বহু বছর আগের কথা, ব্যতিব্যস্ত কাজ করছি আবুধাবি সেন্ট্রাল হাসপাতালের বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবের অফিসে - ল্যাবের ভেতর ব্যতিব্যস্ত আমার টেকনিশিয়ান টেকনোলজিস্টের দল। ফোন বাজল, ওধারে নারীকণ্ঠ।
- হাসান মাহমুদ বলছেন?
- বলছি!
- একজনের কাছ থেকে আপনার ফোন নম্বর পেয়েছি। আমাকে একটু হেল্প করতে হবে"।
হাসি পেল। যে যতবড়ো ‘হিরো’-ই হোকনা কেন যত ফুটানি মারুক না কেন, দিনশেষে হাসপাতালে সবাইকে কখনো না কখনো ভিখিরির মতো এসে দাঁড়াতেই হয়। আমার ওপরে আবুধাবির সব বাংলাদেশির অখণ্ড অধিকার, এমন ‘হেল্প’ করা আমার লেগেই আছে। ছোটখাট আইনও ভাঙ্গতে হয় কখনো। বললাম-
- বলুন!
- আমি পরশু ঢাকা থেকে এখানে ছেলের সংসারে এসেছি, - আগামী পরশু ফিরে যাব। এক পেশেন্টকে দেখতে চাই।
- চলে আসুন ভিজিটিং আওয়ারে, কোনো অসুবিধে নেই।
- না, ভিজিটিং আওয়ারে না। আমি আসতে চাই যখন বাইরের কেউ থাকবে না।
ধাক্কা খেলাম। বললাম, কোন্ পেশেন্ট?
নাম শুনে চুপ হয়ে গেলাম। উনার বাসায় কত আড্ডা দিয়েছি, বিরিয়ানি কাবাবের ভুরিভোজ খেয়েছি, হারমোনিয়াম বাজিয়ে একুশে ছাব্বিশে আর ষোলোই-এর অনুষ্ঠানের রিহার্সেল করেছি। সেই উনি আজ উনি ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে গভীর কোমা'তে লাইফ সাপোর্টে, জীবনের কোনো আশা নেই। এখানে তার স্ত্রী সন্তানেরা আছেন, এখন শুধু লাইফ সাপোর্ট সরিয়ে তাকে চলে যেতে দেবার অপেক্ষা।
বললাম, “উনি তো ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে, ওখানে অনেক রেস্ট্রিকশন!"
মিনতিভরা কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘দেখুন, উনাকে শুধু একটিবার দেখার জন্য আমি এতটা পথ পাড়ি দিয়েছি। অফিস ছুটি দিচ্ছিল না, রিজাইন করে এসেছি। প্লিজ, প্লি-জ একটা ব্যবস্থা করে দিন!
আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে এল - চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন?
- কি করবো – ছুটি দিচ্ছিল না। আমার এত বছরের চাকরী!
মনে হল জীবন এমন এক দাবী করেছে যা উপেক্ষা করা সম্ভবও নয়, উচিতও নয়।
বললাম- যখন বাইরের কেউ থাকবে না......তাহলে তো মাঝরাতে আসতে হয়"।
- তাই আসব, যখন বলবেন আসব”।
- আচ্ছা, রাত দু'টোয় আসুন - আমি ইমার্জেন্সির গেটে থাকব।
- আচ্ছা। আমি সবুজ শাড়ি পরে আসব, চিনতে পারবেন।
রাত দু'টোয় তিনি ট্যাক্সি থেকে নামলেন, সবুজ শাড়ি পরা। আইসিইউ ওয়ার্ডে ঢুকতেই হাসিমুখে ছুটে এলো ইজিপ্সিয়ান হেড নার্স সুমাইয়া, বলল –‘কি ব্যাপার, এত রাতে?
বললাম, পেশেন্ট দেখতে এসেছি।
সুমাইয়া মৃদু হেসে অন্যদিকে চলে গেল।
নাকেমুখে বিভিন্ন যন্ত্র থেকে লাগানো নানা রকম পাইপ আর টিউব, ধীরে বইছে নি:শ্বাস। চোখদুটো আগের মতই বন্ধ। সরু টিউবের ভেতর দিয়ে হাতের সুঁচে শরীরে ঢুকছে টিপিএন ফ্লুইড, টোটাল প্যারেন্টেরাল নিউট্রিশন। অচেতন যেসব পেশেন্ট খেতে পারেনা তাদের খাবার ওটা। আস্তে তিনি বসলেন বেডের পাশে চেয়ারে। পেশেন্টের হাত ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
- টোনা! আমি তোমার টুনি! মনে আছে ছোটবেলার কথা?’
