প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাকে নিয়ে নিজের লেখার সংকলন ‘শেখ ফজিলাতুন নেছা আমার মা’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন; যেখানে বঙ্গমাতাকে লেখা বঙ্গবন্ধুর এক আবেগঘন চিঠিও স্থান পেয়েছে।
সোমবার সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে ঢাকায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৯২তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন এবং বঙ্গমাতা পদক প্রদান অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে তিনি এ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন।
বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে প্রধানমন্ত্রীর লেখার ওই সংকলনে তার মা ফজিলাতুন নেছাকে কারগার থেকে লেখা জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের এক আবেগঘন চিঠিও রয়েছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় ১৯৫৯ সালের ১৬ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু চিঠিটি লিখেছিলেন। ওই বছর কোনো এক ঈদের পরে তার সহধর্মিনী ফজিলাতুন নেছা কারাগারে তার সঙ্গে দেখা করে যাওয়ার পর তিনি চিঠিটি লিখেছিলেন।
কারাগারে থাকায় সন্তানদের ঈদ আনন্দ মাটি হয়ে যাওয়ায় বঙ্গবন্ধুর দুঃখবোধের কথাও উঠে এসেছে চিঠিতে।
এতে তিনি সন্তানদের কারাগারে দেখা করার সময় নিয়ে না আসায় সবার খারাপ লাগার কথা তুলে ধরেন এবং কিছুটা অনুযোগও করেন। পরের সাক্ষাতে সন্তানদের নিয়ে আসার জন্য বেগম ফজিলাতুন নেছাকে অনুরোধ করেন।
চিঠির মাধ্যমেও বঙ্গব্ন্ধু পরিবারের সবার খোঁজখবর নেন এবং সন্তানদের নাম ধরে ধরে পড়ালেখা ও স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শও দেন। একইসঙ্গে তার জন্য চিন্তা না করতেও বলেন।
১৯৩০ সালের ৮ অগাস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে তাকেও হত্যা করে খুনিরা।
সোমবার বঙ্গমাতার জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তার বড় মেয়ে শেখ হাসিনা নিজের লেখা এ সংকলনের মোড়ক উন্মোচন করেন।
পরে সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব এম এম ইমরুল কায়েস গ্রন্থটিতে স্থান পাওয়া চিঠির বিষয়ে ফেইসবুকে পোস্ট দেন।
তিনি মূল চিঠির একটি ছবি পোস্ট করে লেখেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৯ সালে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় তাঁর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে এই চিঠিটি লেখেন।”
চিঠিতে কারাগারে প্রথম দিকে কষ্ট হলেও এখন বই পড়ে সময় ভালোই কাটছে বলে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তিনি বেগম মুজিবকেও বই পড়ার পরামর্শ দেন।
চিঠিতে তিনি ঈদের পর কারাগারে তার সঙ্গে দেখা করে যাওয়া সহধর্মীনী ফজিলাতুন নেছা- যার ডাক নাম ছিল রেণু, তাকে উদ্দেশ্য করে লেখেন- ‘রেণু, আমার ভালোবাসা নিও। ঈদের পরে আমার সাথে দেখা করতে এসেছো ছেলেমেয়েদের নিয়ে আস নাই- কারণ তুমি ঈদ করো নাই, ছেলেমেয়েরাও করে নাই।”
সন্তানদের ঈদের আনন্দ করতে না পারা যে ‘অন্যায়’ সে কথাও উঠে এসেছে জাতির পিতার লেখা ওই চিঠিতে।
তিনি লিখেছেন, “খুবই অন্যায় করেছো, ছেলেমেয়েরা ঈদে একটু আনন্দ করতে চায়। কারণ সকলেই করে। তুমি বুঝতে পারো ওরা কত দুঃখ পেয়েছে। আব্বা ও মা শুনলে খুবই রাগ করবেন।“
পরের বার কারাগারে দেখা করতে এলে সন্তানদের নিয়ে আসার অনুরোধ জানানোর পাশপাশি তার অনিশ্চিত মুক্তির কথাও চিঠিতে তুলে ধরেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তার জন্য চিন্তা না করে মা হিসেবে তার একমাত্র কাজ হবে সন্তানদের লেখাপড়া শেখানো সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু চিঠিতে তার সন্তানদের পড়াশোনা ও স্বাস্থ্যের বিষয়েও প্রয়োজনীয় খোঁজ খবর নেন এবং দিক নির্দেশনাও দেন।
কারাগারে একাকী থাকার কথা বর্ণনা করে বঙ্গবন্ধু লেখেন, “একাকী থাকতে একটু কষ্ট প্রথম প্রথম হতো, এখন অভ্যাস হয়ে গেছে কোন চিন্তা নাই। বসে বসে বই পড়ি।”
চিঠির কপি হুবহু তুলে ধরা হলো
ঢাকা জেল
১৬/৪/৫৯
রেণু,
আমার ভালোবাসা নিও। ঈদের পরে আমার সাথে দেখা করতে এসেছো ছেলেমেয়েদের নিয়ে আস নাই- কারণ তুমি ঈদ করো নাই, ছেলেমেয়েরাও করে নাই। খুবই অন্যায় করেছো, ছেলেমেয়েরা ঈদে একটু আনন্দ করতে চায়। কারণ সকলেই করে। তুমি বুঝতে পারো ওরা কত দুঃখ পেয়েছে। আব্বা ও মা শুনলে খুবই রাগ করবেন। আগামী দেখার সময় ওদের সকলকে নিয়ে আসিও। কেন যে চিন্তা করো বুঝি না, আমার কবে মুক্তি হবে তার কোন ঠিক নাই। তোমার একমাত্র কাজ হবে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখান। টাকার দরকার হলে আব্বাকে লিখিও কিছু কিছু মাসে মাসে দিতে পারবেন। হাছিনাকে মন দিয়ে পড়তে বলিও। কামালের স্বাস্থ্য মোটেই ভাল হচ্ছে না। ওকে নিয়ম মতো খেতে বলিও। জামাল যেন মন দিয়ে পড়ে আর ছবি আঁকে। এবার একটা ছবি একে যেন নিয়ে আসে আমি দেখব। রেহানা খুব দুষ্টু ওকে কিছুদিন পরে স্কুলে দিয়ে দিও জামালের সাথে। যদি সময় পাও নিজেও একটু লেখাপড়া করিও। একাকী থাকতে একটু কষ্ট প্রথম প্রথম হতো, এখন অভ্যাস হয়ে গেছে কোন চিন্তা নাই। বসে বসে বই পড়ি। তোমার শরীরের প্রতি যত্ন নিও।
ইতি-
তোমার মুজিব।