গণতান্ত্রিক ক্ষমতা বদলের সম্ভাবনা ‘দূরীভূত’: টিআইবি

দেশে ‘শান্তিপূর্ণ এবং স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়’ ক্ষমতা বদলের সম্ভাবনা ‘দূরীভূত হয়েছে’ বলে মনে করছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Sept 2020, 10:51 AM
Updated : 30 Sept 2020, 03:22 PM

বুধবার টিআইবির ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এক ওয়েবিনারে তিনি বলেন, “অষ্টম ও নবম সংসদে সমস্যার মূল যে জায়গা সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি অগ্রহণযোগ্য ছিল। সেটি বন্ধ হয়েছে চড়া দামে। এত বেশি চড়া দামে যে মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো হয়েছে।“

২০১৯ সালে সংসদের (প্রথম থেকে পঞ্চম অধিবেশন) কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে এবারের এই ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ, প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে টিআইবি।

প্রতিবেদন উপস্থাপন শেষে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত নির্বাচনের সংস্কৃতি আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। শান্তিপূর্ণ এবং স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় রদবদলের সম্ভাবনা দূরীভূত হয়েছে। তারই প্রভাব আমরা দেখতে পারছি জাতীয় সংসদের মধ্যে।

“এরই ধারাবাহিকতায় একাদশ সংসদে একদলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে সংসদীয় কার্যক্রমে একচ্ছত্র ক্ষমতার সুযোগ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। ফলে সংসদের মৌলিক দায়িত্ব আইন প্রণয়ন, সরকারের জবাবদিহিতা এবং জনপ্রতিনিধিত্ব- এই তিনটি ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ভূমিকা আমরা দেখতে পারছি না।“

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর সংসদের প্রথম বৈঠক বসে চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি। দশম সংসদ বর্জন করা বিএনপি এই নির্বাচনে যোগ দেওয়ার পর ঘটে নানা নাটকীয়তা।

৩০ ডিসেম্বর ওই নির্বাচনে অংশ নিয়ে মাত্র ছয়টি আসনে জয় পায় বিএনপি। আর গণফোরামের দুটি মিলিয়ে তাদের জোট ঐক্যফ্রন্ট পায় মোট আটটি আসন।

ওয়েবিনারে এক প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে। বিরোধী দল থাকলে সংসদ বর্জন করে, সেই সংস্কৃতি আমাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য ছিল। বর্জন বন্ধ হয়েছে। কারণ কার্যকর বিরোধী দল বলতে যা বোঝায় সেটি আমাদের কাছে নেই।

“এবারে সংসদে যাদের প্রধান বিরোধী দল বলা হয়েছে বা উপস্থাপন করা হয়েছে তারা কিন্তু বিরোধী দলে বসবেন সেই প্রত্যাশা নিয়ে নির্বাচন করেন নাই। তারা ক্ষমতাসীন জোটের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু তাদের বসানো হয়েছে বা বসেছেন এমন একটি ভূমিকায় যেটার জন্য তারা প্রস্তুত ছিলেন না। বাস্তবে প্রধান বিরোধী দল বলতে যা বোঝায় সেটি কিন্তু অনুপস্থিত।“

প্রতিবেদনে টিআইবি বলেছে, “প্রশ্নবিদ্ধ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের ফলে সংসদীয় কার্যক্রমে বিশেষত আইন প্রণয়ন, বাজেট প্রণয়ন এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে একচ্ছত্র ক্ষমতার চর্চা আরও জোরদার হয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচনকালীন মহাজোটের একটি দল নিয়ম রক্ষার প্রধান বিরোধী দল হওয়ায় সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় তাদের জোরালো ভূমিকার ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে।”

সংসদীয় কার্যক্রমে আইন প্রণয়ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলেও আইন প্রণয়নের আলোচনায় সংসদ সদস্যদের ‘কম অংশগ্রহণ, অনাগ্রহ ও দক্ষতার ঘাটতি’ দেখতে পাওয়ার কথা বলেছে টিআইবি। তারা মনে করছে, অধিকাংশ সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যকর জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে ‘ঘাটতি ছিল’।

“সংসদীয় উন্মুক্ততার চর্চায় ঘাটতি রয়েছে, বিশেষ করে আইন প্রণয়নসহ অন্যান্য সংসদীয় কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের উদ্যোগ দেখা যায়নি। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ও লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে সংসদে আলোচনার ক্ষেত্র এখনো সন্তোষজনক নয়। সার্বিকভাবে, একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম পাঁচটি অধিবেশন আইন প্রণয়ন, জনগণের প্রতিনিধিত্ব ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর ছিল না।“

একাদশ সংসদের ৬১ শতাংশ এমপি ব্যবসায়ী

টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্যদের হলফনামায় উল্লেখ করা প্রধান পেশা বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছে, ৬১ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী, আইনজীবী প্রায় ১৩ শতাংশ, রাজনীতিক মাত্র ৫ শতাংশ এবং অন্যান্য পেশার সদস্য রয়েছেন ২১ শতাংশ।

অন্যান্য পেশার মধ্যে শিক্ষক, চিকিৎসক, কৃষক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তা, গৃহিনী, পরামর্শক ইত্যাদি পেশা উল্লেখযোগ্য।

আওয়ামী লীগ ও শরিক দলের ৫৯ শতাংশ এবং জাতীয় পার্টির ৫৬ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী।

ভারতের পার্লামেন্টের তুলনামুলক চিত্র তুলে ধরে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবেশী দেশটির সপ্তদশ লোকসভায় সংসদ সদস্যদের মধ্যে রাজনীতিক ৩৯ শতাংশ, ব্যবসায়ী ২৩ শতাংশ, আইনজীবী ৪ শতাংশ এবং অন্যান্য পেশার সদস্য রয়েছেন ৩৮ শতাংশ।

টিআইবি গত কয়েকটি সংসদের সদস্যদের প্রধান পেশা বিশ্লেষণ করে বলছে, প্রথম সংসদে আইনজীবীদের হার ছিল ৩১ শতাংশ, যা ক্রমাগত কমে একাদশ সংসদে ১৩ শতাংশে পৌঁছেছে।

অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের হার প্রথম সংসদে ১৮ শতাংশ ছিল, যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে একাদশ সংসদে ৬১ শতাংশে পৌঁছেছে।

কোরাম সঙ্কটে ক্ষতি ‘২২ কোটি টাকা’

২০১৯ সালের পাঁচটি অধিবেশনে মোট ১৯ ঘণ্টা ২৬ মিনিট কোরাম সঙ্কট ছিল বলে হিসাব করে দেখিয়েছে টিআইবি, যা ৫টি অধিবেশনের প্রকৃত মোট ব্যয়িত সময়ের ১৭.৩ শতাংশ।

তাতে পাঁচটি অধিবেশনে প্রতি কার্যদিবসে গড় কোরাম সঙ্কট ছিল ১৯ মিনিট। প্রথম থেকে পঞ্চম অধিবেশন পর্যন্ত কোরাম সঙ্কটে ব্যয়িত মোট সময়ের অর্থমূল্য ২২ কোটি ২৮ লক্ষ ৬৩ হাজার ৬২৭ টাকা বলে টিআইবির ভাষ্য।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “অধিবেশন পরিচালনার প্রতি মিনিটের প্রাক্কলিত অর্থমূল্য থেকে বাস্তব অর্থমূল্য আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। কারণ জাতীয় সংসদের অনুন্নয়ন ব্যয় ও বিদ্যুৎ বিল ছাড়াও সংসদ পরিচালনায় আরও কিছু সেবা খাত রয়েছে, যার ব্যয় এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি এবং সর্বশেষ অর্থবছরের বিদ্যুৎ বিল সংগ্রহ করতে না পারায় উক্ত বছরের হালনাগাদ তথ্যও এখানে সন্নিবেশ করা যায়নি।”

আইন প্রণয়নে সময় ‘৯%’

