বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরশাদ অধ্যায়ের অবসান

বাংলাদেশে ‘স্বৈরাচার’ তকমাটি কেবল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গেই এঁটে আছে; তারপরও গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আলোচনা-সমালোচনা-বিতর্কের মধ্যে তিনি টিকে ছিলেন রাজনীতিতে; রোববার তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতির সেই অধ্যায়ের অবসান ঘটল।

সুমন মাহমুদ প্রধান রাজনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 July 2019, 05:04 AM
Updated : 17 July 2019, 10:58 AM

অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলসহ বাংলাদেশে নেতিবাচক অনেক ধারা সৃষ্টির জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত এবং ‘বিশ্ব বেহায়া’ হিসেবে শিল্পীর তুলিতে চিহ্নিত হলেও নিজের সমর্থকদের কাছে ‘নায়ক’র মতোই ছিলেন এরশাদ। আর্থিক কেলেঙ্কারি, নারীদের নিয়ে কেলেঙ্কারি, রাজনীতিতে একের পর এক ‘ডিগবাজি’ ছাপিয়ে তাদের কাছে তিনি ছিলেন ‘পল্লীবন্ধু’।

এরশাদের জন্ম ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহারে। অবিভক্ত ভারতে শিশুকাল কুচবিহারে কাটে তার। ভারত ভাগের পর তার পরিবার চলে আসে রংপুরে; পেয়ারা ডাকনামে পরিচিত এরশাদের কলেজের পড়াশোনা চলে রংপুরেই।

জন্মস্থান ভারতের কুচবিহারে কয়েক বছর আগে সংবর্ধনা পান এইচ এম এরশাদ (ছবি: সংগৃহীত)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এরশাদ। পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে অ্যাডজুট্যান্ট, পশ্চিম পাকিস্তানের ৫৪তম ব্রিগেডের মেজর, তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অধিনায়ক এবং সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) সেক্টর কমান্ডার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় পশ্চিম পাকিস্তানেই ছিলেন এরশাদ। তার ভাষ্য, তিনি বন্দি হিসেবে সেখানে ছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়ার তথ্য তুলে ধরে অনেকে তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

এইচ এম এরশাদ যখন সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন (সংগৃহীত ছবি)

পাকিস্তান থেকে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে ফেরার পর মামা রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ভোলা মিয়ার (বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিমন্ত্রী) সুপারিশে এরশাদকে সেনাবাহিনীর চাকরিতে ফেরত নেওয়া হয় বলে সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম তার বইয়ে লিখেছেন।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল  হন তিনি; তখন তার পদমর্যাদা ছিল কর্নেল।

১৯৭৫ সালে এরশাদ ভারতের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে প্রতিরক্ষা কোর্সে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। ওই বছরের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি সেখানেই ছিলেন।

সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ দেশের প্রথম সেনাপ্রধান এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে (ছবি: সংগৃহীত)

ওই ঘটনার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসা জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হওয়ার পর তার উদ্যোগে ভারত থেকে এনে এরশাদকে করা হয় সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান, মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে।

পাকিস্তান প্রত্যাগত এরশাদকে জিয়ার এই পদোন্নতি দেওয়া তখন ভালো চোখে দেখেননি মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তারা।

এক জনসভায় এইচ এম এরশাদ; তখন তিনি রাষ্ট্রপতি

জিয়ার এক সময়ের ঘনিষ্ঠ অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ হামিদ তার বইয়ে লিখে গেছেন, এরশাদকে নির্বিষ ভেবে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঠেকাতে তাকে নিজের পরের পদটিতে বসিয়েছিলেন জিয়া।

জিয়া রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ১৯৭৮ সালে ‘নির্বিষ’ এরশাদকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান করেন; কিন্তু সেই এরশাদই তার জন্য ‘কাল’ হয়ে দাঁড়ান বলে বিএনপি নেতারা এখন বলছেন।

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে যে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হন, তার পেছনে এরশাদই কলকাঠি নেড়েছিলেন বলে জিয়ার স্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অভিযোগ।

ওই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নেতা মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরকে তখন হত্যা করা হয়েছিল, সেই হত্যার মামলা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বইতে হয়েছে এরশাদকে, যদিও রায় হয়নি।

এই রকম রাজকীয় চেয়ারেই বসতেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ

জিয়া নিহত হওয়ার পর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন এরশাদ। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। সামরিক শাসন জারি করে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন তিনি, স্থগিত করেন সংবিধান। প্রথমে বিচারপতি এ এফ এম আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদে বসিয়েছিলেন এরশাদ। কিন্তু সব ক্ষমতা ছিল কার্যত এরশাদেরই হাতে, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এরশাদের অনুমোদন ছাড়া কোনো ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ ছিল না রাষ্ট্রপতি আহসানউদ্দিনের।

তার এক বছর পর আর রাখঢাক না রেখে আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে সরিয়ে নিজেই রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসেন এরশাদ; যার এই ক্ষমতারোহণ অবৈধ বলে পরে রায় আসে আদালতের।

১৯৮৮ সালে বানভাসি মানুষের কাছে যেতে হাঁটুপানিতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ (ছবি: সংগৃহীত)

ক্ষমতায় বসার পর ‘গুরু’ জিয়াউর রহমানকে অনুসরণ করে রাজনৈতিক চাল চালতে থাকেন তিনি। প্রথমে জনদল নামে একটি দল তার পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল, যা ছিল তার রাজনীতিতে নামার প্রথম ধাপ। এরপর বিএনপি ও আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে গড়ে তোলেন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় পার্টি’, মৃত্যু পর্যন্ত এই দলটির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতেই। এরশাদ বলতেন, এটা তার দল।

প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরণের উদ্যোগে উপজেলা গঠন করেন এরশাদ, তাতে প্রথম নির্বাচনের পরীক্ষায় নামে জাতীয় পার্টি; আর তাতে প্রায় সব উপজেলায়ই এরশাদের দলের প্রার্থী চেয়ারম্যান হন।

উপজেলা নির্বাচনের পর রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন দিয়ে নিজের ক্ষমতা দখলকে জায়েজ করেন এরশাদ। এরপর ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচন দেন, যাতে জাতীয় পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক হয়ে আছে নূর হোসেনের এই ছবি

তবে এরশাদের আমলের ওই নির্বাচন কেমন ছিল, তা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্য ‘হুন্ডা-গুণ্ডা দিয়ে’ ভোটের কথায়ই ফুটে ওঠে।

এদিকে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। ১৯৮৩ সালে হয় প্রথম সরব প্রতিবাদ, ১৯৮৩ সালে সালে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে গুলিতে প্রাণ হারান জাফর, জয়নাল, দীপালী সাহাসহ বেশ কয়েকজন। তারপরের বছরই ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ ট্রাক তুলে দিয়ে হত্যা করে সেলিম-দেলোয়ারকে।

দমন-আর নির্যাতনের মুখে ছাত্র আন্দোলন আরও বেগবান হতে থাকে, শ্রমিকসহ পেশাজীবীরাও নামে আন্দোলনে। আর তা দমন করতে গিয়ে নুর হোসেনসহ অনেকের রক্তে রঞ্জিত হয় এরশাদের হাত।

ছাত্র ও পেশাজীবী আন্দোলনের চাপে রাজনৈতিক দলগুলো এক হয় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিলেও ১৯৮৮ সালে সব দল একযোগে বর্জন করে সংসদ নির্বাচন।

নব্বইয়ের গণআন্দোলনে নতুন মাত্রা দিয়েছিল কামরুল হাসানের এই স্কেচ

তারপর আন্দোলন আরও ব্যাপকতা পায়, যা সুনির্দিষ্ট পরিণতি পায় ১৯৯০ সালে। বিএমএ নেতা ডা. শামসুল আলম মিলন ও ছাত্রনেতা নাজির উদ্দিন জেহাদ নিহত হওয়ার পর তুমুল আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা ছাড়ার ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। তিন জোটের আস্থাভাজন ব্যক্তি হিসেবে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়ে ৬ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করেন।

এরপর রাষ্ট্রপতির পদে বসেন শাহাবুদ্দিন আহমদ; তার অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের পথে বাংলাদেশের পুনঃযাত্রা শুরু হয়।

গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত এরশাদ বন্দি হন তখন, তার বিরুদ্ধে হয় অনেকগুলো দুর্নীতির মামলা। কিন্তু তার মধ্যেই চমক দেখিয়ে ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে রংপুরের ৫টি আসন থেকে বিজয়ী হন এরশাদ।

এরপর বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টিতে জনধিকৃত এরশাদই একটি অবস্থান পেয়ে গিয়েছিলেন। কখনও আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে, কখনওবা বিএনপির দিকে ঝুঁকে নিজের পথ করতে দেখা গিয়েছিল তাকে।

ওই সময় ৪২টির মতো মামলা হয়েছিল এরশাদের বিরুদ্ধে; তাকে বাগে আনতে এই সব মামলাগুলোর ব্যবহারও পরে দেখা গেছে।

রাজনৈতিক আলোচনায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে এইচ এম এরশাদ (ছবি: সংগৃহীত)

এরশাদকে ‘পুনর্বাসনে’ ক্ষমতায় যাওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকায় মনোবেদনা প্রকাশ করে শহীদ শামসুল আলম মিলনের মা সেলিনা আখতার বলেছিলেন, “সারাবিশ্বে স্বৈরশাসককে দেশ ছাড়তে হয় নতুবা বিচারের মুখোমুখি করে কঠোর শাস্তি দিতে দেখা যায়। অথচ আমাদের এখানে স্বৈরশাসককে ছুড়ে না ফেলে ক্ষমতাসীন দলে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এটা কেবল বাংলাদেশে সম্ভব হয়েছে।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ

১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের শাসনামলে কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান এরশাদ; দলের নেতৃত্বভার নেন স্ত্রী রওশন এরশাদের কাছ থেকে। 

এরপর বিভিন্ন সময় নানা ভাগ হয় এরশাদের দল। মূল দল নিয়ে ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যোগ দেন তিনি। এরপর টানাপড়েন ও নানা অনুযোগ করলেও আওয়ামী লীগের কাছাকাছিই থেকেছিলেন এরশাদ।

২০১৪ সালে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসেন তিনি। নিজে হন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে সংসদে প্রধান বিরোধী দলের নেতার আসনে বসেন তিনি। এই পদে থেকেই পৃথিবী থেকে চিরপ্রস্থান ঘটেছে তার।

এরশাদের নয় বছরের শাসনকালে অবকাঠামোর উন্নতির দিকটিই তার সমর্থকরা বেশি করে দেখান, তবে অবাধ দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরিতে এরশাদের সেদিকে আগ্রহ ছিল বলে সমালোচকরা বলেন।

উপজেলা পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য কৃতিত্ব নেন এরশাদ; কিন্তু তাও তার রাজনৈতিক অভিলাষ বাস্তবায়নের ধাপ হিসেবেই দেখেন সমালোচকরা।

রাষ্ট্রপতি থাকাকারে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের এক সম্মেলনে এইচ এম এরশাদ

এরশাদ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী এনে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যুক্ত করেন, যা বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বদলে দেয় বলে সমালোচনা করলেও এরপর সংবিধান সংশোধন হলেও স্পর্শকাতর এই বিষয়টি কেউ স্পর্শ করতে চাননি।

ঢাকার বাইরে হাই কোর্টের বেঞ্চ স্থাপনসহ আরও নানা পদক্ষেপে বিতর্কিত ছিল এরশাদের ক্ষমতার যুগ।

গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত থাকায় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অন্য পেশাজীবীদের সঙ্গে শামিল ছিলেন সাংবাদিকরাও।

এর মধ্যেও এরশাদের সময়ে প্রণীত ওষুধ নীতি প্রশংসা পায় সমালোচকদেরও; তার গুচ্ছ গ্রাম প্রকল্প ও পথশিশুদের জন্য পথকলি ট্রাস্টও ছিল আলোচিত।

সাইকেল চালিয়ে অফিস করার মতো চমকও দেখাতে চাইতেন এইচ এম এরশাদ (ছবি: সংগৃহীত)

