শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় বিদায় সাজেদা চৌধুরীর

সন্ধ্যায় বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয় বর্ষীয়ান এই রাজনীতিককে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Sept 2022, 01:53 PM
Updated : 12 Sept 2022, 01:53 PM

সংকটে-সংগ্রামে নিবেদিত রাজনীতিক, সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ফুলেল শ্রদ্ধায় সিক্ত হলেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।

সোমবার দুপুর আড়াইটায় সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হয়। সম্মিলিত সাংস্কৃতি জোটের আয়োজনে সেখানে বিভিন্ন সংগঠনসহ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

প্রথমে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পক্ষ থেকে সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাহউদ্দিন ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সামরিক সচিব মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মতিয়া চৌধুরী, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, হাছান মাহমুদ, দীপু মনি, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়াসহ কেন্দ্রীয় নেতারা শ্রদ্ধা জানান।

শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ওবায়দুল কাদের বলেন, “দলের সংকটে তিনি সাহসী নেতা ছিলেন। তিনি ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের সৈনিক এবং আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত বিশ্বস্ত সহকর্মী।

“বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক বড় অধ্যায় জুড়ে রয়েছেন তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি রণাঙ্গনেও ছিলেন সৈনিক। স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর দেশ পুনর্গঠনে ভূমিকা রেখেছেন।

“তারপর আবার সংকট, রক্তাক্ত পঁচাত্তরের পর প্রত্যেকটি সংকটে তিনি ছিলেন। অনেকে জানে না, তিনি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অনেক দিন বন্দি ছিলেন। তার শূন্যতা সহজে পূরণ হবার নয়।”

১৪ দলের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু।

পরে রাজনৈতিক সহকর্মীর অবদান তুলে ধরতে গিয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের এ সদস্য বলেন, “তিনি একজন অকুতোভয় নির্ভীক সৈনিক ছিলেন।

“১৯৬৪ সাল থেকে তিনি সক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। ছয় দফা আন্দোলনে তিনি সাহসী ভূমিকা রেখেছেন।”

আমু বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে তিনি মহিলাদের সংগঠিত করা, তাদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং অনুপ্রাণিত করে মুক্তিযুদ্ধে পাঠানোসহ সকল কাজ তিনি সেসময় মুজিবনগর সরকারের সাথে সহায়তা করেছেন।

“সংকটকালে তিনি সরে যাননি। আপস নিয়ে রাজনীতি করেননি। নতুন প্রজন্মকে ওনার নেতৃত্ব অনুসরণ করা উচিত। তার এই প্রস্থান দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।”

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে ওয়ার্কার্স পার্টি, শফিউদ্দিন মোল্লার নেতৃত্বে জাসদ, রেজাউর রশিদের নেতৃত্বে বাসদ, এস কে শিকদারের নেতৃত্বে গণ-আজাদী লীগের নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

পরে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগ, যুব মহিলা লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদসহ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

এছাড়া শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, পানি সম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম, রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে দেশের সবচেয়ে বড় নারী সংগঠক বর্ণনা করে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, “এটা আমরা অনেকে ভুলে গেছি। তার অবদান আমাদের মনে রাখতে হবে।

“মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা যখন হাসপাতাল করি, যখন লোক পাচ্ছিলাম না, তখন তিনি মেয়েদের পাঠিয়েছিলেন। আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধে নারী নেতৃদের মধ্যে উনি ছিলেন এক নম্বরে।”

তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, “দলের দুঃসময়ে সাজেদা চৌধুরীর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। পঁচাত্তরের পর দলকে সংগঠিত করার জন্য তিনি কাজ করেছেন। ’৮১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন দলের সভাপতি হয়েছেন, তখন সাজেদা চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর সাথে ছায়ার মতো ছিলেন।

“২০০৭-০৮ সালে যখন অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, তখন নেত্রীর পাশে ছিলেন সাজেদা চৌধুরী। আওয়ামী লীগের ইতিহাস তো বটেই, বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে হলেও সাজেদা চৌধুরী থাকবে।

“তার এই বিদায় আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনার। দেশ একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাকে হারিয়েছে।“