টিআইবি বলছে, একাদশ সংসদের পাঁচটি অধিবেশনে আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে ৯ শতাংশ সময় ব্যয় হয়েছে। অথচ ২০১৯ সালে ভারতের লোকসভায় এই হার ছিল ৪৫ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিল উত্থাপন এবং বিলের ওপর সদস্যদের আলোচনা ও মন্ত্রীর বক্তব্যসহ একটি বিল পাস করতে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে গড়ে প্রায় ৩২ মিনিট সময় ব্যয় হয়েছে, যেখানে ভারতের লোকসভায় প্রতিটি বিল পাসে গড়ে প্রায় ১৮৬ মিনিট ব্যয় হয়েছে।

টিআইবি বলছে, “অধিকাংশ সংসদীয় কমিটিতে বিলের ওপর আলোচনায় ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। বিলের ওপর সংশোধনী এবং যাচাই-বাছাই প্রস্তাবের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে প্রধান বিরোধী দল এবং অন্যান্য বিরোধী সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হয়েছে। আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে প্রধান বিরোধী দল ৬৭ শতাংশ, অন্যান্য বিরোধীসদস্য ১৭ শতাংশ, সরকারি দল ১৬ শতাংশ (বিল উত্থাপনকারী মন্ত্রীরা) সময় ব্যয় করেছেন।”

৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে মাত্র ১৪ জন সদস্য (৪ শতাংশ) বিলের ওপর নোটিস দিয়ে আলোচনা করেছেন। যাদের মধ্যে আটজন সদস্য বিলের ওপর সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। বাকি সদস্যদের ভূমিকা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বলে তথ্য দিয়েছে টিআইবি।

তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “বিল পাসের ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে সরকারি দল একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে।”

অসংসদীয় ভাষা বন্ধে স্পিকার ‘নীরব’

সংসদ নিয়ে এই প্রতিবেদনে টিআইবি বলছে, অধিবেশনে সংসদ সদস্যদের যথাযথ আচরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদেরকে নিয়ে ‘বিতর্কিত’ মন্তব্য, সংসদে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ‘আক্রমণাত্মক শব্দের’ ব্যবহার অব্যাহত ছিল।

অধিবেশন চলাকালীন সদস্যদের বিচ্ছিন্নভাবে চলাফেরা, কোনো সদস্যের বক্তব্য চলাকালীন তার নিকটবর্তী আসনের সদস্যদেরকে নিজ আসনে বসে নিজেদের মধ্যে কথোপকথন এবং সংসদ অধিবেশনে সদস্যদের অমনোযোগিতাও ‘দেখতে পেয়েছে’ টিআইবি।

“কোনো কোনো ক্ষেত্রে সদস্যদের বক্তব্যে অসংসদীয় ভাষা (কটূক্তি) ব্যবহার বন্ধে স্পিকার নীরব ছিলেন।”

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংরক্ষিত নারী আসনের একজন সরকারদলীয় সদস্যের পাবলিক পরীক্ষায় ‘অসাধু উপায়’ অবলম্বন এবং একজন বিরোধী সদস্য শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করে তা নিয়ম-বহির্ভূতভাবে বিক্রি করলেও তাদের বিরুদ্ধে সংসদ থেকে ‘যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি’।

সংসদকে `কার্যকর’ করতে কয়েকটি সুপারিশও করেছে টিআইবি।

# জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাস্তবিক অর্থে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে হবে।

# সদস্যদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে হবে, যেখানে স্বীয় দলের বিরুদ্ধে অনাস্থার ভোট এবং বাজেট ব্যতীত অন্য সকল ক্ষেত্রে সদস্যদের নিজ বিবেচনা অনুযায়ী ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকবে।

# ‘সংসদ সদস্য আচরণ আইন’ প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে সংসদ সদস্যদের সংসদের ভেতরে এবং বাইরের আচরণ ও কার্যক্রম সম্পর্কে আন্তর্জাতিক চর্চা অনুসারে নির্দেশনা থাকবে।

# সংসদীয় কার্যক্রম এমন হবে যেখানে সরকারি দলের একচ্ছত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার পরিবর্তে কার্যকর বিরোধী দলের অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত হবে।