যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সিটি কাউন্সিলের নেতৃত্বে ১১ বাংলাদেশি

নিজেদের মধ্যে সমঝোতার সঙ্কটে নিউ ইয়র্ক সিটির কাউন্সিলম্যান এবং মিশিগান অঙ্গরাজ্যের হ্যামট্রমিক সিটি মেয়র নির্বাচনে জয়ী হতে না পারলেও যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি সিটির মূলধারার রাজনীতিতে ১১ বাংলাদেশি আসন পেয়েছেন।

নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Nov 2017, 05:12 PM
Updated : 23 Nov 2017, 05:17 PM

এসব সিটি কাউন্সিল নির্বাচনে জয়ী বাংলাদেশিরা সবাই ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী ছিলেন।

৭ নভেম্বরের পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের মিলবোর্ন বরো এবং আপার ডারবি টাউনশিপের সর্বশেষ নির্বাচনে নিজেদের অবস্থান অটুট রাখতে পেরেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত আমেরিকান নাগরিকরা।

নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যের হেলডন সিটির কাউন্সিলওম্যান তাহসিনা আহমেদ পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। একই অঙ্গরাজ্যের প্লেইন্স বরো টাউনশিপে কাউন্সিলম্যান হিসেবে আগে থেকেই দায়িত্ব পালন করছেন মুক্তিযোদ্ধা ও বিজ্ঞানী নূরন্নবী।

নুরুন্নবী

নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের প্যাটারসন সিটি কাউন্সিলের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরও দায়িত্ব নিতে এক বছর আইনগত লড়াই চালাতে হয়েছে শাহীন খালিককে।

মাত্র ২০ ভোটে পরাজিত হওয়ার পর আরেক বাংলাদেশি প্রার্থী মোহাম্মদ আকতারুজ্জামান তার বিরুদ্ধে মেইল ভোট-জালিয়াতির অভিযোগ করেছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে ৩ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি বসবাস করেন। তবুও এখন পর্যন্ত কংগ্রেসম্যান হওয়া দূরের কথা এই সিটির কাউন্সিলম্যান (ওয়ার্ড কমিশনার) ও নির্বাচিত হতে পারেননি কোনও বাংলাদেশি।

গত ৭ নভেম্বরের নির্বাচনে ডেমক্র্যাট প্রাইমারিতে হেরে যাওয়ার পর রিফর্ম পার্টির প্রার্থী হিসেবে ব্যালটে নাম রয়ে যায় বাংলাদেশি তৈয়বুর রহমান হারুনের।

তাসনিয়া আহমেদ

এটি ছিল ২৪ নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিলের ২৪ নম্বর ডিস্ট্রিক্টে। এই নির্বাচনী এলাকার অধীনে রয়েছে জ্যামাইকা, জ্যামাইকা হিলস, পার্কওয়ে ভিলেজ, ব্রায়ারউড, জ্যামাইকা এস্টেট, হিলক্রেস্ট, ফ্রেশ মেডোজ, ইলেক্টচেস্টার, পমোনক এবং কিউ গার্ডেন্স এলাকা।

এখানকার মোট ভোটারের ২৫ শতাংশের কাছাকাছি বাংলাদেশি। এশিয়ান ভোটারের সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি। হারুন ছিলেন একমাত্র এশিয়ান প্রার্থী। তবুও জয়ী হতে পারেননি নির্বাচনে।

মোট ভোটের ৮৮ শতাংশ পেয়েছেন ররি ল্যাঙ্কমেন। অপরদিকে হারুন পেয়েছেন মাত্র ১১ শতাংশ। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ানরা তো বটেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী বাংলাদেশিরাও তাকে ভোট দেননি।

শেখ মোহাম্মদ সিদ্দিক

নিজেদের মধ্যে ঐক্য না থাকার কারণেই একজনও নির্বাচিত হতে পারেননি বলে মানছেন এখানকার প্রবাসীরা।

মিশিগান অঙ্গরাজ্যের হ্যামট্রমিক সিটির মোট ভোটারের অধিকাংশই মুসলিম জনগোষ্ঠির। এর অন্যতম বড়ো অংশ বাংলাদেশিরা।

গত কয়েকবারে এ সিটির ৬ কাউন্সিলম্যানের ৪ জনই বাংলাদেশি ছিলেন। অর্থাৎ ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশি বংশোদ্ভুতদের প্রভাবে আসছিলো এই সিটি।  সেই প্রেরণা থেকেই এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছিলেন বিদায়ী কাউন্সিলম্যান মোহাম্মদ হাসান। বর্তমান মেয়রকে মোহাম্মদ হাসানসহ আরেক বাংলাদেশি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন দলীয় প্রাইমারিতে।

