খালেদা জিয়ার রাজনীতি নিয়ে আওয়ামী লীগের এত দরদ কেন: ফখরুল

মির্জা ফখরুল বলছেন, “তাদের উদ্দেশ্য খারাপ। তারা দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চায়।”

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Feb 2023, 09:41 AM
Updated : 27 Feb 2023, 09:41 AM

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন কি না, সেই প্রশ্নে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের হঠাৎ ‘উতলা’ হয়ে ওঠার কারণ জানতে চেয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তার ভাষায়, খালেদা জিয়াকে নিয়ে সরকার এখন ‘নাটক’ করছে। আর তাকে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের সাম্প্রতিক আলোচনার উদ্দেশ্যও ‘ভালো নয়’।

সোমবার দুপুরে এক আলোচনা সভায় বিএনপি মহাসচিব ফখরুল বলেন, “বেগম খালেদা জিয়া অত্যন্ত অসুস্থ। আজকেও তিনি যাবেন হাসপাতালে। তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য। তাকে নিয়ে (সরকার) বিভিন্নভাবে নাটক শুরু করেছেন।

“তাদের মন্ত্রীরা একবার বলে যে, খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন না। আরেকজন বলে যে, তার রাজনীতি করতে বাধা নেই। এর মাজেজা কী ভাই? হঠাৎ করে আপনাদের এত দরদ উথলে উঠল কেন যে, আপনারা বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতি করার ব্যাপারে একেবারে পাগল হয়ে গেলেন?”

মির্জা ফখরুল নিজেই এর উত্তর দিয়ে বলেন, “উদ্দেশ্য একেবারেই খারাপ, তাদের উদ্দেশ্য খারাপ। তারা দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চায়, তারা দেশের মানুষের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নিয়ে যেতে চায়।

“আমাদের দৃষ্টি একদিকেই, আমাদের অধিকার ফেরত চাই, আমাদের ভোটের অধিকার ফেরত চাই, এই সরকারকে আমরা আর দেখতে চাই না। এই সরকারকে এই মুহূর্তে পদত্যাগ করতে হবে এবং পদত্যাগ করে সংসদ বিলুপ্ত করতে হবে। ওই সমস্ত কথা বলে জনগণকে ভিন্ন পথে মন ভোলানো যাবে না।”

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয় খালেদা জিয়ার। সেদিনই কারাবন্দি হন তিনি। ওই বছরের ৩০ অক্টোবর উচ্চ আদালত সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করে। এর মধ্যে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বিএনপি নেত্রীর আরও সাত বছরের সাজা হয়।

তাকে জামিনে মুক্ত করার সব চেষ্টাই বিফলে গেলে পরিবারের পক্ষ থেকে ‘মানবিক আবেদন নিয়ে’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যান খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে ২০২০ সালের ২৪ মার্চ শর্ত সাপেক্ষে সাজা স্থগিত করে সরকার নির্বাহী আদেশে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয় খালেদা জিয়াকে। পরে সব মিলিয়ে ছয় দফা এর মেয়াদ বাড়ানো হয়।

মুক্তি পাওয়ার পর থেকে গত তিন বছরে খালেদা জিয়া কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যাননি। এমনকি বাসার পাশে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়েও তাকে দেখা যায়নি। রাজনীতি নিয়ে তার কোনো বক্তব্য বা দিক নির্দেশনা প্রকাশ্যে আসেনি। এমনকি জাতীয় দিবস বা উৎসব পার্বণেও কোনো বার্তা দেননি।

রাজনীতি থেকে বিএনপি নেত্রী কেন দূরে, এ বিষয়টি নিয়ে এতদিন দল বা সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বলা না হলেও সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের এক মন্তব্যে সেই আলোচনা সামনে আসে। 

অমর একুশে বইমেলায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের স্টল পরিদর্শনে গিয়ে ওবায়দুল কাদের বরেন, কারাদণ্ডের কারণে খালেদা জিয়া নির্বাচন করার জন্য যোগ্য নন।

“তিনি বিএনপির নেতা হিসেবে যদি রাজনীতি করতে চান, সেক্ষেত্রে যে শর্তে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, সেটি মেনে তাকে করতে হবে। নো ওয়ে।”

আওয়ামী লীগ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদও এ বিষয়ে প্রায় একই সুরে কথা বলেন। তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন ভিন্ন কথা।  

২৩ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “উনি (খালেদা জিয়া) নির্বাচন করতে পারবেন না কারণ উনি দণ্ডিত, রাজনীতি করতে পারবে না এমন কথা কোথাও নাই।”

খালেদাকে সাময়িক মুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে দুটি শর্ত দেওয়া হয়েছিল। এর একটি ছিল বাসায় চিকিৎসা নেওয়া এবং দ্বিতীয়টি তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।

এ বিষয়ে আইনমন্ত্রীর ব্যাখ্যা ছিল, “তিনি অসুস্থ, তিনি রাজনীতি করতে পারবেন কি না, সেটি আমি বারবার বলেছি আপনারা দেখেন। স্বাভাবিকভাবে মানুষ মনে করে তিনি অসুস্থ তার রাজনীতি করার অবস্থা নেই৷ এটাই বাস্তবতা।”

ক্ষমতসীন দলের নেতাদের এ ধরনের আলোচনার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে সোমবারের আলোচনা সভায় মির্জা ফখরুল বলেন, “খালেদা জিয়ার যখন রাজনীতি করার সময় আসবে, উনি রাজনীতি করবেন। সে কারাগারেই থাকুক, জেলে থাকুক আর সেখানেই থাকুক, তিনি অবশ্যই রাজনীতি করবেন। কারণ তিনি এদেশের জনগণের সবচাইতে জনপ্রিয় নেত্রী এবং গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় মাতা।

“সুতরাং আপনাদের (সরকার) এ নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন নেই। তার সিদ্ধান্ত তিনি নেবেন, দল নেবেন। আপনারা আগ বাড়িয়ে এসব…। আর এত যদি চান, তাহলে খালেদা জিয়াকে নিশঃশর্ত মুক্তি দিন। তাকে দিয়েছেন ছয় মাসের সাজা স্থগিত, ছয় মাসের সাজা স্থগিত। আর বলছেন যে তিনি সব কিছু করতে পারবেন। এই সমস্ত কথা বলে মানুষকে বোকা বানিয়ে কোনো লাভ হবে না।”

‘জনগণের অসুখের দিকে তাকান’

সরকারের উদ্দেশে ফখরুল বলেন, “আপনারা আসল জায়গায় আসুন। জনগণের যে অসুখ, সেটার দিকে তাকান। জনগণের অসুখ একটাই যে, তারা ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে না। জনগণের পার্লামেন্ট নাই। তারা কথা বলতে পারে না।

“সেজন্য আমাদের সবচেয়ে বড় যে দাবি এই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। সংসদ ভেঙে দিতে হবে এবং নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে যার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন হবে এবং সকলের অংশ গ্রহন নতুন নির্বাচন হবে, নতুন সরকার গঠন হবে।”

আওয়ামী লীগ নেতারা বলে আসছেন, আদালতের আদেশে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলোপ ঘটানো হয়েছে এবং ওই ব্যবস্থা ফেরানোর কেনো সুযোগ নেই।

এর জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “তোমরা যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলে ১৭৩ দিন হরতাল করেছিলে, তখন কি সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল? ছিল না। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যখন দেখেছেন যে, জনগণ এটা চায়, যখন দেখেছেন এটা করলে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে, তখন তিনি পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশন বসিয়ে নতুন সংসদে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করে সংবিধান সংযোগ করেছিলেন।

“তারপরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছিল, বিএনপি সেদিন বিরোধী দলে গিয়েছিল ১১৬টা আসন নিয়ে। কোথায় সেদিন বিএনপি তো এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার না মেনে অন্য কোনো কাজ করে নাই, নির্বাচন তো তার মত করতে চায় নাই।”

আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট চুরির অভিযোগ এনে মির্জা ফখরুল বলেন, “কথায় কথায় আওয়ামী লীগ বলে বিএনপি নাকি ভোট চুরি করেছে। আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই, বিএনপি কোনোদিন ভোট চুরি করে নাই। ভোট চুরি করেছেন আপনারা।

“আজকে শুধু নয়, ১৯৭৩ সালে ভোট চুরি করেছেন। পরেও ভোট চুরি করেছেন। গত দুইটা সংসদ নির্বাচনেও ভোট চুরি করে, কারচুপি করে, ভয় দেখিয়ে, মিথ্যা মামলা দিয়ে নির্বাচন করেছেন। আপনাদের লজ্জা হওয়া উচিত একটা দেশের রাজনৈতিক দলের ৪০ লক্ষ মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেন।”

‘আওয়ামী লীগই আইসিইউতে’

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আগের দিন বলেছিলেন, “বিএনপি অসুস্থ হয়ে অচিরেই হাসপাতালে যাবে। নির্বাচনে না গেলে আইসিইউতে যাবে। মির্জা ফখরুল আবার লাফাতে শুরু করেছে। জনগণ নাই, ঢাল তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার।”

তার কথার জবাব দিতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিরব বলেন, “নির্বাচন করতে চাই। বাহ কি নির্বাচন! আবার বলে যে, বিএনপি নাকি আইসিইউতে যাবে।

