শিশুদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীদের উদ্যোগ ‘ডিসিআই’

মা হাসিনা বেগমের সন্তানের চোখ অন্ধ হতে চলছিল। ৫ বছর বয়সেই সেই সন্তানের ৭ দফা অস্ত্রোপচার করতে হয়। শেষ পর্যন্ত চোখ রক্ষা পেয়েছে নিশ্চিত অন্ধত্ব থেকে। তবে সেই চোখ কখনোই স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়নি। সেই সন্তানটিই এখন পিছিয়ে পড়া সমাজের অন্য ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার ব্রত নিয়েছেন।

নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Nov 2018, 05:12 AM
Updated : 27 Nov 2018, 05:12 AM

বরিশালের সেই সন্তানটি এখন যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাটে ইয়েল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এহসান হক। তার অবসর ব্যয় করছেন বাংলাদেশের গরিব পরিবারের শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য। দৃষ্টিশক্তি নিয়ে সমস্যায় থাকা গরিব পরিবারের শিশুদের পুনর্বাসিত করার সুযোগ সৃষ্টির কার্যক্রমে হাত দেন তিনি। ২০০৩ সালে গঠন করেন ‘ডিস্ট্রেসড চিল্ড্রেন অ্যান্ড ইনফ্যান্টস ইন্টারন্যাশনাল’ (ডিসিআই)।

এটি ইয়েল ইউনিভার্সিটির সেবামূলক একটি প্রকল্পের অনুমোদন পেয়েছে। এর নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন এহসান। সঙ্গে রয়েছেন ইয়েলের আরো কয়েকজন কর্মকর্তা-শিক্ষক। মাসিক ১৫ ডলার করে প্রকল্পে অনুদান দিচ্ছেন অসংখ্য আমেরিকান। এর মধ্যে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ছেলে-মেয়েরাও আছেন। নীলফামারি, পটুয়াখালি, হবিগঞ্জ ও বৃহত্তর ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ১০ হাজারের বেশি শিশু-কিশোর শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। লেখাপড়ার সুবিধার্থে তারা পোশাক পাচ্ছে, তাদের দরিদ্র পিতা-মাতাকেও নানা সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। নিয়মিত চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে এসব শিশু ও তাদের মা-বাবা-ভাই-বোনেরা। গরিবের চেয়েও গরিব পরিবারের চেহারা পাল্টে দিতে মৌলিক কাজগুলো করছে ডিসিআই।

এহসান বলেন, “বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পিছিয়ে থাকা গরিবের চেয়েও গরিব পরিবারের শিশুদের স্কুলে ভর্তির পর ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত লেখাপড়ার খরচ দিচ্ছি। এরপর কেউ যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়, তাহলে সেই শিশুর স্পন্সরকে অনুরোধ করি লেখাপড়া অব্যাহত রাখতে। বর্তমানে কমপক্ষে ২৫ জন যাচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে।”

এহসান জানান, প্রতি বছরই ডিসিআইয়ের উদ্যোগে জাতীয়ভিত্তিক একটি সম্মেলন হয় যুক্তরাষ্ট্রে। সামনের বছর হবে ইয়েল ইউনিভার্সিটিতেই। সেখানেও দুই-তিনশ ছেলে-মেয়ে আসবেন যারা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। এরা ভার্সিটিতে পড়ছেন এবং ডিসিআইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। এভাবেই ডিসিআইয়ের কর্মপরিধি বিস্তৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের সীমানা পেড়িয়ে ভারত, নেপাল এবং নিকারাগুয়ায় ঠেকেছে।

সম্প্রতি কানাডায় ডিসিআইয়ের শাখা গঠিত হলো। সেখানে অতিথি ছিলেন ডিসিআইয়ের শুভেচ্ছা দূত চিত্রনায়িকা ববিতা। কানাডার তরুণ-তরুণীরা এটি পরিচালনা করবেন। সঙ্গে রয়েছেন অভিভাবকরাও। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশু এবং তাদের পরিবারের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে ডিসিআই। এসব কর্মসূচির মধ্যে সানচাইল্ড স্পন্সরশিপ, ব্লাইন্ডনেস প্রিভেনশন প্রোগ্রাম, হেল্থ ফর আন্ডারপ্রিভিলেজড ও সান চাইল্ড অরফ্যানেজ উল্লেখযোগ্য।

ডিসিআই এর প্রতিষ্ঠা থেকেই ইয়েল ইউনিভার্সিটির চক্ষু বিশেষজ্ঞ ব্রায়ান ডিব্রোফ এর সঙ্গে রয়েছেন। বর্তমানে ব্রায়ানের নেতৃত্বাধীন একটি চক্ষু গবেষণা প্রকল্পে খণ্ডকালিন সহযোগী হিসেবে রয়েছেন এহসান। গত দেড় দশকে হাজার হাজার শিশুকে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার সহায়তা করার পাশাপাশি এতিম শিশুদের জন্য স্থায়ী একটি আবাসের চেষ্টা করছেন। ইতোমধ্যে তিনটি প্লট পেয়েছেন বলে জানান এহসান। ডিসিআইয়ে সম্পৃক্ত ৮৭ হাজার গরিব মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়েছে। প্রতিরোধক চিকিৎসা দেওয়া হয় ৯১ হাজার গরিবকে। দুই হাজার নয়শ প্রসূতিকে চিকিৎসাসেবার আওতায় নেওয়া হয়েছে। ১৪৭৫ নবজাতক পেয়েছে পুষ্টিকর খাদ্য-সুবিধা। যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসকের কাছে থেকে টেলিমেডিসিন পেয়েছেন ৪০৯ জন।

এসময়ে ডিসিআইয়ের উদ্যোগে পরিচালিত চক্ষু চিকিৎসা শিবির থেকে বিনামূল্যে সেবা পেয়েছেন ৫৬ হাজার বাংলাদেশি। পাঁচ হাজার ৭০০ জনের চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। সাড়ে তেরো হাজার জনকে বিনামূল্যে চশমা দেওয়া হয়। ডিসিআই প্রকল্পের শিশুদের ৮ শতাধিক পরিবারকে কৃষিজ সরঞ্জাম দেওয়া হয় শস্য উৎপাদনের জন্য।

গত ৩ নভেম্বর কানাডায় ডিসিআই কানাডা শাখার ‘চিল্ড্রেন হেল্পিং চিল্ড্রেন’ এর কার্যক্রম শুরু হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ববিতার পাশে বিশেষ অতিথি ছিলেন অন্টারিও প্রভিন্সিয়াল পার্লামেন্ট সদস্য ডলি বেগম, প্রধান বক্তা ছিলেন এহসান হক।

অনুষ্ঠানে ‘চিল্ড্রেন হেল্পিং চিল্ড্রেন’ প্রোগ্রামের রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে বক্তব্য দেন রিহা ও তাসিন। তারা কীভাবে বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদেরকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সাহায্য করে তার বিস্তারিত বর্ণনা ও প্রচেষ্টা তুলে ধরে।

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক শহিদুল হক খন্দকার ও সাধারণ সম্পাদক সাজেদুন নাহার অতিথিদের শুভেচ্ছা জানান। ‘চিলড্রেন হেলপিং চিলড্রেন’ এর কর্মসূচি তুলে ধরেন সংস্থাটির গণমাধ্যম সম্পাদক কাউসার সাহাব। সার্বিক পরিচালনায় ছিলেন মাসুদ হাকিম ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হালিমা আখতার প্রীতি।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!