কঠোর নিয়মতান্ত্রিকতা, যান্ত্রিক ব্যস্ততা হয়ত সেভাবে ভাববার অবকাশ দেয় না, তারপরও কিছু কিছু মুহূর্তে সময় থমকে দাঁড়ায়, ক্ষণিক ভাবনায় অন্তরচক্ষে ভেসে উঠে প্রিয় বাংলাদেশ, ফেলে আসা পরিবারের আপনজন, প্রাণের বন্ধু-বান্ধব। অবর্ণনীয় মায়া কাজ করে শৈশবে বেড়ে ওঠা গ্রামের প্রতি, গ্রামের প্রতিটি ধুলিকণার প্রতি, এক যুগ কাটিয়ে আসা বিরক্তিকর ঢাকা শহরের প্রতি, হযবরল বিচ্ছিরি সজ্জার শহুরে অলিগলি কিংবা ঝলমলে আলোতে ভ্যাপসা গরমে মানুষে ঠাসা মেগা শপিংমলগুলোর প্রতি, উৎকট গন্ধযুক্ত কাঁচা বাজারের প্রতি ইত্যাদি হাজারো তুচ্ছ বিষয়ের প্রতি।
সন্ধ্যাবেলায় খেলা শেষে শিশু যেমন গৃহে ফেরে, মা যেমন করে মায়াময় চোখে তাকিয়ে থাকে সন্তান ফিরবে বলে, ঠিক তেমনি দেশের প্রতিটি প্রিয়-অপ্রিয় বস্তু মায়ার জাল বিছিয়ে ডাকে, আয় খোকা আয়!
এমনই মায়ার জাল ছিন্ন করে গত বছরের আগস্ট মাসে পাড়ি জমিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রে। ওহাইয়ো স্টেটের ইয়াংস্টাউন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে গণিত এবং অ্যাকচুরিয়াল সায়েন্সে দ্বিতীয় মাস্টার্স করছি। বিনা স্বদেশী ভাষা যেমন পুরে না আশা তেমনি বিনা বাংলাদেশি জমে না আড্ডা, জুরায় না প্রাণ। বাঙালি বাঙালির সঙ্গে মিশে যে শান্তি পায়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে গলফ খেলে কিংবা সেলেনা গোমেজের সঙ্গে কফি খেয়েও সেই শান্তি পায় না।
বাঙালির আড্ডায় থাকে বাংলাদেশ, থাকে দেশের মানুষ আর মধুময় ছোট ছোট স্মৃতি যার মূল্য শুধু বাঙালির কাছেই আছে। তুলনামূলক ছোট বিশ্ববিদ্যালয় হওয়াতে এখানে বাংলাদেশি কমিউনিটি খুব ছোট। পূর্বে অনেক বাংলাদেশি ছাত্র থাকলেও এখন বর্তমানে আন্ডারগ্র্যাডে জিসান, আমি এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম ছাড়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি কেউ নেই। যদিও আশপাশে দুই চারটি বাঙালি পরিবার আছে যারা এক সময় ছাত্র হিসেবে এখানে এসেছিল, এখন চাকরি বা ব্যবসা করছেন।
জীবনের সুন্দরতম সময় কেটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে। রমজান মাস আসলে কার্জন হল অঙ্গনের চেহারা পালটে যায়। হলের ভেতরে যে দোকানগুলোয় নিয়মিত সকালের নাস্তা বিকেলের খাবার পাওয়া যায় তারা সেটি না করে গোধূলিবেলায় পুকুরপারে ইফতারের পশরা সাজিয়ে দোকান দেয়। এখনো বোধ হয় দেয়, শুধু সেই সেদিনের আমরা নেই। রুমমেটরা চাঁদা তুলে পিঁয়াজু, বেগুনি, ছোলা, বুন্দিয়া, জিলাপি কিনতাম। পেপারে বিছিয়ে খাওয়া সে ইফতার অস্বাস্থ্যকর হলেও সেটি আমাদের জন্য ছিল অমৃতসম।
বন্ধুদের ডেকে সারারাত পুকুরপারে চায়ের দোকানে কিংবা ঢাকা মেডিকেলের সামনে চলত অর্থহীন আড্ডা। চায়ের পেয়ালা আর নিকোটিনের ধোঁয়ায় আলোচিত হয়নি এমন কোন বিষয় বোধয় এ পৃথিবীতে নেই। মহাবিশ্বের গঠন, গ্রহ নক্ষত্রের গতি বিচ্যুতি, গাণিতিক সমীকরণ, দেশের উন্নতি অবনতি, দেশীয় আন্তর্জাতিক রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, প্রেম-কাম এমনকি মনুষ্য নিঃসৃত বায়ুর উপাদান কী কী এমন সব তুচ্ছ অর্থহীন তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে রাত পার হতো।
এমনিভাবে রাতের দুই-তৃতীয়াংশ পার করে সেহেরি খাওয়ার লাইনে দাঁড়াতাম ডাইনিং-এ। হলের ডাইনিং-এ অন্যান্য মাসের খাবারে মুখে জং ধরে গেলেও রোজার মাসের খাবার থাকত অন্যরকম। প্রতিদিনই গরুর গোস্ত, মাছ, মুরগি বা খাসীর গোস্ত থাকত। মাছের ভর্তাসহ অন্যান্য বেশ কয়েক পদের খাবার থাকত। বেশিরভাগ সময়েই রমজান মাসে আমাদের ক্লাস থাকত না, থাকলেও অটো (সবাই মিলে যুক্তি করে ক্লাস বর্জন) নিয়ে নিতাম। আহা কি দিন ছিল সেগুলো!
শুধু অঞ্চলভেদে ভিন্ন ধারায় রান্না, এই পার্থক্য। পরিমাণে অফুরন্ত, মানে আপনি যত খুশি তত খেতে পারবেন। ইচ্ছে করলে বাসায়ও নিয়ে আসা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট আছে যারা রমজান মাসে চুলো জ্বালায় না। মসজিদে ইফতার করে, খাবার নিয়ে এসে রাতে সেহেরি করে। শুধু যে মুসলিম ছাত্ররাই মসজিদে ইফতার করতে যায় তা নয়, অন্য ধর্মের ছাত্ররাও যায়। এত কেউ কিছুই মনে করে না বরং উৎসাহিত করে এবং আশপাশে যদি আরো কেউ আসতে চায় তাকে যেন সাথে করে নিয়ে যাওয়া হয়, সবাই একে সাধুবাদ জানায়।
শিশুসহ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এখানে সবাই মসজিদে যায়। নিচতলা নারীদের জন্য আর উপরের তলায় পুরুষ নামাজিদের জন্য। আর সবার নিরাপত্তায় বাইরে অবস্থান করে কালো পোশাকে পুলিশ। পুলিশকে খাবার দিতে চাইলে বেশিরভাগ সময়েই না করে, তবে মাঝে মধ্যে তারা খায়। ইফতারের টেবিলে প্রতিদিনই পরিচয় হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের সাথে। এইযে সবাই মিলে দল বেঁধে ইফতার করতে যাওয়া, বিভিন্ন মানুষের সাথে মেশা সেটাও কি কম আনন্দের! উৎসব সব দেশেই আছে, ভিন্ন দেশে ভিন্ন বেশে।
প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে গল্প শোনা যায় ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরা আশপাশের বাঙালি কমিউনিটিতে অনেকটা অচ্ছুত অনাহূত। পকেটে পয়সা নেই, গ্যারেজে গাড়ি নেই, এদেরকে প্রতিষ্ঠিত দেশি ভাই-ভাবীরা মানুষের কাতারে ফেলে না। ভাল মন্দ আয়োজন হলে দাওয়াত মেলে না। তবে বাসা বদল বা কায়িক শ্রমের প্রয়োজন হলে নাকি এদের ডাক পাওয়া যায়। এমন গল্প হরহামেশাই শোনা যায়।
কিন্তু আমার বেলায় এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমার আশপাশে এমনই সব বাংলাদেশি পরিবার আছে যারা খুব অল্প সময়ে আমাদের খুব আপন করে নিয়েছেন। বিদেশে এসে পাশে পেয়েছি ড. সোহেল ভাইকে, মুস্তাফিজ ভাই-সানজিদা ভাবী, বন্ধু বুশরা এবং তার স্বামী মোহাইমেন ভাইকে, পেয়েছি জামান ভাই ও তার স্ত্রীকে এবং আরো দুই একটি পরিবার যারা বাসায় এক সের পোলাও রান্না হলেও দাওয়াত দিতে ভুলেন না।
বাসা দূরে হলেও গাড়ি দিয়ে নিয়ে যায়। প্রতিবার এদের বাসায় যখন খাই তখন এক টুকরো বাংলাদেশকে ফিরে পাই, ফিরে পাই বাসায় খাওয়ার স্বাদ। প্রতিবারই খাওয়া শেষে ঘরে ফিরে মোবাইল ফোনে মায়ের সঙ্গে শেয়ার করি কী খেলাম। আর মা আমার কৃতজ্ঞচিত্তে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’। বাংলা মায়ের প্রতিটি সন্তানই যেন থাকে দুধে ভাতে, বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইয়াংস্টাউন স্টেট ইউনিভার্সিটি, ওহাইয়ো, যুক্তরাষ্ট্র
ই-মেইল: rafiqh2689@gmail.com
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |