তাদের বিচার ইতিহাসই করেছে, সত্য উদ্ভাসিত: প্রধানমন্ত্রী

“আজকের যুব সমাজ ইতিহাস জানতে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী, এটাই সবচেয়ে বড় বিচার,” বলেন প্রধানমন্ত্রী।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Jan 2023, 02:19 PM
Updated : 25 Jan 2023, 02:19 PM

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারীদের বিচার ‘প্রাকৃতিকভাবেই হচ্ছে’ মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ইতিহাসের বিচারে ‘তারা‘এখন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে; আর সত্য ‘উদ্ভাসিত’ হয়েছে।

বুধবার জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে জাতীয় পার্টির এক সংসদ সদস্যের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীর এ উত্তর আসে। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিকালে সংসদের অধিবেশন বসে।

সম্পূরক প্রশ্নে জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান জানতে চান, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কোনো ধরনের আইন সরকার করবে কি না।

জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি শুরু হয় ১৯৭৫ এর পর; যারা জাতির পিতাকে হত্যা করেছিল এবং হত্যার পর যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিল…। এ ইতিহাস বিকৃতি ধারাবাহিকভাবে ২১ বছর চলতে থাকে।

“আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের মানুষকে সেই বিকৃতির ইতিহাস থেকে মুক্তি দেয়। আজকে বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুধু উদ্ভাসিত হয়নি, দেশের মানুষ ও নতুন প্রজন্ম এই ইতিহাস জানার সুযোগ পাচ্ছে। আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস, স্বাধীনতা অর্জন এখন আর কেউ বিকৃত করতে পারবে না।”

শেখ হাসিনা বলেন, “ইতিহাস যারা বিকৃতি করেছে, আমি যদি ঠিক ৯৬ এর আগে যাই, তাহলে কাকে রেখে কার বিচার করব? এটা হল বাস্তবতা।

“আমি দেখি ৭৫ এর পরে যারাই ছিলেন, এমন কি যারা সত্য কথাটাও জানতেন, তারাও মিথ্যার ওপর আশ্রয় নিয়েছিলেন। এটা হচ্ছে দুর্ভাগ্যের বিষয়। রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকা- পুরনো দিকটায় তাকালে কেউই বাদ যায়নি। খুব স্বল্প সংখ্যক মানুষ এর প্রতিবাদ করেছেন বা সঠিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতাটা বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন।”

এদের মধ্যে ‘কাকে রেখে কার বিচার’ করা হবে, সেটাও একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে মন্তব্য করে সংসদ নেতা বলেন, “আমি স্পষ্ট কথা বলি। যারা ইতিহাস বিকৃত করেছে, ইতিহাসই তাদের বিচার করে দিয়েছে।

“ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। মিথ্যা দিয়ে সত্যকে ঢেকে রাখা যায় না। যারা ইতিহাস বিকৃত করেছিল, তাদের চরিত্রটা মানুষের কাছে আজ প্রকাশ পেয়েছে। কত জঘন্য কাজ তারা করে গেছে।”

ইতিহাসের বিচার কীভাবে হয়েছে, সেই ব্যাখ্যায় শেখ হাসিনা বলেন, “যে ইতিহাস স্বাধীনতা সংগ্রামের আত্মত্যাগের ইতিহাস, সেই ইতিহাসই তো মুছে ফেলা হয়েছিল। সেই ইতিহাস আজকে আবার মানুষের সামনে প্রকাশ পেয়েছে। মানুষ এখন তা চর্চা করছে, জানার চেষ্টা করছে, বিশেষ করে যুব সমাজ। আজকের যুব সমাজ ইতিহাস জানতে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী, এটাই সবচেয়ে বড় বিচার।

বিচারের ভার আপনাদের: প্রধানমন্ত্রী

“যারা সত্যটাতে মিথ্যা দিয়ে ঢাকতে চেয়েছিল, তারাই আজকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে চলে গেছে। তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে, সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে। সত্য অনেক কঠিন। কিন্তু সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। বিচার এটা প্রাকৃতিকভাবেই তাদের হচ্ছে।”

‘মূল্যায়নের ভার জনগণের ওপর’

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমামের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকারের সফলতা-বর্থ্যতা যাচাই করবে জনগণ।

এ সংসদ সদস্য সম্পূরক প্রশ্নে জানতে চান- প্রধানমন্ত্রীর সফলতার কথা সবাই জানেন, সফল প্রধানমন্ত্রীর ব্যর্থতাগুলো কী?

এর জবাবে শেখ হাসিনা দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, কোনটা সফল হওয়া, কোনটা বিফল হওয়া, সেটা নয়। সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ করতে হবে। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হবে।

“সততা ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে জনগণের কল্যাণ বিবেচনা করে কাজ করলে ব্যর্থ হব কেন? কোথায় সাফল্য, কোথায় ব্যর্থতা সেটা জনগণই বিচার করবে। মাননীয় সদস্য, যখন এতই আগ্রহ, তাহলে আমার ব্যর্থতাগুলো আপনিই খুঁজে বের করে দিন, আমি সংশোধন করে নেব।”

‘প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা’

এ কে এম রহমতুল্লাহর এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমান বন্দি যুদ্ধাপরাধীদের ‍মুক্ত করে দেয়, তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।

“সংবিধানের ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদের আংশিক বিলুপ্ত করে তাদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয়। ভোটের অধিকার দেয়। জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের উপদেষ্টা বানায়, মন্ত্রী বানায়। তার স্ত্রী খালেদা জিয়াও ক্ষমতায় এসে এদের কেবিনেটে স্থান দেয়। মন্ত্রী বানায়।

“এভাবে যুদ্ধাপরাধীদের প্রশ্রয় দেওয়া একটি জাতির জন্য কলঙ্কজনক। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, যারা জিয়ার সাথে হাত মেলাতে রাজি ছিল না, তাদের নাম বাদ দেওয়া, অপমানিত করা এবং যারা মুক্তিযোদ্ধা নয়, তাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। …প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান তারা দিতে চায়নি।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “৭৫ এর পরে এমন একটা সময় গেছে যে মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে সেটা বলতেও ভীতসন্ত্রস্ত ছিল। তখন একে একে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হত্যা করা হয়। চাকরিচ্যুত করা হয়। অপমানিত করা হয়। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরিও দেওয়া হত না। এমন ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। সাথে সাথে ইতিহাসও বিকৃত করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলা হয়।

“সেগুলো যাচাই-বাছাই করে অনেকগুলো ইতোমধ্যে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা যাতে তালিকায় থাকে, সেই প্রচেষ্টা করার।”

গণহত্যার ‘আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি’ আদায়ের পদক্ষেপ

এর আগে এ কে এম রহমতুল্লাহর লিখিত প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকেই মহান মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে কূটনৈতিক পর্যায়ে নানা পদক্ষেপ চালিয়েছি।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বাংলাদেশে চালানো হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য গত বছর ১৪ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে একটি প্রস্তাব আনা হয়। পরে প্রস্তাবটি বিবেচনার জন্য প্রতিনিধি পরিষদে পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির কাছে পাঠানো হয়। প্রস্তাবটি যাতে বিবেচিত হয়, সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ ‘ঐকান্তিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা’ চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “মার্কিন আইনপ্রণেতাদের উত্থাপিত এই প্রস্তাবটি বর্তমান সরকারের কূটনৈতিক সফলতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ প্রস্তাবের মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রকেই নয় বরং স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অগণিত মানুষের আত্মত্যাগ, বিশেষত মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের ও বীরঙ্গনা মা-বোনদের সম্মানিত করা হয়েছে।”