মহিউদ্দিন চৌধুরী আর নেই

প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী মারা গেছেন।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Dec 2017, 02:46 AM
Updated : 15 Dec 2017, 02:23 PM

চট্টগ্রাম নগরীর ম্যাক্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে তার মৃত্যু হয় বলে তার বড় ছেলে আওয়ামী লীগের সংগঠনিক সম্পাদক মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল জানান।

৭৪ বছরের জীবনে মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের মেয়র ছিলেন ১৬ বছর। একাত্তরের এই মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যু পর্যন্ত ছিলেন চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি।

তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ প্রয়াত এই নেতার আত্মার শান্তি কামনা করেছেন, শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি জানিয়েছেন সমবেদনা।

আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, চট্টগ্রামের মানুষের উন্নয়ন ও কল্যাণে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মহিউদ্দিনের অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও এই আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।

হৃদরোগ ও কিডনি জটিলতায় আক্রান্ত মহিউদ্দিনকে গতমাসে সিঙ্গাপুরে নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়েছিল। অবস্থার একটু উন্নতি হলে ঢাকা থেকে দুদিন আগে তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল চট্টগ্রামে। কিন্তু সেই উন্নতি স্থায়ী হয়নি।

বৃহস্পতিবার দুপুরে কিডনি ডায়ালাইসিসের জন্য মেহেদীবাগের ম্যাক্স হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। পরে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয় বলে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. লিয়াকত আলী জানান।

নওফেল ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পৌঁছানোর পর রাত ৩টার পর তার বাবার লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়ার কথা সাংবাদিকদের জানানো হয়।

হাসপাতালে উপস্থিত সাংবাদিকদের নওফেল বলেন, “চট্টগ্রামের মানুষের প্রিয় মানুষ ছিলেন আমার বাবা। ঢাকায় একটু সুস্থ হওয়ার পর তিনি চট্টগ্রামে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। সে কারণেই নিয়ে আসা হয়েছিল।

“কিন্তু গতকাল হাসপাতালে আনার পর তার কার্ডিয়াক অ্যাটাক হয়। প্রথমে আইসিইউতে নিলেও পরে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। এক পর্যায়ে তার আর কোনো সাড়া না পাওয়ায় সবার সঙ্গে আলোচনা করে লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়েছে।”

হাসপাতালে মহিউদ্দিনের মৃত্যুর খবর জানান তার ছেলে মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল

হাসপাতালে মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী হাসিনা মহিউদ্দিনসহ পরিবারের সদস্যরা

মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর খবরে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে নেমে আসে শোকের ছায়া। হাসপাতালে অনেককেই চোখ মুছতে দেখা যায়। এই আওয়ামী লীগ নেতার স্ত্রী হাসিনা মহিউদ্দিনসহ পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন হাসপাতালে।

শুক্রবার সকালে মহিউদ্দিনের মরদেহ নগরীর ষোলশহর এলাকায় তার চশমা হিলের বাসায় নিয়ে যাওয়া হলে সেখানেও নেতাকর্মীরা ভিড় করেন শেষবার তাকে দেখতে।

ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ছুটে আসা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “প্রধানমন্ত্রী চেয়েছিলেন উনাকে মন্ত্রী করতে, চেয়েছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য করতে। কিন্তু মহিউদ্দিন ভাই রাজি হননি। চট্টগ্রাম ছেড়ে গিয়ে তিনি কিছুই চাননি।”

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, “মহিউদ্দিন ভাইকে হারানোর ব্যথা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। শুধু নগর আওয়ামী লীগ নয়, পুরো চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের তিনি অভিভাবক।”

দুপুরে দারুল ফজল মার্কেটে মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে দলীয় নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় শেষ বিদায় জানায় মহিউদ্দিন চৌধুরীকে।

বিকালে লালদীঘি মাঠে হাজারো মানুষ মহিউদ্দিন চৌধুরীর জানাজায় অংশ নেয়। তার আগে এই মুক্তিযোদ্ধার প্রতি জানানো হয় রাষ্ট্রীয় সম্মান, দেওয়া হয় গার্ড অব অনার।

সন্ধ্যায় চশমা হিল মসজিদ কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে দাফন করা হবে এই রাজনীতিবিদকে।

এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী (ফাইল ছবি)

প্রতিবাদে, প্রতিরোধে বর্ণাঢ্য জীবন

মহিউদ্দিনের জন্ম ১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর রাউজানের গহিরা গ্রামের বক্স আলী চৌধুরী বাড়িতে। বাবা রেল কর্মকর্তা হোসেন আহমদ চৌধুরী এবং মা বেদুরা বেগম।

ছাত্র অবস্থায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া মহিউদ্দিন ১৯৬২ সালে এসএসসি, ১৯৬৫ সালে এইচএসসি এবং ১৯৬৭ সালে ডিগ্রি পাস করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ এবং পরে আইন কলেজে ভর্তি হলেও শেষ করেননি। জড়িয়ে পড়েন ছাত্র আন্দোলনে।

১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা মহিউদ্দিন একাত্তরে গঠন করেন ‘জয় বাংলা’ বাহিনী। গ্রেপ্তার হন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। পাগলের অভিনয় করে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে যান ভারতে।

উত্তর প্রদেশের তান্ডুয়া সামরিক ক্যাম্পে প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি স্কোয়াডের কমান্ডার নিযুক্ত হন মহিউদ্দিন। 

সম্মুখ সমরের যোদ্ধা মহিউদ্দিন স্বাধীনতার পর শ্রমিক রাজনীতিতে যুক্ত হন। যুবলীগের নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদ পান।

মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর হাসপাতালে কান্নায় ভেঙে পড়েন নেতাকর্মীদের অনেকে

সকালে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মরদেহ হাসপাতাল থেকে নেওয়া হয় তার বাসায়

পঁচাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর প্রতিশোধ নিতে মৌলভি সৈয়দের নেতৃত্বে মহিউদ্দিন গঠন করেন ‘মুজিব বাহিনী’।

সে সময় ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’র আসামি করা হলে তিনি পালিয়ে কলকাতায় চলে যান। এরপর ১৯৭৮ সালে দেশে ফেরেন বলে আত্মজীবনীতে উল্লেখ করে গেছেন এই রাজনীতিবিদ।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মহিউদ্দিন চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের শীর্ষ পদে ছিলেন। চট্টগ্রামে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, বন্দর রক্ষা আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনেও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন।

পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে অনেক অর্জন থাকলেও কখনও সংসদ সদস্য হতে পারেননি মহিউদ্দিন। ১৯৮৬ সালে রাউজান থেকে এবং ১৯৯১ সালে নগরীর কোতোয়ালি আসনে ভোট করে তিনি হেরে যান।

তবে ১৯৯৪ সালে প্রথমবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে প্রার্থী হয়েই মহিউদ্দিন বিজয়ী হন। ২০০০ সালে দ্বিতীয় দফায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং ২০০৫ সালে তৃতীয় দফায় মেয়র নির্বাচিত হন তিনি।

তার মেয়াদে পরিচ্ছন্নতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ‘অনন্য দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করেছিল বলে অনেকে মনে করেন। বন্দর নগরীর ষোলশহর এলাকায় তার বাসার গলিটি চট্টগ্রামবাসীর কাছে ‘মেয়র গলি’ হিসেবেই পরিচিত।

প্রায় দুই যুগ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করার পর ২০০৬ সালের ২৭ জুন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হন মহিউদ্দিন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি নগর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন।  

তার বড় ছেলে মুহিবুল হাসান নওফেলকে গতবছর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক করে নেওয়া হয়। ছোট ছেলে বোরহানুল হাসান চৌধুরী সালেহীন করেন ব্যবসা।

মহিউদ্দিনের ছয় ছেলে মেয়ের মধ্যে ফৌজিয়া সুলতানা টুম্পা ২০০৮ সালের ১৭ অক্টোবর ক্যান্সারে মারা যান। বাকি তিন মেয়ের মধ্যে জেবুন্নেসা চৌধুরী লিজা গৃহিনী। যমজ বোন নুসরাত শারমিন পিয়া ও ইসরাত শারমিন পাপিয়া মালয়েশিয়া থেকে এমবিএ করেছেন।

বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য সারাদেশে পরিচিতি পেলেও মহিউদ্দিন সব সময় নিজেকে চট্টগ্রামের রাজনীতির গণ্ডিতেই ধরে রেখেছেন।

গতবছর ডিসেম্বরে জন্মদিনে নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছার জবাবে তিনি বলেন, “টিল ডেথ, আই উইল ডু ফর দ্য পিপল অব চিটাগং, চট্টগ্রামের মানুষকে আমি ভালোবাসি।”