বিদ্রোহীরা আসলে কার: প্রশ্ন বিএনপি প্রার্থীদের

বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর পোস্টার ছিঁড়ে ফেললেও ‘অক্ষত থাকছে’ বিদ্রোহীরটা, আবার কোথাও বিদ্রোহীর পোস্টার লাগিয়ে দিচ্ছেন ‘আওয়ামী লীগের কর্মীরা’।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Jan 2020, 06:47 PM
Updated : 18 Jan 2020, 06:59 PM

এই চিত্র তুলে ধরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে বিএনপি সমর্থিত একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী বলছেন, নিজের জন্য না কি আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রাখতে ভোটের মাঠে আছেন তাদের দলের এসব নেতারা সেই প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছেন না তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বিএনপির বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী আছেন ৩৭ জন। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণে (মোট ৭৫টি ওয়ার্ড) বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন ১৪ জন এবং উত্তরে (মোট ৫৪টি ওয়ার্ড) আছেন ২৩ জন।

এসব প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরানোর উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। দলটির কেন্দ্র থেকে দেওয়া হয়েছে কঠোর বার্তা, তারপরেও এখনও অনেক নেতা প্রতিপক্ষ হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ায় সঙ্কটে থাকার কথা জানিয়েছেন দল সমর্থিতরা।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৬ নম্বরে ওয়ার্ডে (কাফরুল) বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান রাব্বি। তবে মূল দলের কাফরুল থানার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ একরাম হোসেন তার দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

হাবিব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এলাকায় আমার পোস্টারগুলো ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু দলের আরেক বিদ্রোহী প্রার্থী একরাম ভাইয়ের পোস্টারের কিছু হচ্ছে না। আশা করি, নির্বাচন ঘনিয়ে আসার আগেই দল উনাকে থামানোর উদ্যোগ নেবে।”

এই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগেরও দুজন প্রার্থী রয়েছে। বর্তমান কাউন্সিলর মতিউর রহমান মোল্লাকে সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। মোহাম্মদ আজিজুর রহমান স্বপন রয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে। 

“এখন পর্যন্ত নির্বাচনের পরিবেশ ভালো আছে। মাঠ আমার পক্ষে আছে, দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর বিষয়ে ভোটের আগেই নিশ্চিয় একটা সমাধান আসবে,” বলেন হাবিব।

হাবিবের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী ও থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ২০১৫ সালের নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত মেনে সকাল ১১টায় ভোট বর্জন করেছিলেন তিনি।

“কিন্তু বিকেলে ভোট গণনায় তারপরেও আমি বিজয়ী প্রার্থী ছিলাম। অনেক ‘মেকানিজম’ করে রাত ১২টার দিকে আমাকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি দীর্ঘ ৩৫ বছর বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ছাত্রদল, যুবদল করে মূল দলের সাধারণ সম্পাদক হয়েছি। তারপরও কেন দলীয় মনোনয়ন পেলাম না তা বোধগম্য নয়। আমার পরিবর্তে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সে একজন তরুণ। আমি তার বিষয়ে নেতিবাচক কিছু বলতে চাই না। আমি দলের কাছে জানতে চেয়েছি কী কারণে আমাকে নমিনেশন দেয়া হল না। কেন্দ্রের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা আমাকে নির্বাচন করার অনুমতি দিয়েছেন। বলতে পারেন এই ওয়ার্ডটি ওপেন করে দেওয়া হয়েছে। এখন ভোটটা যদি সুষ্ঠু হয় তাহলে বিজয় এনে দেখাব।”

বারিধারা, শাহজাদপুর, নর্দা ও কালাচাঁদপুর এলাকা নিয়ে গঠিত উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে  কাউন্সিলর প্রার্থী আছেন তিনজন, যাদের দুজনই বিএনপির।

এখানে আওয়ামী লীগের একমাত্র প্রার্থী বর্তমান কাউন্সিলর ও উত্তর যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. জাকির হোসেন ঠেলাগাড়ী প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সেখানে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী শরিফ উদ্দিন ব্যাডমিন্টন প্রতীকে এবং গুলশান থানা বিএনপির সহ-সভাপতি কাজী আব্দুল লতিফ আছেন ঝুড়ি প্রতীকে।

দলের কোন্দল ও অভ্যন্তরীণ সমস্যার বিষয়ে শরিফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রচার চালাতে গিয়ে বার বার প্রতিদ্বন্দ্বী জাকির হোসেন বাবুলের লোকজনের হামলার শিকার হচ্ছি। তারা নির্বাচনী কার্যালয় বন্ধ করে রেখেছে। এর সঙ্গে রয়েছে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী লতিফ। হাই কমান্ড বার বার বলার পরেও সে নির্বাচনে থেকে গেছে আওয়ামী লীগের ‘ডামি’ প্রার্থী হিসাবে।”

লতিফের সঙ্গে দলের লোকজন নেই দাবি করে বিএনপির প্রার্থী বলেন, “তার পোস্টারগুলোও লাগিয়ে দিচ্ছে আওয়ামী লীগ কর্মীরা।”

