বিরোধীদের ঐক্য ভাঙতে সরকার সক্রিয়: ফখরুল

বিরোধী ঐক্যে ‘বিভক্তি’ আনতে সরকারি সংস্থাগুলোকে কাজে লাগানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Sept 2021, 01:44 PM
Updated : 25 Sept 2021, 01:45 PM

শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক সাধারণ সভার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এই অভিযোগ করেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, “আজকে আমরা বিভক্ত। আমাদের সাংবাদিক সমাজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো বলেন, আমাদের পেশাজীবী সংগঠনগুলো বলেন, এসব জায়গাগুলোতে বিভক্তি এসে গেছে এবং বিভক্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে।

“অত্যন্ত সচেতনভাবে এই সরকা্রের যে এজেন্সিগুলো আছে, সেই এজেন্সিগুলো আজ অত্যন্ত অ্যাক্টিভ। তারা, আমরা যারা গণতন্ত্র চাই, আমরা যারা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব চাই, তাদের মধ্যে বিভিন্নভাবে ঐক্যের বিনষ্টি ঘটাচ্ছে।”

এ বিষয়ে সকলকে ‘সজাগ’ থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা যারা গণতন্ত্রের জন্য কাজ করছি, লড়াই করছি, সংগ্রাম করছি আমাদের বিভক্তির কোনো অবকাশ নেই।

“এই ফ্যাসিস্ট সরকারকে যদি সরাতে চাই জনগণের একটা দৃঢ় ঐক্যের প্রয়োজন আছে, জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন আছে, সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যের প্রয়োজন আছে।”

মির্জা ফখরুল বলেন, “আপনাদের সকলের প্রতি আমার আবেদন থাকবে, বিভেদ নয়, আপনাদের ঐক্য, জনগণের ঐক্য দিয়ে এদেশের মুক্তি হবে, গণতন্ত্র মুক্তি পাবে, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মুক্ত হবেন।”

‘রাজনীতিবিদরা দেশ চালাচ্ছেন না’

ওয়ান-ইলেভেনের চক্রান্ত থেকে মুক্তি মেলেনি দাবি করে বিএনপি মহাসিচব বলেন, “আজকে আমাদের দুর্ভাগ্য দেশ কিন্তু রাজনীতিবিদরা পরিচালনা করে না। একজন রাজনীতিবিদকে তারা শিখন্ডি হিসেবে দাঁড় করিয়ে রেখেছে- তিনি হচ্ছেন শেখ হাসিনা।

“তাকে দিয়ে যত অরাজনৈতিক, গণবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী সমস্ত কাজগুলো করিয়ে নিচ্ছে এবং রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠাগুলোকে তারা সুপরিকল্পিতভাবে ধবংস করে দিচ্ছে।”

জাতীয় সংসদে জনগণের কোনো প্রতিনিধিত্বই নাই দাবি করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “২০১৪ সালে তারা ১৫৪ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করে একটা সংসদ গঠন করেছিল।

“২০১৮ সালে আগের রাতেই নির্বাচন করে এবং সেই নির্বাচনে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না, তারাই জালিয়াতি করে ভোট দিয়ে বিভিন্নভাবে তাদের নির্বাচিত করেছে এবং স্বঘোষিত প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।”

‘নির্বাচন কমিশন আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান’

দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “কোথায় নির্বাচন কমিশন? এই কমিশন সম্পূর্ণভাবে একটা আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

“আজকে আবার শোনা যাচ্ছে, ফেব্রুয়ারি মাসে আবার নতুন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে। আমি পত্রিকায় দেখলাম, আমাদের ৫২ জন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী তারা একটা আইন প্রণয়ন করতে বলেছেন নির্বাচন কমিশনের জন্য।”

কারা সেই আইন করবে? সেই প্রশ্ন তুলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “এই আইন তো পাস করবে সেই পার্লামেন্ট, যে পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কিছু নাই।

“যারা দেশের গণতন্ত্র ধবংস করছে, জনগণের সমস্ত অধিকারগুলোকে হরণ করে নিচ্ছে, তারা এই আইনটা পাস করবে। সুতরাং নির্বাচনের আইন যারা করতে চান, সবার আগে তাদের এই বিষয়টি লক্ষ্য রাখা উচিত।”

 ‘বাকশালের আলামত, বাকশাল চলছে’

সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে নতুন আইন তৈরি করা হচ্ছে অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল বলেন, “আপনারা দেখেছেন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। এখন নতুন একটি আইন তৈরি করতে যাচ্ছে, সেটাকে তারা বলছে ব্যক্তি সুরক্ষা আইন।

“এটা আরেকটা কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা লেখালেখি করেন, যারা মত দেন তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তাদেরকে আবার নির্যাতন করার জন্য তারা এই আইনটা করতে যাচ্ছেন।”

২১০টি পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বাকশাল দেখতে পারছি। এর মধ্যে একজন বেশ শিক্ষিত মন্ত্রী, উচ্চ পদস্থ আমলা ছিলেন এক সময়ে, পরিকল্পনা মন্ত্রী, তিনি বলেছেন, বাকশাল ভাল ব্যবস্থা ছিল।