আমি আকাশ থেকে পড়লাম, পুরো আকাশটাও আমার মাথায় হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। বিস্ফারিত, তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছি। এ শরীর এতদিন বিন্দুমাত্র সাড়া দেয়নি শত আহ্বানে তার বন্ধু বান্ধবের, স্ত্রীর এমনকি সন্তানদেরও। সেটা এখনো পড়ে আছে একই রকম নিষ্প্রাণ। ওই শরীর, ওই মন, ওই আত্মা কি আর কখনো কারো ডাকে সাড়া দেবে? তিনি ফিসফিস করে বললেন,
- তোমার অসুখের কথা শুনে ঢাকা থেকে তোমাকে দেখতে এসেছি!
তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছি। আগের মতই কাঠ হয়ে পড়ে আছে পেশেন্ট - ওটা মৃত শরীরে জীবন্ত আত্মা, নাকি জীবন্ত শরীরে মৃত আত্মা বলা কঠিন। কিন্তু আমি কল্পনাও করতে পারিনি ওই নিথর দেহের কোনও অতলান্ত গভীরে নড়তে শুরু করেছে রহস্যময় বিশাল কী যেন!
মহিলা কি এক অপার্থিব আত্মবিশ্বাসে ফিসফিস করে বললেন, ‘আমি জানি তুমি শুনতে পাচ্ছ! আমার কথা না শুনে তুমি পারবে না। সেই সবুজ শাড়িটা তুলে রেখেছিলাম! এত বছর পর আজ আবার পরেছি।’
অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল। কোন সুদূর অতীত থেকে কত বছরের ক্ষুধার্ত বাল্যপ্রেম ঝড়ের বেগে ছুটে এসে বোমার মতো বিস্ফোরিত হলো হতচেতন দেহের ভেতরে। থরথর করে কেঁপে উঠল দেহ, নড়ে গেল নাক-মুখের পাইপ, হাতের সুঁচ নড়ে গিয়ে ফিনকি দিয়ে ছুটল রক্ত। আতংকে চিৎকার করে উঠলাম- ‘সুমাইয়া!’ ছুটে এল নার্সের দল কিন্তু
সেই ভূমিকম্প থামায় কার সাধ্য। মহিলা ধরে আছেন তার হাত, কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন,
- শান্ত হও, শান্ত হও টোনা! তোমার টুনি তোমার পাশে এখনো আছে তো,....আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যাইনি...শান্ত হও...।
জানিনা শুনলেন কিনা, কিন্তু কি এক নিবিড় প্রশান্তিতে স্থির হয়ে এল দেহ । আমি তাকিয়ে আছি পাথরের মূর্তির মতো। পেশেন্টের হাতের একটা আঙ্গুল বাঁশপাতার মতো তিরতির করে নড়ছে, মহিলা অনেক আদরে সেই আঙ্গুলটা ছুঁয়ে রইলেন। যেন দুটো টোনাটুনি পাখি এ পৃথিবী ছেড়ে যাবার আগে জীবনের শেষবার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে কথা বলছে। এদিকে সুমাইয়ার চোখে ফুটে উঠেছে মিনতি। মহিলা সেটা বুঝলেন। ক্ষুধার্তের মতো হাত বুলোলেন অচেতন রোগীর চোখে মুখে গালে কপালে বুকে, তারপর গভীর নি:শ্বাস ফেলে বললেন, "চলুন"।
বাইরে ট্যাক্সিতে উঠতে গিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকালেন। সে চোখে ফুটে উঠেছে অনুরোধ। আস্তে করে বললাম,
-কেউ জানবে না।
মহিলা নিজের মনে বললেন, ‘আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না’।
তারপর একটু থেমে বললেন, ‘আপনাকে অনেক, অনেক ধন্যবাদ’।
আমি চুপ করে রইলাম, ট্যাক্সি চলে গেল।
আমি সম্মোহিতের মতো, মূর্তির মতো অপলক হতবাক দাঁড়িয়ে আছি সেই মরুভুমির মাঝরাতে উন্মুক্ত আকাশে অসংখ্য নক্ষত্রের নীচে।
পরদিন পেশেন্ট-এর লাইফ সাপোর্ট সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কোনও এক টোনা বোধহয় তার ছোটবেলার টুনির জন্য জীবনের শেষ দড়িটা কোনরকমে ধরে রেখেছিল, তারপর অনন্তে উধাও হয়ে গেল।
লেখক পরিচিতি: ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেসের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য, মুসলিমস রিফর্ম মুভমেন্ট ও আমেরিকান ইসলামিক লিডারশিপ কোয়ালিশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিয়মিত কলামনিস্ট।
লেখকের ইমেইল: badrul.mahmud@yahoo.com
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |