মুশতাকের মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি বিএনপির

কারাগারে ‘অবর্ণনীয় নির্যাতন’ চালিয়ে মুশতাক আহমেদকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে তার মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে বিএনপি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Feb 2021, 01:27 PM
Updated : 26 Feb 2021, 01:27 PM

দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেন, “মুশতাকের মতো একজন অরাজনৈতিক, নিরীহ এবং নিজস্ব চিন্তায় ফেইসবুকে ফ্রিল্যান্সার লেখকের মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়, এর সাথে রাষ্ট্রশক্তি জড়িত। সরকারি হেফাজতে কারাগারে তার মৃত্যুতে আমি তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

“পাশাপাশি মুশতাক আহমেদের কারান্তরীণ অবস্থায় মৃত্যুতে স্বচ্ছ, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করার দাবি করছি।”

করোনাভাইরাস সঙ্কটের মধ্যে গত বছরের ৬ মে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট মুশতাক আহমেদ ও কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। পরদিন ‘সরকারবিরোধী প্রচার ও গুজব ছড়ানোর’ অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাদের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা করা হয়।

এই মামলায় রাষ্ট্রচিন্তার সংগঠক দিদারুল ভূইয়া এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নানকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তবে পরে এ দুজন জামিনে মুক্তি পান। মুশতাক ও কিশোরের পক্ষে বেশ কয়েকবার জামিনের আবেদন হলেও তা আদালতে নামঞ্জুর হয়।

কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে বন্দি অবস্থায় বৃহস্পতিবার মুশতাকের মৃত্যু হয়। কী কারণে ৫৩ বছর বয়সী এই অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টের মৃত্যু হয়েছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি।

শুক্রবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, মুশতাক আহমেদ হঠাৎ করে অসুস্থ হওয়ার পর হাসপাতালে নিলে তার মৃত্যু হয়েছে। তার মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে ‘প্রয়োজনে’ তদন্ত কমিটি করা হবে।

তবে বিএনপি মহাসচিবের অভিযোগ, কারাগারে ‘নির্যাতন’ করেই এই লেখককে হত্যা করা হয়েছে।

বিবৃতিতে তিনি বলেন, “বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংগতি, অসংগতি, নিয়ম-অনিয়ম, কীর্তি-অপকীর্তি ইত্যাদি বিষয়ে স্বাধীনচেতা মানুষের অভিমত, বিশ্লেষণ ইত্যাদি প্রকাশের সুযোগ আজ গণতান্ত্রিক বিশ্বে সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমান কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী সরকার তাদের অপকর্ম ও ভয়াবহ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সমালোচনা যাতে প্রকাশ না হয়ে পড়ে সেজন্য নানা কালাকানুনের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে মন্তব্য লেখা বা পোস্টকে কোনোভাবেই বরদাস্ত করছে না।”

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (ফাইল ছবি)

যারা স্বাধীনভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের মত প্রকাশের চেষ্টা করছে, তাদের জীবনে ‘ভয়ঙ্কর দুর্বিষহ পরিণতি’ নেমে আসছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

“হয় তাদের গুমের শিকার হতে হচ্ছে নতুবা সরকারি হেফাজতে প্রাণ দিতে হচ্ছে। তার সর্বশেষ নির্মম শিকার হলেন মুশতাক আহমেদ। মূলত মুশতাক আহমেদের ওপর কারাগারে অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে।”

তিনি বলেন, মুশতাক আহমেদ লুটপাটকারী কিংবা কালোবাজারি, সন্ত্রাসী ও ডাকাত ছিলেন না। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্র মুশতাক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন।

মুশতাকের এই ‘নির্ভীক আত্মদানের’ মধ্য দিয়েই দেশের তরুণ সমাজ জেগে উঠবে এবং দেশে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও নাগরিক স্বাধীনতাসহ সুশাসন ও আইনের শাসন ফিরে আসবে’ বলে আশা প্রকাশ করেন মির্জা ফখরুল।

“মুশতাক একজন সৎ ও সাহসী মানুষ ছিলেন। তিনি চিরদিন অধিকারহারা মানুষের নিকট প্রেরণার আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন। তিনি দেশবাসীর প্রার্থনা, চেতনা ও অনুভবে চিরদিনের জন্য বিরাজ করবেন,” বলেন তিনি।

মুশতাক আহমেদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে তার শোকগ্রস্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান বিএনপি মহাসচিব।

আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “দেশে আইন-কানুন, সুষ্ঠু বিচারিক ব্যবস্থা না থাকার কারণেই সারা দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ বিরাজ করছে। মানুষের জানমালের কোনো নিরাপত্তা নেই। সারা জাতির ওপর ঘোর দুর্দিন নেমে এসেছে।দেশে এখন নব্য বাকশালী শাসন জারি রাখা হয়েছে। যাতে কেউ টু শব্দ করতে না পারে।

“মানুষকে নিঃশব্দ করতেই গুম, খুন, ক্রসফায়ার, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুকে রাষ্ট্রীয় জীবনের অনুসঙ্গ করা হয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে সত্য সমালোচনাতেও তারা আঁতকে ওঠে। রাষ্ট্রের সকল অঙ্গকে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে রূপান্তর করা হয়েছে। নিষ্ঠুর একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনের সকল বৈশিষ্ট্য এখন ফুটে উঠেছে। রাষ্ট্র ক্রমান্বয়ে মাফিয়া রূপ ধারণ করেছে।”

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে দেশে ‘রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে দ্বিধা করছে না’ বলে অভিযোগ করেন বিএনপি মহাসচিব।

তিনি বলেন, “সরকারের এই রক্তঝরা কর্মসূচির প্রধান শিকার হচ্ছে বিরোধী দল, মত ও স্বাধীন চিন্তার মানুষরা। নজিরবিহীন অপশাসন ও কুকীর্তি নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনার যে ঝড় বইয়ে যাচ্ছে সেটি মানুষের দৃষ্টি থেকে ভিন্ন দিকে সরাতেই জাতীয়তাবাদী শক্তিসহ বিবেকবান, স্বাধীনচেতা অনলাইন ব্লগার ও লেখকদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সরকার।”

এর পরিণতি ‘ভয়াবহ’ হবে বলে সতর্ক করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

মুশতাকের এই মৃত্যুতে সারা দেশের ‘সর্বস্তরের মানুষ ক্ষোভে-বেদনায় ফেটে পড়েছে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ছয় মাসের বেশি সময় ধরে মুশতাক আহমেদের সঙ্গে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে আটকে রাখার নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে তার মুক্তি দাবি করেন বিএনপি মহাসচিব।