তাকে শনিবার সকাল সোয়া ১১টার দিকে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন সড়কের পুরনো কারাগার থেকে বের করে নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)।
তার ‘পছন্দের’ কয়েকজন চিকিৎসক দেখার পর সেখানে তার এক্স রে করা হয়। দুই ঘণ্টা সেখানে থাকার সময় পুত্রবধু আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি ও নাতনিদের সঙ্গে কথা বলেন খালেদা।
এরপর আগের মতোই র্যাব-পুলিশের কড়া পাহারার মধ্যে দুপুর পৌনে ২টার দিকে কারাগারে ঢোকেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
খালেদার দুই ঘণ্টা হাসপাতালে অবস্থানের সময় বিভিন্ন ফটক আটকে দিয়েছিল পুলিশ; ফলে চিকিৎসাধীন রোগীদের স্বজনদের দুর্ভোগে পড়তে হয়েছিল।
দলীয় নেত্রীর যাওয়ার খবর শুনে শাহবাগে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে জড়ো হয়েছিলন বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী। তবে পুলিশের কড়া পাহারা ডিঙিয়ে ঢুকতে পারেননি অধিকাংশই।
জড়ো হওয়া নেতা-কর্মীদের ধাওয়া করা ছাড়াও পুলিশ ১৩ জনকে আটক করে বলে বিএনপি দাবি করেছে।
খালেদা জিয়াকে এভাবে আনাকে সরকারের ‘নাটক’ আখ্যায়িত করেছে বিএনপি। তারা মুক্তি দিয়ে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ দিতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছেন, কারাবিধি অনুসরণ করেই খালেদার স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছে। এনিয়ে বিএনপি নেতারা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।
বিএসএমএমইউ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহ আল হারুন জানিয়েছেন, হাসপাতালে শুধু এক্স রেই করা হয়েছে। এর প্রতিবেদন রোববারই কারা কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হবে।
বিএনপি চেয়ারপারসনকে ‘আপাতদৃষ্টিতে ভালো’ মনে হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হাসপাতালে পৌঁছার পর গাড়ি থেকে হেঁটেই নামেন ৭৩ বছর বয়সী খালেদা; এরপর লিফটেও হেঁটেই ওঠেন তিনি।
ব্রিগেডিয়ার হারুন বলেন, “আমরা উনার জন্য হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম; উনি আমাকে নিজেই বলেছেন, ‘আমি হেঁটে যেতে পারব, আমরা হুইল চেয়ার প্রয়োজন নেই’।
“উনি (খালেদা জিয়া) কেবিন থেকে হেঁটে রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগে এসেছেন। আবার হেঁটে গাড়িতে উঠেছেন। আমরা আপাতদৃষ্টিতে দেখেছি, উনি ভালো আছেন।”
গাড়ি থেকে মেনে ১৯ নম্বর লিফটের দিকে যাওয়ার সময় আলোকচিত্রীদের অনুরোধে সাড়া দিলেও অন্য সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নেরই কোনো জবাব দেননি তিনি।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় আদালত পাঁচ বছর কারাদণ্ডের রায় দেওয়ার পর থেকে পুরনো কারাগারে একমাত্র বন্দি হিসেবে রয়েছেন খালেদা।
সম্প্রতি তার অসুস্থতার খবর প্রকাশের পর তার চিকিৎসায় একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ‘গুরুতর নয়’ বলে বোর্ডের পক্ষ থেকে বলা হলেও শুক্রবার কারাগারে তাকে দেখে এসে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “ম্যাডামের স্বাস্থ্য খুব একটা ভালো নয়।”
তার পরদিন সকাল থেকেই পুলিশ ও কারা কর্তৃপক্ষের তোড়জোড়ে বোঝা যাচ্ছিল, বিএনপি চেয়ারপারসনকে কারাগার থেকে বের করা হচ্ছে। তবে কোনো কর্মকর্তাই মুখ খুলছিলেন না।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বিএসএমএমইউর কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক আলী আসগর মোড়ল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিশ্চিত করেন, খালেদাকে আনা হচ্ছে তার হাসপাতালেই।
সকাল সোয়া ১১টার দিকে পুলিশের কালো রঙের একটি গাড়িতে করে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে কারাগার থেকে বের করা হয় খালেদাকে। বহরের সামনে-পেছনে ছিল র্যাবের পাহারা।
সাড়ে ১১টার দিকে বিএসএমএমএইতে পৌঁছালে গাড়ি থেকে নামেন সাদার উপর কালো প্রিন্টের জামদানী শাড়ি পরা খালেদা জিয়া। নেমে হেঁটেই লিফটের দিকে যান তিনি।
বিএনপি চেয়ারপারসনকে বিএসএমএমইউতে আনার পর ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার শেখ নাজমুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের দায়িত্ব ছিল উনাকে নিরাপদে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া। তা আমরা করেছি। স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর উনাকে পুনরায় কারাগারে পৌঁছে দিতে হবে, আমার কাছে এটুকু তথ্য রয়েছে।”
খালেদা জিয়াকে কি হাসপাতালে রাখা হবে, না কি কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়া হবে, তার আগ পর্যন্ত তা জানা যাচ্ছিল না।
খালেদার জন্য একটি কেবিন তৈরি রাখার কথা জানিয়ে অধ্যাপক আলী আসগর মোড়ল তার আগে বলেছিলেন, হাসপাতালে থাকা না থাকাটি মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে হবে।
প্রায় ১০ বছর আগে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে কারামুক্ত অসুস্থ ছেলে তারেক রহমানকে দেখতে বিএসএমএমইউতে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া; এবার তার যাওয়া নিজের জন্য।
হাসপাতালে পৌঁছার পর খালেদা জিয়া ওঠেন ৫১২ নম্বর কেবিনে। চারজন চিকিৎসককে নিয়ে সেখানে যান হাসপাতালের পরিচালক।
তারা হলেন খালেদার ব্যক্তিগত চিকিৎসক হদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ মামুন, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এফ এম সিদ্দিকী ও নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. ওয়াহিদুর রহমান। অন্যজন কারাগারের এক চিকিৎসক।
এরপর হেঁটেই রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগে যান খালেদা জিয়া; সেখানে তার হাঁটু ও হাতের এক্স রে করা হয়।
খালেদা জিয়া ভেতরে থাকা অবস্থায় সাড়ে ১২টার দিকে দুই সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে উপস্থিত হন প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি।
তারা ঢুকতে চাইলে বাধা পান পুলিশের কাছ থেকে; তখন তারা কিছুক্ষণ গাড়িতে বসেছিলেন, তাদের ঘিরে ছিল মহিলা দলের একদল নেতা-কর্মীর জটলা।
এরপর শর্মিলা সন্তানদের নিয়ে হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে ঢোকেন। খালেদা জিয়া এক্স করিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পূত্রবধূ ও নাতনীদের সঙ্গে তার দেখা হয় বলে হাসপাতাল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি এক ফাঁকে কারা কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করেই তাদেরকে সেখানে পৌঁছিয়ে দিয়েছে। সিথিঁর সাথে ম্যাডামের কথা হয়েছে। নাতনিতে সাথেও তিনি কথা বলেছেন।”
সোয়া ২টার পর খালেদা জিয়া যখন ফেরার উদ্দেশে নিচে নামেন, বিএসএমএমইউর বিভিন্ন বহুতল ভবনের বারান্দায় তখন উৎসুক কর্মকর্তা-কর্মচারী ও রোগীর স্বজনরা বারান্দায় ভিড়; খালেদা জিয়াও তাদের উদ্দেশে হাত নাড়েন।
বেলা দেড়টার দিকে খালেদাকে নিয়ে কারাগারের পথে রওনা হয় একই গাড়ি; আগের মতোই পাহারা নিয়ে। পৌনে ২টার দিকে নাজিমউদ্দিন সড়কের কারাগারে ঢোকে গাড়িটি।
খালেদা জিয়া অবস্থানের সময় বিএসএমএমইউর ফটকে জড়ো হওয়া বিএনপিকর্মীরা স্লোগান দিলে তাদের ধাওয়া দেয় পুলিশ। কয়েক দফায় কয়েকজনকে আটকও করা হয়।
বিএনপির বিভিন্ন নেতা গিয়ে ফটকে আটকে পড়েন; দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের স্ত্রী মহিলা দলের সভানেত্রী আফরোজা আব্বাস পুলিশের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়ালেও তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
