দল নিবন্ধনের শর্তে ‘কঠোর না হওয়ার’ পরামর্শ ইসিকে

রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান শর্ত বহাল রেখে সব পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩% নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতে নির্বাচন কমিশনের কঠোর অবস্থানের পরামর্শ এসেছে সাবেক নির্বাচন কমিশনার, নতুন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং নারী অধিকার কর্মীদের কাছ থেকে।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 June 2020, 05:15 AM
Updated : 27 August 2020, 05:43 AM

তারা বলছেন, নতুন দলের নিবন্ধনের পথ কঠিন করে ফেলা ঠিক হবে না। আবার নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে যাওয়া চলবে না।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের অধীনে ২০০৮ সালে রাজনৈতিক দল নিবন্ধন চালু হয়। বর্তমানে ৪১টি দল নিবন্ধিত রয়েছে।

আরপিওর ৯০ (এ) থেকে ৯০ (ই) পর্যন্ত অনুচ্ছেদ নিয়ে এখন আলাদাভাবে ‘রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন’ নামে বাংলায় নতুন একটি আইনের খসড়া প্রস্তুত করেছে নির্বাচন কমিশন।

রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শর্ত ও বিধি-বিধানে কয়েকটি নতুন বিষয় যুক্ত করে কড়াকড়ি আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে সেখানে।

প্রস্তাবিত ‘রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন, ২০২০’ এর ওই খসড়া বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় মতামতের জন্য।

সেখানে বলা হয়েছে, নতুন দলের নিবন্ধন পেতে তিনটি শর্তের মধ্যে অন্তত দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে।

১. আবেদন করার তারিখ থেকে পূর্ববর্তী দুটি সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে কমপক্ষে একটি আসন পেতে হবে।

২. ওই সংসদ নির্বাচনে যে কোনো একটিতে আবেদনকারী দলের অংশগ্রহণ করা আসনে প্রদত্ত মোট ভোটের ৫ শতাংশ পেতে হবে

৩.  যদি দলটির একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, দেশের কমপক্ষে এক তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর কমিটি থাকে এবং অন্তত ১০০ উপজেলা/মেট্রোপলিটন থানায় কমপক্ষে ২০০ ভোটারের সমর্থন থাকে।

বিদ্যমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, কমিশনের তিনটি শর্তের মধ্যে একটি পূরণ হলে একটি দল নিবন্ধনের যোগ্য বিবেচিত হয়।

১. দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে কোনো জাতীয় নির্বাচনে দলটির অন্তত একজন যদি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন

২. যে কোনো একটি জাতীয় নির্বাচনে দলের প্রার্থী যদি অংশ নেওয়া আসনগুলোতে বাক্সে পড়া মোট ভোটের ৫ শতাংশ পায়।

৩.  যদি দলটির একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, দেশের কমপক্ষে এক তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর কমিটি থাকে এবং অন্তত ১০০ উপজেলা/মেট্রোপলিটন থানায় কমপক্ষে ২০০ ভোটারের সমর্থন থাকে।

বিদ্যমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০-এর খ-এর খ(২) অনুচ্ছেদে কেন্দ্রীয় কমিটিসহ রাজনৈতিক দলের সব স্তরের কমিটিতে অন্তত ৩৩ শতাংশ পদ নারী সদস্যদের জন্য সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং ২০২০ সালের মধ্যে সেই লক্ষ্য অর্জনের কথা বলা হয়েছে। ২০০৮ সালে নিবন্ধন পাওয়া অধিকাংশ দল এখনও তা পূরণ করতে পারেনি।

নতুন আইনের খসড়ায় রাজনৈতিক দলের সব স্তরের কমিটিতে ৩৩% নারী প্রতিনিধি রাখার শর্ত পূরণে দলগুলোকেই তাদের গঠনতন্ত্রে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে।

শর্ত হতে হবে সহজ: ছহুল হোসাইন

২০০৮ সালে যখন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের নিয়ম হয়, সে সময় নির্বাচন কমিশনের সদস্য ছিলেন মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, সবার মতামত নিয়েই তখন নিবন্ধনের শর্তগুলো ঠিক করা হয়েছিল। এখনও সেটাই ‘উপযুক্ত’ বলে তিনি মনে করেন।

“নতুন দল এবং স্বাধীনতার পর বিদ্যমান দলের কথা বিবেচনা করে তিনটি শর্তের একটি পূরণের জন্য বলা হয়েছিল তখন। সবার জন্য সমান সুযোগ থাকতে হবে; আগে যারা নিবন্ধিত হয়েছে এবং সামনে যারা হবে, সবার জন্যই।”

নতুন দলের নিবন্ধনের পথ রুদ্ধ করা বা বেশি কঠিন করা ঠিক হবে না বলে মত দেন সাবেক এ আমলা।

“নিবন্ধনটা সহজ রাখাই উচিত। দল ইসির কাছে নিবন্ধন পেলেই সব হয়ে গেল এমন নয়; তারপরে তাকে জনগণের কাছে যেতে হচ্ছে। নিবন্ধন হলে ইসির কাছে দলটি সব বিষয়ে বাধা পড়ে গেল, দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা থেকে শুরু করে হিসাব-নিকাশ পর্যন্ত। তাই দলগুলোকে আইনের আওতায় আনতে সহজ শর্ত আরোপ করতে হবে।”

ছহুল হোসাইন বলেন নতুন আইনের প্রস্তাবে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, তাতে নতুন দলের জন্য নিবন্ধন পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। দুটি শর্ত পূরণ করতে অনেক দলেরই ঝামেলা হবে।

“কমিশনকে ভাবতে হবে- এখন যারা নিবন্ধিত রয়েছে তাদের নিয়েই তারা চলবে, নাকি নতুনদেরও সুযোগ দেবে। নিবন্ধন পাওয়া কঠিন হয়ে গেলে তো দলের বিকাশও ঘটবে না। ভোটের মাঠে রাখতে দলগুলোকে নিবন্ধনের সুযোগ দিতে হবে। তাতে জনগণের সামনে তাদের পরীক্ষা ও জবাবদিহিতার জায়গা হবে।”

তিনি বলেন, “আমরা নতুন দলের জন্য শর্ত আরোপ করেছিলাম আর পুরনোদের জন্যও সুযোগ রেখেছিলাম। আমার মনে হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত পেলে কমিশন উপযুক্ত সিদ্ধান্তই নেবে। প্রস্তাবিত আইনে অনুবাদ করতে গিয়ে নতুন কিছু হয়ত যোগ করেছে; ফাইনাল শেইপ দেওয়ার সময় ভেবে চিন্তে কাজ করবে ইসি।”

নিবন্ধনের শর্ত আগের মত শিথিল রাখার পাশাপাশি দলে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার সময় বাড়ানো এবং নতুনদের নিবন্ধন দিয়ে বিধিবিধানগুলো অনুসরণের ক্ষেত্রে ইসির তরাদকি বাড়ানোর তাগিদ দেন সাবেক এ নির্বাচন কশিমনার।

কড়াকড়ি অযৌক্তিক: বাংলাদেশ জাসদ

একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল বাংলাদেশ জাসদ। নতুন দল হিসেবে দেশের এক তৃতীয়াংশ জেলা ও উপজেলা কমিটির শর্ত পূরণ করেও দলটি নিবন্ধন পায়নি।

বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, “আমি ওয়েবসাইটে খসড়াটি পড়লাম। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমরাও মতামত দেব। বলা হয়েছে- আরপিও অনুসরণ করেই বাংলা করা হয়েছে খসড়াটি। এর মধ্যে তিনটি শর্তের মধ্যে দুটি পূরণের যে কথা বলা হয়েছে- তা হয়ত ভুলবশত করা হয়েছে। কারণ, আগের আইনে তা নেই।”

নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ ভোট পাওয়ার শর্তটি ‘বরাবরই অযৌক্তিক’ বলে মন্তব্য করেন আম্বিয়া।

“বিষয়টি ইরিলিভেন্ট। যেমন গত দুটি নির্বাচনে জয়ী দলের বাইরে ৫ শতাংশ ভোট পাওয়া কী এত সহজ ছিল? এসব নিয়ে গণমাধ্যমের সরব হওয়া দরকার।”

বিদ্যমান শর্তগুলোর মধ্যে দুটির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রেখে আম্বিয়া বলেন, “আগে ছিল স্বাধীনতার পরে একটি নির্বাচনে একটি আসন পেতে হবে। এখন বলা হচ্ছে- আবেদন করার পূর্ববর্তী দুটি নির্বাচনে একটি আসন পেতে হবে। এটা কমিশনের ভুল হয়ত; কারণ, ২০০৮ সাল থেকে নির্বাচনে কেবল নিবন্ধিতরাই অংশ নিয়েছে। সেক্ষেত্রে এ প্রস্তাটি অযৌক্তিক।”

বাংলাদেশ জাসদের এ নেতা বলেন, “মনে রাখতে হবে আইন সংস্কার করার সময় সবার জন্য সুযোগ যেন সুরক্ষা পায়। কোনো দল বা গোষ্ঠীকে টিকিয়ে রাখার জন্য এটা করা ঠিক নয়।”

নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতে ইসি যেন পিছিয়ে না যায়: নাসিমুন আরা

রাজনৈতিক দলের সব স্তরে ৩৩% নারী প্রতিনিধিত্ব অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দলকেই লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে দেওয়া ঠিক হবে না বলে মনে করেন নারী অধিকার কর্মী নাসিমুন আরা হক মিনু।

তিনি বলেন, আরপিও অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩% নারী প্রতিনিধিত্ব রাখার কথা থাকলেও নিবন্ধিত দলগুলোর অধিকাংশই তা পূরণ করেনি। এখন যদি আইন সংশোধনের সময় এ লক্ষ্যমাত্রা কমিশন ঠিক করে না দিয়ে দলগুলোর ওপর ছেড়ে দেয়, তা ‘ঠিক হবে না’।

“নির্বাচন কমিশনই নতুন লক্ষ্য ঠিক করে দেবে। কোন দলের কী অবস্থা তা জানতে হবে এবং কেন পূরণ হল না তার ব্যাখ্যা চাইবে। নতুন দলের ক্ষেত্রেও একই সময় নির্ধারণ করে দেবে। দলীয় গঠনতন্ত্রে কী লক্ষ্যমাত্রা দিল তা দলের বিষয়; ইসি আইন মেনে তদারক করবে।”

রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘নারীবান্ধব’ করার ক্ষেত্রে ইসির অগ্রণী ভূমিকা ‘আগের মত’ বহাল রাখার পরামর্শ দেন নারী সাংবাদিক কেন্দ্রে সভাপতি মিনু।

অসঙ্গতি দূর করতেই এ উদ্যোগ: জ্যেষ্ঠ সচিব

রাজনৈতিক দল, সাবেক কমিশনার ও নারী অধিকার কর্মীদের মন্তব্যের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর বলেন, প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় কোনো অসঙ্গতি থাকলে তা দূর করার জন্যই সবার মতামত নিচ্ছে ইসি।

“দল ও নাগরিকরা সার্বিক বিষয়টি নিয়ে আশা করি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মতামত পাঠাবেন। সব পর্যালোচনা করে কমিশনে উপস্থাপন করব আমরা।”

প্রস্তাবিত খসড়ার বিভিন্ন শর্ত আরোপ ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সঙ্গে সমন্বয় না রেখে বাংলায় রূপান্তরের ক্ষেত্রে খোদ কমিশন কর্মকর্তাদের মধ্যেও ভিন্নমত রয়েছে।

বিশেষ করে নিবন্ধন শর্তে নতুন ধরনের বিষয় যুক্ত করাসহ সার্বিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে অনেকেই অবহিত নন বলে জানান একাধিক কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আলমগীর বলেন, “আগের আইনের সঙ্গে খসড়ার মিল নাও থাকতে পারে। কারো কাছে খসড়াটির কিছু বিধান অযৌক্তিক মনে হতে পারে। কমিশনেও এসব নিয়ে আলোচনা চলবে। বাস্তবতা বিবেচনা করেই সব ঠিক করা হবে।”

‘যত দ্রুত সম্ভব’ খসড়াটি অনুমোদন করার চেষ্টা হবে বলে জানান ইসি সচিব।

আরও পড়ুন