“সেই কথাটা পরিষ্কার করেই বলেন যে, আমরা বাকশাল করছি, আমরা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করেছি, এই কথাটা তো বলছেন না। কারণ মানুষকে আপনারা প্রতারণা করেছেন সবসময়ে।”

নিউ ইয়র্কে আওয়ামী লীগের সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিক ‘নির্যাতনের’ অভিযোগ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “এটা কিন্তু আওয়ামী লীগের চরিত্র। যখনই তাদের মতের বিরুদ্ধে কিছু বলবেন তখনই তার উপরে নির্যাতন করবে।

“একটা বাহিনীই তৈরি করা হয়েছিল- মুজিব বাহিনী, যে যারা অন্য রাজনীতি থেকে এসেছে তাদেরকে নির্মূল করতে হবে। এটা আপনারা আজ-কাল কেউ বলেন না। রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছিল।”

বহু সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ সেসময় নির্যাতিত হয়েছেন অভিযোগ করে তিনি বলেন, “এখন যে জাসদের ইনু সাহেবরা এত কথা বলেন, তাদেরই তো ৩০ হাজার তরুণ-কিশোরকে প্রাণ দিতে হয়েছিল।”

এসময় নিউজ পোর্টালের জন্য ৪ হাজার আবেদনের মধ্যে দলীয় পছন্দের ৯৫টিকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে অভিযোগ করে এর সমালোচনা করেন বিএনপি মহাসচিব।

ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন গাজীর মুক্তির দাবি জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, “রুহুল আমিন গাজী ১১ মাস ধরে কারাবন্দি হয়ে আছেন বিনা কারণে। এক মিথ্যা মামলা দিয়েছে।

“সেই মিথ্যা মামলা বহু লোকের বিরুদ্ধে হয়েছিল। অনেকে মুক্ত হয়ে গেছেন। কিন্তু রুহুল আমিন গাজীকে মুক্তি দেয়া হচ্ছে না। একজন সাংবাদিক, তিনি স্বাধীনতার কথা বলেন, মুক্ত সাংবাদিকতার কথা বলেন, সেজন্য তাকে মুক্ত করা যাবে না।”

তিনি বলেন, “রহুল আমিন গাজীর মুক্তির ব্যাপারে সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ থাকেন না তখন কষ্ট হয়। তাদের সহকর্মীর জন্য তারা জোরে-সোরে কথা বলবেন না।”

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক সাধারণ সভায় বিএফইউজের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ বলেন, “দেশে আজ মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। বহু সাংবাদিক মত প্রকাশ করতে গিয়ে জেলে গেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন।

“সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কমেন্ট করার জন্য অনেকে জেলে গেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন। রুহুল আমিন গাজীসহ অনেকে আটক আছেন আমাদের, তাদের মুক্তি দাবি করি।

তিনি বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাষ্ট্রচিন্তার মুশতাক আটক ছিলেন, তিনি জেলেই এই সরকারের হাতে মৃত্যুবরণ করেছেন। আমরা আর কত কাল অপেক্ষা করবো এসব মৃত্যুর জন্য, এসব গ্রেপ্তারের জন্য?”

“মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সামনে রেখে আজকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ডাক দিতে হবে এবং বিএনপি এই সংগ্রামের নেতৃত্ব দেবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আসুন আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হই,” বলেন শওকত মাহমুদ।

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি কাদের গণি চৌধুরী বলেন, “দেশের গণতন্ত্র মাধ্যম এক ভয়াবহ সংকটকাল অতিক্রম করছে। ক্ষমতার প্রভাব বলয় থেকে মিডিয়া নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

“এক কথায় গণমাধ্যম এখন ততটুকুই স্বাধীন যতটুকু সরকারের পক্ষে যায়। আজকে আমরা যখন সম্মেলন করছি, তখন একটা ভোটারবিহীন জাতিতে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে। যখন সম্মেলন করছি, তখন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ নানা কালাকানুনের মাধ্যমে বাংলাদেশ বোবা জাতিতে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থার অবসানে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই ছাড়া বিকল্প নাই।”

কাদের গণির সভাপতিত্বে ও ডিইউজে নেতা শাহজাহান সাজু ও দিদারুল আলম দিদারের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম, বিএফইউজের সভাপতি এম আবদুল্লাহ, মহাসচিব নুরুল আমিন রোকন, বিএফইউজে-ডিই্উজে-জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক নেতা এমএ আজিজ, আবদুল হাই শিকদার, কামাল উদ্দিন সবুজ, সৈয়দ আবদাল আহমেদ, বাকের হোসাইন, জাহাঙ্গীর আলম প্রধান, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি মুরসালিন নোমানী, ডিইউজে সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম, সহ-সভাপতি শাহীন হাসনাত, বাসির জামাল ও রাশেদুল হক বক্তব্য রাখেন।