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে আব্দুল লতিফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গতবার দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলাম কিন্তু এবার দল আমাকে মনোনয়ন দেয়নি। এলাকার মানুষজন আমাকে চায়। আমি চাই আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্বাচনে থাকুক, বিএনপির মনোনীত প্রার্থীও নির্বাচনে থাকুক, ভোটটা সুষ্ঠু হোক। তাহলে দুজনকে পেছনে ফেলে বিপুল ভোটে জয়লাভ করতে পারব বলে আমি আশা রাখি। সুষ্ঠু ভোটে যদি হেরেও যাই তাহলে যে জিতবে তাকে স্বাগত জানাব।”

এই বিএনপি নেতা বলেন, “দলীয় মনোনয়ন না পেলেও জনগণের প্রতি আমার একটি প্রতিশ্রুতি আছে, আমি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াব না।”

তার পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন এই প্রার্থীও।

উত্তরের ২০ নম্বর ওয়ার্ডে দলের সমর্থন নিয়ে প্রার্থী হয়েছেন বনানী থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বাচ্চু। তবে মাঠে তাকে অস্বস্তিতে ফেলেছেন একই থানার যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সেলিম আহমেদ রাজু।

এ বিষয়ে বাচ্চু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাজু আমার ছোট ভাই। তাকে হাত ধরে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে নির্বাচন চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে অনড়। তবে দলের নেতাকর্মীরা তার সঙ্গে নেই।”

নির্বাচনী প্রচারণা নির্বিঘ্নে চালাতে পারছেন বলে জানালেও বিভিন্ন স্থানে তার পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন এই প্রার্থীও।

তেজগাঁও এলাকায় ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন থানা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক সাইফুল ইসলাম কাজল। এখানে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে আছেন প্রজন্ম দলের নেতা হাশেম মিয়া ও শেখ জিয়াউর রহমান বাবু।

হাশেম কিছুটা চুপশে গেলেও জিয়াউর রহমান দারুণ ‘হঠকারিতা করছেন’ বলে অভিযোগ করেন বিএনপি সমর্থিত কাজল।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দলের বিদ্রোহী প্রার্থী কাজল খুব সমস্যা করছে। এলাকায় তার কোনো জনসমর্থন নেই। সে বাহির থেকে পোলাপাইন নিয়ে এসে আমাদের প্রচারে ধাক্কাধাক্কি ও পোস্টার ছিঁড়াছিঁড়ি করছে।

“আমি নিজে তার সঙ্গে কথা বলে বহুবার তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। দলের হাই কমান্ড চেষ্টা করেছে। কিন্তু সে কিছুতেই থামছে না।”

এই আসনে আওয়ামী লীগেরও একজন বিদ্রোহী প্রার্থী আছে বলে জানান কাজল।

ঢাকা দক্ষিণে মতিঝিল থানা বিএনপির নেতা আলমগীর হোসেন জানান, কমলাপুর ও গোপীবাগ মিলিয়ে তার নির্বাচনী এলাকা ৮ নম্বর ওয়ার্ড। এর মধ্যে কমলাপুর এলাকা থেকে তিনি একাই ভোটে আছেন রেডিও প্রতীকে।

আর গোপীবাগ এলাকা থেকে আছেন আওয়ামী লীগের লাটিম প্রতীকের সুলতান মিয়া ও ঘুড়ি প্রতীকের ইসমাইল জবিউল্লাহ।

এর মধ্যে গোপীবাগ থেকে ঠেলাগাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়েছেন বিএনপি নেতা সাজ্জাদ হোসেন সিদ্দিকী। গত জাতীয় নির্বাচনে তিনি ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী হয়েছিলেন, এবার দলীয় মনোনয়ন না চেয়ে সরাসরি কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন।

আলমগীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থী গোপীবাগ এলাকার। আমি একা কমলাপুর এলাকার। ফলে নির্বাচনের মাঠে এগিয়ে থাকা আমার পক্ষে খুব সহজ হবে। আমি ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছি। এখন পর্যন্ত প্রচারণায় কোনো বাধা পাচ্ছি না।”

নিজের ভোটের পাশাপাশি মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন এবং সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থীর লিফলেটও বিতরণ করছেন বলে জানান তিনি। 

নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থীকে নিয়ে আলমগীর বলেন, “গতবার জাতীয় নির্বাচন করার পর এখন তিনি কেন যে কাউন্সিলর পদে দাঁড়িয়েছেন তা আমার বোধগম্য নয়। তিনি দলীয় ফোরামে সমর্থন সংগ্রহ করতেও যাননি। নিজে থেকে দাঁড়িয়ে গেছেন।”

দক্ষিণের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির সমর্থন পেয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সহ-সভাপতি মীর আশরাফ আলী আজম। আগেও তিনি এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন। তবে এবার দল থেকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন বদিউল আলম সুইট। আর আওয়ামী লীগ প্রার্থী হাসিবুর রহমান মানিকের সঙ্গে হাসিব উদ্দিন রসি বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন।

আলী আজম দাবি করেন, এই ওয়ার্ডে তার দলের কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী নেই।

“তবে প্রচারে বাধা আসছে প্রতিপক্ষের প্রার্থীদের কাছ থেকে। তারা পোস্টার ছিঁড়ে ফেলছে।”