প্রতিপক্ষের ‘কোন্দলে’ এতদিন অজেয় সাক্কু

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের গত দুইবারের মেয়র মো. মনিরুল হক সাক্কু ২০০৫ সাল থেকে কোনো নির্বাচনেই হারেননি। বিএনপির জন্য বৈরী এ সময়ে দলটির অনেক নেতা যা পারেননি, সাক্কু বার বার তা করে দেখাচ্ছেন কোন জাদুবলে?

স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর, কুমিল্লা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 June 2022, 02:06 PM
Updated : 12 June 2022, 04:06 PM

স্থানীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে যারা খোঁজ খবর রাখেন, তাদের ধারণা, কেবল বিএনপির জনপ্রিয়তা কিংবা সাক্কুর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি এই ধারাবাহিক সাফল্যের মূল কারণ নয়। বরাবরই সাক্কুর জয়ের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে কুমিল্লা আওয়ামী লীগের গৃহবিবাদ।

১৬২ বছর আগে পৌরসভা হওয়া কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মর্যাদা পায় ২০১১ সালে। তার আগে থেকেই মনিরুল হক সাক্কু এ শহরের অভিভাবকের দায়িত্ব সামলে আসছেন।  

২০০৫ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পের্যন্ত ছিলেন পৌর মেয়র। এরপর ২০১২ এবং ২০১৭ দুবার সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন।

সাক্কু সব সময় বিএনপির প্রার্থী ছিলেন না। কখনও বিএনপির প্রত্যক্ষ এবং কখনও আবার পরোক্ষ সমর্থন পেয়েছেন। এবার নির্বাচন করতে নেমে দল থেকে হয়েছেন বহিষ্কৃত ।

সর্বশেষ ২০১৭ সালে সাক্কু নির্বাচন করেন বিএনপির প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে। সে বছর ২০১৭ সালে আফজল খানের মেয়ে, বর্তমানে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য আঞ্জুম সুলতানা সীমা ছিলেন আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী। তার আগে ২০১২ সালে সাক্কুর সঙ্গে ভোটের লড়াইয়ে পরাজিত হয়েছিলেন স্বয়ং আফজল খান।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এবং সচেতন নাগরিক কমিটিসহ (সনাক) আরও কয়েকটি নাগরিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত মানবাধিকারকর্মী আলী আকবর মাসুম মনে করেন, ভোটের সরল অংকে কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের এমন বারবার হারার কোনো কারণ নেই।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, কুমিল্লায় আওয়ামী রাজনীতিতে আফজল খান এবং আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের বিরোধ বহু দিনের। নব্বইয়ের দশকে তা তীব্র হয়।

“তখন থেকেই দেখা গেছে, কোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বাহারকে বেছে নিলে আফজল স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। আবার আফজলকে বেছে নিলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বাহার। বরাবরই তারা একে অন্যের ভরাডুবির কারণ হয়েছেন।”

আফজল খান মারা যাওয়ার পর সেই বিরোধের উত্তরাধিকারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমা। এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আফজল খানের ছেলে কুমিল্লা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাসুদ পারভেজ খান ইমরানও বিরোধের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন।

বিএনপি নেতা মনিরুল হক সাক্কু কুমিল্লার রাজনীতিতে পরিচিত ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের ‘শিষ্য’ হিসেবে। 

ভাইবোন দুজনই ছিলেন মেয়র পদের মনোনয়নপ্রত্যাশী। সীমা মনোনয়ন না পেয়ে নিরস্ত হলেও ইমরান মনোনয়নত্র জমা দিয়েছিলেন। পরে কেন্দ্রীয় নেতাদের কথায় মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনে রণে ভঙ্গ দেন।

আগামী ১৫ জুন অনুষ্ঠেয় কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত।

এই তিন জন ছাড়াও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক মো. ওমর ফারুক, মহানগর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান মিঠু, মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক নূর-উর রহমান মাহমুদ তানিম, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম-আহবায়ক সফিকুল ইসলাম শিকদার, তার ছোট ভাই মহানগর আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক কবিরুল ইসলাম শিকদার, মুক্তিযোদ্ধা মেজর মমিন ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব কাজী ফারুক আহাম্মেদ, আওয়ামী লীগ নেতা জাকির হোসেন, শাহজাহান বিপ্লব, মাহাবুবুর রহমান, শ্যামল চন্দ্র ভট্টাচার্য ও শফিউর রহমান।

আলী আকবর মাসুম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আওয়ামী লীগ পুরোনো বিরোধ পুরোপুরি ঘুচাতে পারেনি। মোটা দাগে দুটি গ্রুপ চোখে পড়লেও কুমিল্লা আওয়ামী লীগ এখন বহুধাবিভক্ত। এইসব বিভক্তির কোনোটিই রাজনৈতিক বা মতাদর্শিক নয়। এমন কী আফজল-বাহারের মত ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বও নয়। পুরোটাই সুবিধা আদায়ের,… এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার। তাই তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনী লড়াইয়েও নামতে পারছে না।”

