনি অন্য দেশের সংস্কৃতিকেও খুব সহজেই আপন করে নিতে পারবেন আর অস্ট্রেলিয়ায় সরকারিভাবেও এইসব সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ধরে রাখার ব্যাপারে সবসময়ই উৎসাহিত করা হয়।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!