ঐক্য চাইলে জামায়াতকে ছাড়ুন: বিএনপিকে বিকল্প ধারা

নির্দলীয় সরকার প্রশ্নে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনমনীয় অবস্থানের মধ্যে বিএনপিকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চাইলেও তাদের জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ছাড়ার শর্ত দিয়েছে বিকল্প ধারা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকও নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Sept 2018, 03:04 PM
Updated : 25 Sept 2018, 04:50 PM

মঙ্গলবার রাতে ঢাকার বারিধারায় বিকল্প ধারা সভাপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাড়িতে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার এক বৈঠকে বিএনপির প্রতিনিধিকে এই শর্ত জানিয়ে দেওয়া হয়।

এই বৈঠকে ‘পর্যবেক্ষক’ হিসেবে ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। তার সঙ্গে ছিলেন বিএনপি সমর্থক পেশাজীবী নেতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কেউ ছিলেন না এই বৈঠকে।

বিকল্প ধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহি বি চৌধুরী বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেন, “স্বাধীনতাবিরোধী দল বা ব্যক্তির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোনো ঐক্য হতে পারে না। বিএনপির সঙ্গে আমরা জাতীয় ঐক্য চাই, তবে এই ঐক্যে আসতে হলে বিএনপিকে অবশ্যই জামায়াতকে ছেড়ে আসতে হবে।”

বিকল্প ধারার জামায়াত ছাড়ার প্রস্তাব নিয়ে বৈঠকে অংশ নেওয়া টুকু কিংবা বিএনপির অন্য কোনো নেতার সুনির্দিষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

বৈঠকের পর বি চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে বিএনপি ২৯ সেপ্টেম্বর তাদের জনসভায় বার্তা দেবে।

তিনি বলেন, “আমাদের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা বিএনপির অনেক কাছাকাছি এসেছি। আজকের বৈঠকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের প্রতিনিধি ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

“আমরা দ্রুত একটা লিয়াজোঁ কমিটি করব। এ ব্যাপারে আজকের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিএনপির প্রস্তাব অনুসারে আমরা ২৯ তারিখের পরে এই লিয়াজোঁ কমিটি করব। কারণ তারা ২৯ সেপ্টেম্বর জনসভার মাধ্যমে আমাদের সাথে ভবিষ্যৎ প্রক্রিয়া কী হবে এবং তাদের নীতি সম্পর্কে বিবৃতি দেবেন।”

দলের কী বার্তা নিয়ে এসেছিলেন- সাংবাদিকরা জানতে চাইলে টুকু বলেন, “স্যার (বি চৌধুরী) বলে দিয়েছেন, আমি কী নিয়ে এসেছি। আমার বলার কিছু থাকে না। আমাদের ২৯ তারিখে যে জনসভা আছে, সেই সভা থেকে আমরা আমাদের পরিকল্পনা জনগণের কাছে দেব।”

ঐক্য প্রক্রিয়া সফলতার দিকে এগিয়ে নেওয়ার ইচ্ছার কথা বলেন তিনি।

বি চৌধুরীও বলেন, “যারা মুক্তিযুদ্ধের মানচিত্রকে এখনও অস্বীকার করে, আমরা তাদের বাদ দিয়ে সকল গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য কামনা করি।”

যুক্তফ্রন্টের সদস্য সচিব ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের বলেন, “জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া এগুচ্ছে। গত দুই দিনে সরকার এটাকে খুব হিসাব করছে। প্রথম স্বাগত পরে .....

“আজকের বৈঠকে বিএনপি অবজারভার হিসেবে এসেছেন। আমরা এটাকে গোছাবার জন্যে একটা লিয়াজোঁ কমিটি বা সমন্বয়ক কমিটি করব।”

বি চৌধুরীর বাড়িতে বৈঠকে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ও বিএনপি নেতারা

বাড়ির দোতলায় বি চৌধুরীর উপস্থিতিতে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ও বিএনপি নেতাদের বৈঠকের আগে নিচতলায় একটি সভায় বসেন মাহির নেতৃত্বে বিকল্প ধারার একদল নেতা। ওই সভায় ‘জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি বিকল্প ধারা বাংলাদেশ এবং অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দের আহ্বান’ শীর্ষক প্রস্তাব গৃহীত হয়।

এই বৈঠকে মাহি বলেন, “স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ঐক্য থাকলে তাদের সঙ্গে আমরা নাই।”

বিএনপির এক সময়ের সংসদ সদস্য মাহি বলেন, “বিএনপির শতকরা ৯০ ভাগ নেতা-কর্মী জামায়াতের বিরোধী, কিন্তু মুখে বলতে পারে না। আমরা যদি শক্ত অবস্থান নিই, তাহলে বিএনপি তিন-চার সপ্তাহের মধ্যে জামায়াতকে ছেড়ে আসতে বাধ্য হবে।”

স্বাধীনতা বিরোধী দল বা ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত বিএনপিকে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত না করা এবং বিএনপির সঙ্গে কোনো অনুষ্ঠানে একই মঞ্চে না বসতেও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের অনুরোধ জানান মাহি।

এই সভায় ছিলেন বিকল্পধারা ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি মাহবুব আলী, ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি সাহিদুর রহমান, বিকল্প যুবধারার সভাপতি ওবায়েদুর রহমান মৃধা, বিকল্প শ্রমজীবী ধারার সভাপতি আইনুল হক, বিকল্প স্বেচ্ছাসেবক ধারার সভাপতি বি এম নিজাম উদ্দিন এবং প্রজন্ম বাংলাদেশের মহাসচিব যুবরান গাজী।

এরপর মাহি দোতলার বৈঠকে যোগ দেন। সেখানে টুকু ও জাফরুল্লাহ ছাড়াও ছিলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল –জেএসডির আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের মান্না।

জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার মূল নেতা গণফোরাম সভাপতি কামাল হোসেন এই বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলেও উপস্থিত ছিলেন ঐক্য প্রক্রিয়ার সদস্য সচিব আ ব ম মোস্তফা আমিন।

দোতলার বৈঠক শেষের পর মাহি সাংবাদিকদের জানান, দলের প্রস্তাব জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সভায় জানানো হয়। এই সংক্রান্ত সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব দলের সভাপতি ও তার বাবা বি চৌধুরীর উপর অর্পণ করা হয়েছে।

কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্প্রতি জোট বাঁধার সিদ্ধান্ত হয় বি চৌধুরী নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের। বিকল্প ধারা, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যকে নিয়ে গঠিত এই যুক্তফ্রন্ট।

একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোটসহ ৫ দফা দাবিতে গত শনিবার জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সমাবেশে যোগ দিয়ে এক সঙ্গে আন্দোলনের কথা বলেছিলেন বিএনপি নেতারা।

শনিবারের সমাবেশে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের সঙ্গে বিএনপি নেতারা (ফাইল ছবি)

ওই সমাবেশে বি চৌধুরী-কামাল হোসেনের হাতে হাত রেখে বিএনপি মহাসচিব ফখরুল বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে হটাতে যে কোনো মূল্যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চান তারা এবং তার কারাবন্দি নেত্রীও সেই নির্দেশনা দিয়েছেন।

বি চৌধুরীর জোট যুক্তফ্রন্টের সদস্য সচিব মান্নাও সেদিন বলেছিলেন, বিএনপির সঙ্গে ঐক্য হয়েই গেছে।

বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যৌথ আন্দোলনের কথাও বলেছিলেন তিনি।

তবে মঙ্গলবারের বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নে মান্না বলেন, “আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট, আমরা স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তি বা সংগঠনকে ঐক্যে আনছি না।”

বৈঠকে মাহমুদুর রহমান মান্না; তার পাশে বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু

বিএনপির দুই দশকের জোটসঙ্গী জামায়াতকে নিয়ে বিভিন্ন দলের আপত্তি রয়েছে। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সমাবেশে বিএনপির অংশগ্রহণ দেখে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একে সাম্প্রদায়িক শক্তির ঐক্য বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এর মধ্যেই বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার শর্ত দিল বিকল্প ধারা।

নির্দলীয় সরকারের অধীনে না হওয়ায় দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। ওই নির্বাচনে অংশ নেয়নি গণফোরামসহ যুক্তফ্রন্টের দলগুলোও।

একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে নিরপেক্ষ সরকার গঠন, ইসি পুনর্গঠন, বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে সেনা মোতায়েনের দাবি জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া তুলেছে। এই দাবিগুলো বিএনপিরও রয়েছে, সেই সঙ্গে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির শর্তও রয়েছে তাদের।

জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ঘোষণায় যে ৯টি লক্ষ্যের উল্লেখ রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা।

মঙ্গলবারের বৈঠকের পর মাহি বলেন, কোনো দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেশের মঙ্গল বয়ে আনবে না।

“তাই সংসদে, মন্ত্রিসভায় এবং প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ভারসাম্যের রাজনীতির ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য হতে হবে।”

বৈঠকে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নিউ ইয়র্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানান বি চৌধুরী।

আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহে যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া যৌথভাবে জনসভা করবে বলেও জানান তিনি।

বৈঠকে জেএসডির আবদুল মালেক রতন, তানিয়া রব, নাগরিক ঐক্যের শহীদুল্লাহ কায়সার, জাহেদুর রহমান, গণফোরামের আ ও ম শফিকউল্লাহ, জগলুল হায়দার আফ্রিক, বিকল্পধারার ওমর ফারুকও উপস্থিত ছিলেন।