গত ২৭ মে প্রচার শুরুর পর থেকে রিফাতের সঙ্গে সংসদ সদস্য বাহারের অনুসারী কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতাকর্মী থাকলেও মাঠে দেখা যাচ্ছে না অন্যদের অনুসারীদের।

তাদের সক্রিয় করার জন্য প্রচারের পঞ্চদশ দিনে এসে গত শুক্রবার ওই ১৩ জন মনোনয়নবঞ্চিতকে ঢাকায় তলব করে নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।

সেদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত টানা তিন ঘণ্টা ১৩ জনের সঙ্গে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, দলের চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সবুর, কৃষি ও সমবায় সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী।

আফজল খানের ছেলে মাসুদ পারভেজ খান ইমরান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বৈঠকে তারা ‘নৌকার পক্ষে কাজ করার’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন।

“নৌকার পক্ষে কাজ করার জন্য আমাদের ডাকা হয়েছিল ঢাকায়। আমি কেন্দ্রীয় নেতাদের বলে এসেছি, আমার নেতাকর্মীরা নৌকার জন্য কাজ করছে। তবে নৌকার প্রার্থী ও তার নেতা চান না আমরা নৌকার পক্ষে মাঠে নামি।”

নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত দলের সবাইকে পাশে পাচ্ছেন?

নৌকার প্রার্থীর নেতা বলতে সংসদ সদস্য ও কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারকে বুঝিয়েছেন ইমরান।

তিনি বলেন, “আমরা যদি ওপেন মাঠে নামি, তাহলে তারা বলবে, নৌকাকে ফেল করাইতে মাঠে নামছে। এখন এই সমস্যার দায়িত্ব কে নেবে? কেউ দায়িত্ব নিলে আমার মাঠে নামতে সমস্যা নেই।”

 “নৌকার প্রার্থীর জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছি। নৌকার কাণ্ডারি যেই হোক, তার পক্ষে থাকব, এটা আমাদের মেয়র প্রার্থীকে বোঝাতে পারিনি।”

নৌকার প্রার্থী রিফাতের ৪১ সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে আফজল খানের ছেলেমেয়েদের কাউকে না রাখায় ক্ষুব্ধ ইমরান ।

তিনি বলেন, “কেন্দ্রীয় নেতারা আমাদের কথা শুনেছেন, তবে আমরা যেন বদনামের ভাগি না হিই, তা দেখার দায়িত্ব নিতে কেউ রাজি নন। পরে তারা আমাদের আন্তরিকভাবে নৌকার জন্য কাজ করতে বলেছেন। আমরা বলেছি কাজ করব, এইটুকুই।”

সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য আঞ্জুম সুলতানা সীমা অবশ্য কথা বললেন তার ভাইয়ের চেয়ে কিছুটা রেখে-ঢেকে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কেন্দ্রীয় নেতাদের ডাক পাওয়ার আগেই আমি নেতাকর্মীদের পুরোনো বিভেদের কথা না ভেবে নৌকার জন্য কাজ করতে বলেছি। আমার নেতাকর্মীরা কাজ করছেও। শেষ সময়ে এসে নৌকার প্রার্থী না হলেও কেন্দ্রীয় নেতারা সকলকে ডেকেছেন, এটা ভালো দিক। আশা করছি সকলেই নৌকার পক্ষে কাজ করবেন।”

ঢাকার বৈঠক কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে, সে প্রশ্ন জাগে আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান মিঠুর বক্তব্য শুনলে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমি কেন্দ্রীয় নেতাদের বলেছি নৌকার মনোনয়ন চাওয়া যদি অপরাধ হয়, তাহলে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করা দরকার। আমি নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলাম বলেই নৌকার প্রার্থী ও তাদের নেতা আমাকে শত্রু ভাবতে শুরু করেছেন। আমাদের কাউকেই নৌকার পক্ষে কাজ করার জন্য ডাকেননি তারা। এরপরও কেন্দ্রীয় নেতারা বলেছেন আমরা যেন সবাই নৌকার পক্ষেই কাজ করি। পরে আমি বলেছি কাজ করব।” 

মনোনয়নবঞ্চিতরা মাঠে আছেন কিনা- এ প্রশ্নে নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত কৌশলী উত্তর দিয়েছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কুমিল্লার মাটিতে নৌকার প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। আওয়ামী লীগ ও প্রতিটি অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা এখন ঐক্যবদ্ধ। অন্য যারা দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন, তারা এই সব সংগঠনের নেতা। চারদিকে নৌকার যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে তাদের বসে থাকার উপায় নেই।”