এরশাদের মৃত্যুর পর কী বলছেন সেই ছাত্রনেতারা

এইচ এম এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিলেন তারা; আন্দোলনে বিজয়ের পর সেই ছাত্রনেতাদের বীরের চোখেই দেখেছিল পুরো দেশ। কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে এসে তারা এখন একেকজন এখন একেক অবস্থানে, আর এরশাদকে নিয়ে মূল্যায়নেও দেখা দিয়েছে ফারাক।

সুমন মাহমুদও কাজী মোবারক হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 July 2019, 01:48 PM
Updated : 14 July 2019, 02:11 PM

অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে আট বছর দেশ শাসনের পর ছাত্র-গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত এরশাদের মৃত্যু হয়েছে রোববার; রাষ্ট্রক্ষমতা হারালেও বাংলাদেশে পরবর্তী রাজনৈতিক মেরুকরণে গুরুত্ব নিয়েই ছিলেন এরশাদ।

কিন্তু যে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতৃত্বে এরশাদবিরোধী আন্দোলন বেগবান হয়েছিল, সেই সময়কার ছাত্রনেতাদের তখনকার ঘোষণার উল্টো পেথেই রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হয়েছিলেন এরশাদ।

তখন ডাকসুর ভিপি হিসেবে ছাত্রদল সভাপতি আমানউল্লাহ আমান ছিলেন সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের আহ্বায়ক। এখন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে রয়েছেন তিনি।

এরশাদের মৃত্যুতে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি আমানের।

আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের তখনকার সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব দল আদর্শ পাল্টে এখন আমানের সঙ্গে বিএনপিতে আছেন।

হাবিবুর রহমান হাবিব

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একজন রাজনীতিবিদ মারা গেলে আমরা সাধারণত একটা স্টেটমেন্ট দিই, মাগফেরাত কামনা করি। উনার ক্ষেত্রে এসব প্রযোজ্য না। কারণ উনি বয়স শেষ করে গেছেন। উনার আর এদেশের মানুষকে দেওয়ার কিছু ছিল না,ভালো কিছু দেওয়ার ছিল না। উনার জন্য দুঃখ করে, হা-হুতাশ এখানে প্রয়োজন নেই।”

হাবিব বলেন, “উনি (এরশাদ) রাজনীতি শুরু করেছেন অবৈধভাবে। লাস্ট দিন পর্যন্ত উনি কর্দমাক্ত রাজনীতিতে ছিলেন। উনি যে সংসদের বিরোধী দলের নেতা হয়েছেন, তাও উনি অবৈধভাবে হয়েছেন, অবৈধ সংসদের মাধ্যমে।

“আমি এটুকু শুধু বলব, মানুষ চলে গেলে বলার কিছু নেই, কিন্তু অপকর্ম ঢাকার কোনো সুযোগ নেই।”

এরশাদ আমলের নিপীড়নের কথা তুলে ধরে সাবেক এই ছাত্রনেতা বলেন, “তিনি নির্বাচিত একটি সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন, অবৈধ ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য অনেকগুলো মানুষকে হত্যা করেছেন যেমন, দীপালী সাহা, জাফর, জয়নাল, সেলিম, দেলোয়ার, ময়েজউদ্দিন, মাহফুজ, তাজুল, জেহাদ, ডা. মিলন, নুর হোসেন।

“রাজনৈতিক ময়দানে শেখ হাসিনার (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) মিটিংয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। এসব করেছে ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য।

“তার এই অপকর্মগুলো, তার কারণে এতগুলো সম্ভাবনাময় মানুষের জীবন গেল। ময়েজউদ্দিন ভাইয়ের মতো একজন ভালো রাজনৈতিক নেতা ছিলেন, তাজুলের মতো একজন শ্রমিক নেতা ছিলেন। আজকের তাদের পরিবারগুলোর কী অবস্থা? এর দায় কে নেবে?”

