ফিনল্যান্ডের ডায়েরি: প্রবাসীর প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি

১২ নভেম্বর অন্যরকম অনুভূতির একটি দিন। ১৯৯৬ সালের নভেম্বরের ১২ তারিখ। ভাগ্য গড়তে শুভ্রস্বচ্ছ তুষার আবৃত ভূখণ্ডে বাদামি বর্ণের এক বাঙালি যুবকের আগমন।

পলাশ কামালী, ফিনল্যান্ডের হেলসিংকি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Nov 2018, 04:05 AM
Updated : 12 Nov 2018, 04:05 AM

সবই অচেনা অজানা। এক ভিন্নধর্মী অনুভূতি। স্বপ্নভরা আঁখি আর বুকভরা প্রত্যাশা। ভাবনায় কল্পনায় শুধুই মাসুদ রানার এগিয়ে চলার দৃঢ় দৃপ্ত শপথ। লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনের সিরিয়াল উপন্যাস মাসুদ রানা। আমার খুবই প্রিয় সিরিজ ছিল। মাসুদ রানা সিরিজের সবগুলো পর্বই তখন রপ্ত ছিল। নিজেকে মাসুদ রানার চরিত্র ভেবে সব প্রতিকূলতায় নিজেকে প্রস্তুত রাখার চেষ্টায় থাকতাম।

ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকিতে সেই বাঙালি টকবকে যুবকের আগমন। জীবনের প্রথম ভিনদেশে আসা। কী করবো, কী করা উচিত ভাবছি আমি। হেলসিংকির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা ও পরিচ্ছন্নতা দেখে ঈর্ষান্বিত হয়েছিলাম আমি। জীবনের প্রথম ভিনদেশি বিমানবন্দর দেখা। আমার দেশের ঢাকা বিমানবন্দরের জন্য মৃদু কষ্টবোধ হয়। বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি নিয়ে যাত্রা শুরু অচিন দেশে।

হঠাৎই সাদা সাদা রাশি রাশি তুষারপাত। স্বাগত জানাচ্ছে আমায়! নাকি তিরস্কারের ফুলঝুরির ধবল পাপড়ি ছড়াচ্ছে! নানা জল্পনা কল্পনা মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারছে। শুভ্র তুষারকণা সবই ট্যাক্সির গ্লাসে আছড়ে পড়ে লেপ্টে যাচ্ছে। আর উইপার যুগল ডান-বাম করে চলার পথ দৃশ্যমান করতে পরিষ্কারের আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। ট্যাক্সি বিমানবন্দর থেকে ১০০ কিলোমিটার ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে চলেছে গন্তব্য পানে।

চোখ জুড়িয়ে জীবনের প্রথম শুভ্র তুষার কণার অবলোকন, এটাই যে আমার জীবনের প্রথম তুষার বিলাস। সেটা লজ্জাহীনভাবে বলতেই পারি, চারদিক স্বচ্ছ সাদা বরফের চাদরে ঢাকা। ট্যাক্সির কাচ ভেদ করে আমার দৃষ্টি শুভ্রতায় বিমোহিত। চক্ষুযুগল দূরদৃষ্টি সাদা তুষার ভেদ করে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে? হয়তো জীবনের নতুন ঠিকানা। নতুন এক অচেনা জীবনের অধ্যায়! অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম।

চারদিকে শুধু শেতাঙ্গ মানুষের আনাগোনা। নিজ বর্ণের একজনও এখন পর্যন্ত দৃষ্টিপটে আসেনি।  ইংরেজি ভাষায় কুশলাদি বিনিময় করলাম। আমার পরিচয় দেবার চেষ্টা ও সঙ্গে সহযোগিতা কামনাও যে ছিল আমার! হাত-মুখ ধুয়ে খাটের উপর চিত হয়ে শুয়ে পড়লাম। প্রায় ২৪ ঘণ্টার আকাশযাত্রায় বড্ড ক্লান্ত। রুমের বৃহৎ কাচের জানালার দিকে চেয়ে আছি। কাচ ভেদ করে আমার চক্ষুযুগল বহুদূরে কোথাও স্থির হয়ে আছে। ভাবনায় শুধু কী করছি? গতকাল পড়ন্ত বিকেলে মা-বাবার স্বপ্নের চাহনি আমি দেখেছি। আমার জন্য ভালো থাকার আর্শিবাদ ছিল তাদের মমতায় ও ভালোবাসায়।

আমি শুধু মা-বাবার পদধূলি মাথায় নিয়েছিলাম। আর ‘দুআ করো’ বলে বিড়বিড় করেছিলাম। মা-বাবার আর্শিবাদে আর উপর আল্লাহর ইচ্ছায় ভিনদেশে এক এক করে অনেকগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম। কী পেয়েছি দীর্ঘ প্রবাস জীবনে? জানি না। কী হারিয়েছি? সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ আমার মা। শুরুতেই পাঁচ বছরের মাথায় মা আমায় ফাঁকি দিয়ে ওই দূর আকাশে চলে গেছেন। মায়ের ওই অনাকাঙ্খিত চলে যাওয়া আজও আমায় কাঁদায়।

জীবনদশায় মায়ের ভালোবাসার শেষ স্পর্শ ১৯৯৬ সালের ১১ নভেম্বর। বাবাও ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন ২০১৭ সালের অগাস্টে। আমার ভালোবাসা-আস্থা-ভরসার জায়গাগুলো আমি হারিয়ে ফেলেছি। জীবন থেকে ভিনদেশে যৌবনের শ্রেষ্ঠ বছরগুলো কাটিয়ে দিলাম। যা পেয়েছি তার অনেকগুন বেশি হারিয়েছি। যা হারিয়েছি তা যে আমার পরম সম্পদ ছিল। সেটা বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। এটাই বোধ হয় প্রায় দুই যুগ প্রবাস জীবনে পরম প্রাপ্তি আমার।

অঙ্কের হিসাবে অর্থ-প্রাচুর্য বিলাসিতায় প্রাপ্তি হয়তো স্থূলকার হয়েছে। কিন্তু আমার প্রবাস জীবনে হারানো সম্পদের হিসাব গাণিতিকভাবে বের করা একেবারেই দুঃসাধ্য। বলতে দ্বিধা নেই, দুর্ভাগারাই শুধু প্রবাসী হয়। প্রবাসীরা সব স্থানেই পরবাসী হয়ে যায়। আর প্রবাসীর নীরব কান্না বিলাসবহুল পাঁচ তারকায় ঝিকিমিকি আলোকরশ্মি হয়ে প্রতি রাতেই ডান্স ফ্লোরে ঝড়ে পড়ে।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!