তবে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ, সানাউল্লাহ মিয়া, মাহবুবউদ্দিন খোকনসহ বেশ কয়েকজন নেতা ভেতরে ঢোকেন। মওদুদ সাংবাদিকদের বলেন, তার নেত্রীকে হাসপাতালে আনার বিষয়ে তাদের কিছু বলা হয়নি।
তিনি বলেন, “সরকারের চিকিৎসায় আমাদের একেবারেই বিশ্বাস নেই।
“তাকে একটি নির্জন, পরিত্যক্ত কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছে। সেখানে এমনিতেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আমরা চাই, তাকে মুক্তি দেওয়া হোক। তাহলে তিনি নিজের চিকিৎসা নিজের ডাক্তারদের দিয়ে করিয়ে সুস্থ হবেন বলে আমরা মনে করি।”
ঠিক ওই সময় তার এক কিলোমিটারের মধ্যে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, খালেদার স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়ে বিএনপি নেতারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভ্রান্তি ছড়াতে চাইছে।
অন্যদিকে পরে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দাবি করেন, তার নেত্রীকে জোর করে হাসপাতালে আনা হয়েছিল।
তিনি বলেন, “বোঝাই যাচ্ছে তাকে অনেকটা জোর করেই নিয়ে আনা হয়েছে। আমরা শুনেছি, কারাগারের তার কক্ষে গিয়ে বার বার তাগিদ দিয়েছে দ্রুত প্রস্তুতি নিতে।
“আমাদের প্রিয়নেত্রীকে তো কখনও এই লেবাসে দেখিনি। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম নারী হিসেবে ৩০/৩২ বছর ধরে তিনি শাড়ির ওপর চাদর অথবা ওড়না পরিধান করেন। আজকে সেটি পরিধান করারও সুযোগ দেওয়া হয়নি।”
এদিকে খালেদা জিয়া চলে যাওয়ার আধা ঘণ্টা পর সংবাদ সম্মেলনে এসে বিএসএমএমইউ পরিচালক হারুন বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের পছন্দের চিকিৎসকরাই তাকে দেখেছেন।
“উনাকে এক্সরে বিভাগে নেওয়ার সময়ে ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা তার সঙ্গে ছিলেন। কেবিনে তার চিকিৎসকদের সাথে উনি কথা বলেছেন। সেসময়ে আমিও ছিলাম।”
মোট চারজন চিকিৎসকের উপস্থিতি চেয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তাদের একজন অ্যাপোলো হাসপাতালের ডা. কে এম আলী হাসপাতাল ফটকে এলেও ঢুকতে পারেননি বলে জানা গেছে। ডা. মামুন বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য যে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে, সেই বোর্ডের চার চিকিৎসকের কেউ উপস্থিত ছিলেন না বলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হারুন জানান।
খালেদার জন্য যে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের অর্থোপেডিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. শামসুজ্জামান। বোর্ডে সদস্য রয়েছেন ডা. মনসুর হাবীব (নিউরোলজি), টিটু মিয়া (মেডিসিন) ও সোহেলী রহমান (ফিজিক্যাল মেডিসিন)।
বিএসএমএমইউর পরিচালক বলেন, মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকদের উপদেশে একাধিক অংশের এক্স রে হয়েছে। আগামীকাল রিপোর্ট দেওয়া হবে।
“এর আগেও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে, সেগুলো এবং আজকের পরীক্ষা মিলিয়ে চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ড চিকিৎসার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।”
দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করে খালেদা জিয়া জামিন চাইলেও তার আদেশ মে মাসের আগে হচ্ছে না। ফলে তার আগ পর্যন্ত তার করা মুক্তির সম্ভাবনা নেই।
“সুচিকিৎসার অভাবে দেশনেত্রীর কোনো ক্ষতি হলে এর দায় সরকারকেই নিতে হবে,” সরকারকে সেই হুঁশিয়ারি ইতোমধ্য দিয়ে রেখেছেন বিএনপি নেতা রিজভী।
[এই প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন লিটন হায়দার, নুরুল ইসলাম হাসিব, তারেক হাসান নির্ঝর, মোবারক হোসেন]