নুরুল হাসান

অর্থাৎ ডেমক্র্যাটিক পার্টি থেকেই দুই বাংলাদেশি পরস্পরের বিরুদ্ধে ভোট চাওয়ায় অন্য দেশের ভোটারের মধ্যে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। প্রাইমারিতে মোহাম্মদ হাসান টিকে গেলেও বাংলাদেশি ভোটারের মধ্যেকার বিভক্তি অবসানে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেননি বলে নির্বাচনে পরাজিত হন তিনি।

বর্তমান মেয়র ক্যারেন মাজেওয়াস্কি ৬১ শতাংশ ভোট পেয়ে চতুর্থবারের জন্য পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন।

হ্যামট্রমিকের প্রতিবেশি ডেট্রয়েট সিটির বাংলাদেশিদের অনেকেই এই পরাজয়ের জন্যে হাসানকেই দায়ী করেছেন। ‘ইগো’ প্রবলেম দূর করতে সক্ষম হলেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম বাংলাদেশি মেয়র হতে পারতেন বলেও কম্যুনিটি নেতাদের বিশ্বাস।

শাহীন খালেক

হ্যামট্রমিক সিটির ৬ কাউন্সিলরের মধ্যে এখন মাত্র দুই জন বাংলাদেশি রয়েছেন। এরা হলেন- আবু মুসা এবং এনাম মিয়া।

পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের ফিলাডেলফিয়া সিটির ডেপুটি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নীনা আহমেদ। এই সিটির ভোটারের মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা খুব কম। তবুও নীনা আহমেদ এশিয়ানদের মধ্যে নিজের কর্মতৎপরতার মাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছেন। অধিকার ও মর্যাদা আদায়ের প্রশ্নে হিসপ্যানিকরাও নীনাকে আপন ভাবেন।

এই সিটির পাশেই যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় টাউনশিপ আপারডারবি। ৬৫ ভাষার মানুষের এ সিটির ভোটার এক লাখের মত। ১১ জন কাউন্সিলম্যানের মধ্যে মাত্র একজন বাংলাদেশি রয়েছেন। শেখ মোহাম্মদ সিদ্দিক নিজের অবস্থানকে সুসংহত রাখার পাশাপাশি কম্যুনিটির লোকজনকে মূলধারায় আরো বেশি সম্পৃক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তার মেয়াদ শেষ হবে ২০১৯ সালে।

মনসুর আলী মিঠু

বাংলাদেশ সোসাইটি অব পেনসিলভেনিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শেখ সিদ্দিক বৃহত্তর ফিলাডেলফিয়ার প্রবাসীদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ও বাঙালি সংস্কৃতিকে বহুজাতিক এ সিটিতে সমুন্নত রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন।

শেখ সিদ্দিক বলেন, “প্রবাসীরা সংঘবদ্ধ থাকলে এখানে অনেক কিছুই করা সম্ভব।”

ফিলাডেলফিয়া এবং আপার ডারবির মধ্যে অবস্থিত মিলবোর্ন সিটি, যার জনসংখ্যা ১২০০।

এই সিটির ৫ কাউন্সিলম্যানের ৪ জনই বাংলাদেশি। এরা হলেন নূরুল হাসান, ফেরদৌস ইসলাম, মনসুর আলী মিঠু এবং মাহবুবুল আলম তৈয়ব।

আনাম মিয়াহ

অপর কাউন্সিলম্যান হলেন ভারতীয় আমেরিকান জাস্টিন স্কারিয়াহ। তিনিই হচ্ছেন এই সিটি কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট। অপরদিকে, আসছে জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন কাউন্সিলে ভাইস প্রেসিডেন্ট হতে পারেন নূরুল হাসান।

নানাবিধ কারণে প্রেসিডেন্ট পদটি এখনও নিজেদের আয়ত্বে আনা সম্ভব হয়নি, তবে ভেতরে ভেতরে চেষ্টা চলছে বলে জানালেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাংলাদেশি।

নূরুল হাসান বলেন, “জানুয়ারিতে নতুন কাউন্সিলের শপথ গ্রহণের পর সকলের সমর্থনে যদি ভাইস প্রেসিডেন্ট হতে পারি তবে সর্বপ্রথম কাজ হবে সর্বসাধারণের জন্যে ট্যাক্স রিবেট ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটানো।”

আবু মূসা

“ট্যাক্স প্রদানকারিদের স্বার্থ সুরক্ষার পাশাপাশি নিরাপদ জীবন-যাপনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবো। সকলেই যাতে নিজ নিজ ধর্ম-কর্ম এবং কালচার লালন-পালনে কোনও বাঁধার সম্মুখীন না হন-সে চেষ্টা সবসময়ই ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত বাঙালি সংস্কৃতি নতুন প্রজন্মে বিকাশের প্রক্রিয়াকেও সহায়তা দেয়া হবে এই সিটিতে।”

তবে এই সিটির পুরো নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশিদের হাতেই বলে মনে করছেন অনেকে। বৃহত্তর ফিলাডেলফিয়া এলাকায় ১২ থেকে ১৫ হাজার বাংলাদেশী বসবাস করছেন। জাতীয় ইস্যুতে তাদের মধ্যে ঐক্য থাকায় ফিলাডেলফিয়া সিটি হলের পাশের রাস্তায় বাংলাদেশের পতাকাও শোভা পাচ্ছে। আসছে বিজয় দিবসে সেখানে ঘটা করে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানোর চেষ্টার কথা জানালেন ডেপুটি মেয়র নীনা আহমেদ।

ফেরদৌস ইসলাম

নিউ জার্সির হেলডন সিটি কাউন্সিলওম্যান হিসেবে পুনরায় বিজয়ী হয়েছেন তাহসিনা আহমেদ। নিউ জার্সির পার্সপ্লেনিতে জন্মগ্রহণকারি তাহসিনা মা-বাবার সাথে দু’বছর বয়সে হেলডনে বসতি গড়েছেন। বর্তমানে তিনি মনমাউথ ইউনিভার্সিটিতে সমাজকর্মে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিচ্ছেন।

অধ্যয়নরত অবস্থাতেই তিনি কম্যুনিটি সার্ভিসের পথ ধরে ৩ বছর আগে সিটি কাউন্সিলে জয়ী হয়েছেন। এবার পুনর্নির্বাচিত হওয়ায় তাহসিনার স্বপ্নের দিগন্ত আরো বিস্তৃত হলো। তিনি মাস্টার্স শেষ করে জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে অংশ নিতে আগ্রহী। তবে সবটাই নির্ভর করছে দলীয় সিদ্ধান্তের ওপর।

তাহসিনার বাবা সিলেটের গোলাপগঞ্জের লক্ষ্ণীপাশা গ্রামের সন্তান আমিন উদ্দিন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্কুল বোর্ডে দুই বার লড়েও জয়ী হতে পারেনি তাহসিনা। এরপর ডেমক্র্যাটিক পার্টি তাকে কাউন্সিলম্যানের পদে দাঁড়া করায়।”

মাহবুবুল আলম তৈয়ব

“এভাবেই তার কর্ম-এরিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। আমরাও তাকে সর্বাত্মক সহায়তা দিচ্ছি।”

তাহসিনার একমাত্র ছোটভাই স্নাতক করে পুলিশ একাডেমিতে গেছেন। তার বাবা ৩৮ বছর যাবত যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। এই সিটির প্রবাসী দেওয়ান বজলু ২০০৮ সালে স্কুল বোর্ডে লড়েছেন। জয়ী হতে পারেননি। তবুও তিনি থেমে যাননি। গত ৯ বছর যাবত হেলডনের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনিও তাহসিনার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করেছেন।

এই অঙ্গরাজ্যের প্লেইন্সবরো টাউনশিপে গত তিনবারই নির্বাচিত হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা ও বিজ্ঞানী নূরন্নবী। তিনিও ডেমক্র্যাটিক পার্টির রাজনীতিতে আরও এগিয়ে যেতে আগ্রহী। সে লক্ষ্যে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর থেকেই মাঠে রয়েছেন।

নীনা আহমেদ

মিশিগানের হাশিম ক্লার্ক কংগ্রেসম্যান হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশকে বিশেষ এক আসনে নিয়ে যান। কিন্তু তিনি পুননির্বাচিত হতে পারেননি।

এরপর জর্জিয়া, ক্যালিফোর্নিয়া, টেনেসি প্রভৃতি এলাকা থেকে ইউএস কংগ্রেসে কয়েকজন বাংলাদেশি প্রার্থী হলেও এখন পর্যন্ত কেউই জয়ী হতে পারেননি।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!