আমার সেই দিন আর আসেনি: তোফায়েল

পনের অগাস্ট এলেই তোফায়েল আহমেদের মনে পড়ে যায় বঙ্গবন্ধুর এই কথাটি - ‘আগামীকাল তুই আমার সঙ্গে যাবি’। পঁচাত্তরের রক্তাক্ত ওই রাতের পর সেই আগামীকাল তার জীবনে আর আসেনি, এ নিয়ে এখনও দুঃখবোধ এই রাজনীতিকের মনে।

সুলাইমান নিলয় জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 August 2016, 05:30 PM
Updated : 14 August 2016, 07:46 PM

রাজনৈতিক অনুসারীর পর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ‌্যে ছিলেন আজকের আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।

বঙ্গবন্ধু হত‌্যাকাণ্ডের ৪১তম বার্ষিকীতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাতির জনকের কথা বলতে গিয়ে নিজের সেই বেদনাবোধের কথাই সবার আগে আসে তোফায়েলের কণ্ঠে।

“পঁচাত্তরের ১৪ অগাস্ট রাত সাড়ে ১০টায় বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার শেষ দেখা। তিনি আমাকে বলেন, ‘আগামীকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে তুই আমার সাথে যাবি’। আমার জীবনের সেই দিন আর আসেনি.....।”

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট আচার্য হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ‌্যালয়ের সমাবর্তনে যোগ দেওয়ার কথা ছিল রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের।

কিন্তু সকালের আগেই একদল সেনা সদস‌্যের হামলায় বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কালো অধ‌্যায়ের সূচনা ঘটে, সপরিবারে নিহত হন স্বাধীনতার স্থপতি, যার পুরোটা জীবন গেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে।

বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে কেমন দেখেছেন- প্রশ্নে তোফায়েল বলেন, “উনার মূল লক্ষ্য ছিল শোষণমুক্ত বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশই ছিল উনার সবকিছু। উনি বলতেন, রিকশাওয়ালারা রিকশা চালায় তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবা না।

“কারখানার যে শ্রমিক কারখানা বন্ধ করে দিয়ে হাতিয়ার নিয়ে যুদ্ধ করেছে, যে কৃষক লাঙল ফেলে দিয়ে হাতিয়ার নিয়ে যুদ্ধ করেছে। সেই কৃষক ও শ্রমিক ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রাণ।”

“তিনি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে একটা অতি সাধারণ জীবন যাপন করতেন। যার বাড়িতে এয়ারকন্ডিশন ছিল না। একটা ভালো সোফা সেট ছিল না। কোনো ফার্নিচার ছিল না। দেশের সাধারণ মানুষের সাথে মিশতেন।”

নেতার উষ্ণ সান্নিধ্যে এই ছবি তোফায়েল আহমেদের ব্যক্তিগত অ্যালবামের একটি গুরুত্বপূর্ণ পাতা

“ডেভিড ফ্রস্ট যখন তাকে নিজের ‘কোয়ালিফিকেশন’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আই লাভ মাই পিপল’। ‘ডিসকোয়ালিফিকেশন’ জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘আই লাভ দেম টু মাচ’। সত্যিকার অর্থে তিনি বাংলার মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন।”

বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগের মাধ‌্যমে রাজনীতিতে পা রেখে ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী তোফায়েল বলেন তার রাজনীতির শিক্ষকের কথা।

“তিনি (বঙ্গবন্ধু) বলতেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আমি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছি, এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য নয়। একদিন না একদিন বাংলার ভাগ্য নিয়ন্তা বাঙালিদেরকে হতে হবে। সেই লক্ষ্য সামনে নিয়ে প্রথমে ছাত্রলীগ, পরে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার বীজ আমি রোপণ করেছি।”

তোফায়েলের চোখে বঙ্গবন্ধু শুধু একজন দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতাই ছিলেন না, লক্ষ্য নির্ধারণ করে ভেবে-চিন্তে পথ এগোতেন।

“৬৬ সালে ৬ দফা দিয়ে তিনি আমাদেরকে বলেছিলেন, ‘সাঁকো দিলাম। এই সাঁকো পেরিয়ে একদিন স্বাধীনতায় পৌঁছব’। সত্যিই ৬ দফা ছিল আমাদের মুক্তির সনদ। ৬ দফা কী-এটা আইয়ুব খান উপলব্ধি করেছিল বলেই তাকে আগরতলা মামলার আসামি করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলাতে চেয়েছিল।”

ছয় দফার পর বন্দি বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, শুরু হয় ১১ দফার আন্দোলন। ‘জেলের তালা ভাঙব, বঙ্গবন্ধুকে আনব’ স্লোগান বাস্তব রূপ দিয়ে বাঙালি মুক্ত করে এনেছিল শেখ মুজিবকে।   

১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তির পর বিশাল সংবর্ধনায় ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে ডাকসুর তৎকালীন ভিপি তোফায়েলই শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়ার ঘোষণা পড়েছিলেন।  

“জেল থেকে বেরিয়ে এক টুকরা মাটি কপালে স্পর্শ করে তিনি বলেছিলেন, হে মাটি, আমি জানি ওরা আমাকে ফাঁসি দিবে। মৃত্যুর পর আমি তোমার কোলে চিরনিদ্রায় শায়িত হব।”

“এমন নেতার সাহচর্য পাওয়া দুর্লভ। যদি এই মহান নেতার জন্ম না হত, তাহলে আজও আমরা দাসত্বের নিগড়ে বন্দি থাকতাম।”

শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার সেই দিনটি স্মরণ করে তোফায়েল বলেন, “সেদিন তিনি বলেছিলেন, রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে তোমরা যারা আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছ, যদি কোনোদিন পারি, তাহলে সেই রক্ত দিয়ে তোমাদের রক্তের ঋণ শোধ করে যাব।

“তিনি একাই রক্ত দেননি। সপরিবারে রক্ত দিয়ে বাঙালি জাতির রক্তের ঋণ শোধ করে গেছেন।”

ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনে শেখ হাসিনার সঙ্গে তোফায়েল আহমেদ

স্বাধীনতার চার বছরের মধ‌্যে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত‌্যায় শুধু দেশ নয়, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও ছিল বলে মনে করেন তোফায়েল আহমেদ।

“বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে তারা বাঙালি জাতিকেও দাবায়ে রাখতে চেয়েছিল। তাদের সেই চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছে। বাঙালি আজ এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি যদি বেঁচে থাকতেন, বাংলাদেশ বহু আগেই মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে যেত।”

খুনিরা আরেকটি বিষয় চেয়েছিল বলেও মনে করেন তোফায়েল।

“তারা চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর রক্তের কোনো উত্তরাধিকার যেন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব না পায়। তাই তো শিশু রাসেলকেও তারা হত্যা করেছে।”

পঁচাত্তরের অগাস্টে বিদেশে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। প্রতিকূল অবস্থায় দেশে ফিরে দলের হাল ধরে এখন তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন শেখ হাসিনা।

রাজনীতির নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীতে দায়িত্ব পালনের পর এখন উপদেষ্টা পরিষদে রয়েছেন তোফায়েল। শেখ হাসিনার সরকারে দ্বিতীয়বার মন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন তিনি।

এতসব দায়িত্ব পালন করে ৭০ বছর পেরিয়ে আসা তোফায়েল এখন বঙ্গবন্ধুর অভাব আরও ভালোভাবে অনুভব করেন।   

“জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, কমনওয়েলথ, ওআইসি, জাতিসংঘ সম্মেলনে গিয়ে তিনি এমনভাবে মনোযোগ পেয়েছিলেন, যা দেখে মনে হয়েছে তিনি বিশ্বনেতা। জাতিসংঘে বক্তব্যের পর বিশ্বের বরেণ্য নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ধরে বলেছিল, আপনি শুধু বাংলাদেশের নেতা নন, আপনি শুধু এশিয়ার নেতা নন, আপনি সারা দুনিয়ার নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের শ্রেষ্ঠ নেতা। সেই নেতাকে আমরা ১৫ অগাস্ট হারিয়েছি।”