অসীম কুমার উকিল

হাবিবের সঙ্গে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা অসীম কুমার উকিল এখন আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক; এরশাদের দল জাতীয় পার্টিকে জোটে নিয়ে আওয়ামী লীগ গত নির্বাচনও করেছে।

এরশাদকে বাংলাদেশের রাজনীতির ‘নানা অঘটন আর ঘটনের নায়ক’ বললেও তার শেষ দিনের কার্যক্রমকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন অসীম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা অঘটন-ঘটনের নায়ক ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেসকল ক্ষত ও দুর্বল স্থান আছে, সবগুলোই সৃষ্টি করে গেছেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদ। আর এর জন্য সমাজকে মূল্য দিতে হয়েছে, এখনও হচ্ছে।

“তবে শেষ পর্যন্ত তিনি অনুধাবন করতে পেরে গণতন্ত্রের চাকাকে সুদৃঢ় করতে কাজ করার চেষ্টা করেছেন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি বেঁচে থাকবেন দীর্ঘ দিন।”

জহির উদ্দিন স্বপন

সেই সময়ে ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি জহিরউদ্দিন স্বপন এখন রয়েছেন বিএনপিতে; তার চোখে, এরশাদ বাংলাদেশের রাজনীতির অনেক ‘ঘটনা ও দুর্ঘটনার নায়ক’।

তিনি বলেন, “ অবৈধ শাসক হিসেবে উনার বিরুদ্ধে সরাসরি আন্দোলন করার অভিজ্ঞতাও আমাদের রয়েছে। মানবিক শোকের পাশাপাশি তার এই রাজনৈতিক ভুমিকাও বাংলাদেশের ইতিহাসে যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ থাকবে।”

তখনকার ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবুলও হাবিব, স্বপনের মতো এখন বিএনপিতে রয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশের মানুষের কাছে এরশাদের একটা বিশেষ পরিচয় আছে, সেই পরিচিতি হচ্ছে, উনি একজন ঘৃণিত স্বৈরশাসক। উনি জনগণের একটি নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে জোর করে ক্ষমতা দখল করেছেন, গণতন্ত্রকে উনি হত্যা করেছেন, দেশে স্বৈরশাসন উনি কায়েম করেছেন।

মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল

“আমরা তার এই স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র এবং ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছিলাম। ছাত্র-জনতার সেই ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে উনি নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছেন। উনার হাতে আমাদের অসংখ্য সহকর্মীর রক্তের দাগ লেগে আছে। এই ইতিহাস তো ভুলে যাওয়া যাবে না।”

ছাত্রদল নেতা নাজিরউদ্দিন জেহাদ ও চিকিৎসক নেতা শামসুল আলম মিলনের মৃত্যু নব্বইয়ে বেগবান করেছিল আন্দোলন, যা পতন ডেকে আনে এরশাদের।

তখন মিলনের সঙ্গেই ছিলেন মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসেসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব এখন একই সংগঠনের সভাপতি, আছেন আওয়ামী লীগে।

২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলিতে মিলন নিহত হওয়ার সময় তার সঙ্গে একই রিকশায় ছিলেন মোস্তফা জালাল।

ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (তখন পিজি হাসপাতাল) একটা প্রোগ্রামে যাচ্ছিলাম আমি আর মিলন। আমার রিকশাটা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় উপস্থিত হয়েছে, তখন মিলন আরেকটি রিকশায় করে আমাকে ক্রস করে সামনে চলে যাচ্ছিল।

“তখন আমি মিলনকে বললাম, তুমি আমার রিকশায় আস। এরপর মিলন আমার রিকশায় এসে ডানদিকে বসল। রিকশাওয়ালা ঠিকমতো একটা প্যাডেলও দিতে পারে নাই। মনে হলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে থেকে গুলি আসল। গুলিটা মিলনের বুকের পাশে লেগেছে। তখন মিলন বলল, ‘জালাল ভাই, কী হইছে দেখেন’। একথা বলার সাথে সাথে সে আমার কোলে ঢলে পড়ল।”

মিলনের লাশ আন্দোলনে কীভাবে গতি এনেছিল, তার বর্ণনা দিয়ে চিকিৎসক নেতা জালাল বলেন, “এরশাদ সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল চেষ্টার অংশ হিসেবে ডা. মিলনকে হত্যা করে। পরিকল্পিতভাবে ডা. মিলনকে হত্যা করা হয়েছিল। এর পর যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে, এটা ছিল এরশাদ পতনের টার্নিং পয়েন্ট।  তখন এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠে।”

“তবে শেষ পর্যন্ত হলেও এরশাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে। গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি মাথায় নিয়ে কয়েক দফা সরকারের সঙ্গে ছিলেন,” এরশাদের পরবর্তী ভূমিকার মূল্যায়ন করেন আওয়ামী লীগ নেতা জালাল।