এরশাদের সময়েই ১৯৮৫ সালে গঠিত হয় দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক, তবে ভারত-পাকিস্তান টানাপড়েনে তা কখনই কার্যকর হয়ে উঠতে পারেনি। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে একের পর এক বিদেশ সফর নিয়েও সমালোচিত ছিলেন এরশাদ।

নিজেকে কবি হিসেবে পরিচয় দিতে চাইতেন এরশাদ; ক্ষমতায় থাকার সময় তার তার লেখা কবিতা-গান রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে শোনানো হত, তবে সেগুলো আদতে তার লেখা ছিল কি না, তা নিয়ে ছিল মানুষের সন্দেহ।

রওশনের আগে এরশাদের আরেকটি বিয়ের কথা আলোচনায় ছিল বহু দিন; ক্ষমতায় থাকাকালে বিভিন্ন নারীর সঙ্গে তার সম্পর্কও ছিল আলোচনায়। এ নিয়ে এরশাদের ভাষ্য ছিল, তিনি নারীদের কাছে যান না, নারীরাই তার কাছে আসে।

হোয়াইট হাউসে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগানের সঙ্গে বৈঠকে এইচ এম এরশাদ (ছবি: সংগৃহীত)

পরে কবিকন্যা বিদিশাকে এরশাদের বিয়ে করাও ছিল আলোচিত ঘটনা; তাদের এই বিয়ে টেকেনি। তবে বিদিশার গর্ভে নিজের ছেলে এরিক এরশাদ ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়; যদিও রওশনেরও একটি ছেলে রয়েছে।

এরশাদের ঘনিষ্ঠ একজন বলেন, জীবন সায়াহ্নে তার ভাবনা ছিল শুধু এরিককে নিয়ে।

গত রোজায় নিজের বারিধারার বাড়িতে এতিমদের সঙ্গে ইফতার করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় নেতা এইচ এম এরশাদ, তার সঙ্গে ছেলে এরিক এরশাদও ছিলেন

ক্ষমতায় থাকাকালে ‘গরিব দেশের ধনী প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত এরশাদ তার সম্পত্তি দিয়ে গেছেন ট্রাস্টে।

ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এরশাদ গত সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় লিখেছিলেন, তার নগদ টাকার পরিমাণ ২৮ লাখের মতো। তার বার্ষিক আয় ১ কোটি ৭ লাখ টাকা। বিভিন্ন শেয়ারে তার অর্থের পরিমাণ ৪৪ কোটি ১০ হাজার টাকা। তার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ও এফডিআর ৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। গুলশান ও বারিধারায় দুটি ফ্ল্যাট এরশাদের; রয়েছে তিনটি গাড়ি।

রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় সাইকেল চালিয়ে অফিসে যাওয়া, হুট করে কোনো মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়ার মতো চটকদারি দেখাতে চাইতেন এরশাদ; গলফ নিয়েও ছিল তার মাতামাতি। নিজেকে ‘ফাদার অব বাংলাদেশ ক্রিকেট’ বলতে মজা পেতেন তিনি।

এইচ এরশাদের পছন্দ ছিল গলফ খেলা; নিজেকে ‘ফাদার অব বাংলাদেশ ক্রিকেট’ও বলতেন তিনি (ছবি: সংগৃহীত)

এসব ছাপিয়ে এরশাদ প্রতিবারই নির্বাচন এলে হয়ে উঠে আসতেন আলোচনায়, বড় দলগুলোর কাছে কদর বাড়ত তার। আবার ভোটের সময়গুলোতে বার বার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন ঘটত তার, যাকে ‘রাজনীতির বিনোদন’ হিসেবে দেখত বাংলাদেশের মানুষ।

এরশাদ বলতেন, মনে অনেক কষ্ট নিয়েই তাকে সিদ্ধান্ত বারবার বদলানোর কাজটি করতে হয়। বলতেন, ‘সময় হলে’ সব বলবেন তিনি। কিন্তু সেই সময় আসার আগেই পৃথিবীতে তার সময় শেষ হয়ে গেল।