“বিএনপি আইসিইউতে যাবে না। আপনারা ইতোমধ্যে আইসিইউতে চলে গেছেন। দেউলিয়া হয়ে গেছেন রাজনৈতিকভাবে। তা না হলে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে এত ভয় কেন? ভয় একটাই যে, আপনারা জানেন যে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আপনাদের জামানত থাকবে না, ২০ আসনও পাবেন না।”

সংসদে বিরোধী দলে থাকা জাতীয় পার্টি এবং সরকারের সঙ্গে থাকা বাম দলগুলোরও সমালোচনা করেন মির্জা ফখরুল।

২০১৪ সালে বিএনপি ও সমমনাদের ভোট বর্জনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “তখন বিনাভোটে ১৫৪ জনকে নির্বাচিত করা হয়েছিল, যারা সংসদের মেম্বার হয়ে গেলেন। আর আমাদের বেশ কিছু লোকজন, বিশেষ করে জাতীয় পার্টি ডুগডুগি বাজিয়ে ওদের সঙ্গে যোগ দিল।

“আরো আছে। শুধু জাতীয় পার্টি না। আমাদের অনেক বাম নেতা, একসময়ে প্রখ্যাত নেতা, যারা এখনো অনেক বড় বড় কথা বলেন, তারা সেদিন নৌকার সঙ্গে মহাজোট করে তারা সেই নির্বাচনে গিয়েছিলেন। তাই না। ভাগ নিয়েছেন।”

ফখরুল বলেন, “এখন আবার একটু অসুবিধা হচ্ছে। মন্ত্রিত্ব দেয় নাই যে কারণে ভাগ-বাটোয়ারা ঠিক মত হচ্ছে না। এখন বলে ১৪ দল আর কাজ করে না, আমাদের সাথে কথা রাখা হয় নাই।

“এরা আওয়ামী লীগের চেয়ে খারাপ। আজকে এদেশে কিছু সংখ্যক লোক তৈরি হয়েছে, তাদের কাজ হচ্ছে তাবেদারি করা, তোষামোদি করা এবং জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করা।”

একসময়ে বাম রাজনীতি করা মির্জা ফখরুল আওয়ামী লীগের শরিক বাম নেতাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমি খুব স্পষ্টভাবে জানতে চাই যে, আজকে গণতন্ত্র আছে কিনা- এই কথা তারা বলেন না কেন? তারা কেন এই কথা বলেন না আজকে জনগণ ভোট দিতে পারে না, ভোট দিতে গেলে ভোট তারা দিতে পারেন না। কেন বলেন না যে আজকে এই সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার, তারা দুর্নীতি করে মানুষের সমস্ত অধিকারগুলো কেড়ে নিচ্ছে- এ কথাগুলো তারা মুখ দিয়ে কেন বলেন না।

“এক সময় তারা বড় বড় বিপ্লবী কথা বলতেন। বিপ্লবী কথা বলেন। এখনো সুযোগ পেলেই আমাদেরকে তারা বিভিন্নভাবে দোষারোপ করতে থাকেন। কিন্তু তারা তাদের যে দায়িত্ব, সেই দায়িত্ব পালন করেন না।”

জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে জাতীয়তাবাদী তাঁতী দলের ৪৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এই আলোচনা সভা হয়। অনুষ্ঠানে তাঁতী দলকে সংগঠিত হয়ে আন্দোলনের জন্য সর্বাত্মক প্রস্ততি নেওয়ার আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব।

তিনি বলেন, “অনেক সময় চলে গেছে। আমরা অনেক মার খেয়েছি। আজকে মার খেতে খেতে আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি। দেশের মানুষ উঠে দাঁড়িয়েছে।

“এখন আপনাদের রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসেবে আপনাদের দায়িত্ব হচ্ছে এই মানুষগুলো সাথে নিয়ে আপনাদেরকে রাজপথে নেমে আসা, রাজপথে নেমে তাদেরকে পরাজিত করা।”

ফখরুল বলেন, “আসুন আন্দোলনকে আরো তীব্র করে তুলি, বেগবান করে তুলি এবং জনগণের শক্তি দিয়ে উত্তাল তরঙ্গ সৃষ্টি করে এদেরকে আমরা পরাজিত করি। আপনারা মনোবল দৃঢ় রাখুন, আন্দোলনে আরো সক্রিয় হোন।”

তাঁতী দলের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব হাজী মজিবুর রহমানের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, প্রশিক্ষন বিষয়ক সম্পাদক এবিএম মোশাররফ হোসেন, সাবেক সাংসদ জিএম সিরাজ, উলামা দলের আহ্বায়ক শাহ নেছারুল হক, নজরুল ইসলাম তালুকদার মতস্যজীবী দলের আবদুর রহিম, ডেমোক্রেটিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন মনিসহ তাঁতী দলের নেতারা বক্তব্য দেন।