মুক্তিযুদ্ধে নারীদের সংগঠিত করতে জাতীয় সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভূমিকা তুলে ধরতে গিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, “বিশেষ করে গোবরা ক্যাম্পের দায়িত্ব নিয়ে তিনি নারীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।

“সাজেদা চৌধুরী ছিলেন এই দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সামনের কাতারের নেত্রী; যিনি আজীবন আদর্শ অনুসরণ করে নিষ্ঠার সঙ্গে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন।”

পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যখন বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ ছিল, সেই সময় বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে এগিয়ে নিতে সাজেদা চৌধুরীর অবদান স্মরণ করে মেনন বলেন, “সেটা শুধু তৎকালীন আওয়ামী লীগ নয়, সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিল।”

বর্তমান তরুণ প্রজন্ম সাজেদা চৌধুরীর পথকে অনুসরণ ও অনুকরণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে এমন প্রত্যাশা করেন তিনি।

সেনা সমর্থিত ওয়ান ইলেভেনের সময়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য প্রয়াত সাজেদা চৌধুরী সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন উল্লেখ করে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “সেই সময়ে তিনি গৃহবন্দি থাকা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছিলেন।

“একজন মানুষের কতটুকু দেশপ্রেমিক ও দলের প্রতি আনুগত্য এবং ভালোবাসা থাকতে পারে; সেটা আমরা দেখেছি এক/এগারোর সময়ে।”

খালিদ মাহমুদ বলেন, “সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন ব্যক্তি। তার পুরো জীবনটাই বর্নাঢ্য একটা ইতিহাস। এই ইতিহাস আমাদের ধারণ করতে হবে। তিনি নির্লোভ জীবন কাটিয়ে গিয়েছেন।

“…এরকম একটা সাহসী চরিত্র বাংলাদেশে বিরল। আমরা তার জীবনের দিকে তাকালে দেখব- সবসময় তিনি সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। বর্তমান প্রজন্ম এবং আমাদের এখান থেকে অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। তাকে অনুসরণ করতে পারলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।”

সাজেদা চৌধুরীর ছেলে সাহাব আকবর চৌধুরী লাবু বলেন, “বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে সারা জীবনে একদিনের জন্যও বিচ্যুত হননি। তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করার জন্য সবার কাছে দোয়া চাচ্ছি।

“সেই পঁচাত্তরের পনেরই অগাস্ট হত্যার পর এই মানুষ রাজপথে নেমেছিলেন, তখন বড় বড় আওয়ামী লীগের নেতারা কিন্তু খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। আর তিনি একজন মহিলা হয়েও যখন ছিয়াত্তরে রাজনীতি করার অনুমতি দেওয়া হয়, তখন তিনি আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন।”

দলের প্রতি মায়ের আনুগত্য ও অবদানের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তারপর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিটা আন্দোলন সংগ্রামে আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করেছেন আমার মা। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে আনার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন এবং তার সঙ্গে আমার বাবাও একজন মুক্তিযোদ্ধা, যিনি মাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন। আমার মা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রতি লয়ালিটি রেখে গেছেন।”

সাজেদা চৌধুরীর আদর্শ ধারণ করার আহ্বান জানিয়ে ছেলে লাবু বলেন, “বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তিনি একটাই আদর্শ রেখে গেছেন। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে সকল আন্দোলনে সততার সঙ্গে আন্দোলন করেছেন আমার মা।

“আমি আমার মাকে হারিয়েছি, মা তো আমার পৃথিবী, আমার শক্তি। আমার মা বীর মুক্তিযোদ্ধা, এই আওয়ামী লীগের জন্য বাংলাদেশের মানুষের জন্য আমার মা যেভাবে কাজ করে গেছেন, তা আমি সন্তান হিসেবে আমি গর্বিত। এই ধরনের মানুষের আদর্শকে অনুসরণ করলে আগামীতে আমরা আরও ভালো নেতৃত্ব পাব।”

ফরিদপুর-২ আসনের নির্বাচনে সাজেদা চৌধুরীর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রয়াত বিএনপি মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমানের মেয়ে শামা ওবায়েদও এসেছিলেন শ্রদ্ধা জানাতে।

বিএনপির এই সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, “সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকে এই পর্যন্ত অত্যন্ত পরিচিত একটি মানুষ, একটি উজ্জল নক্ষত্র। উনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবিস্মরণীয়।

“আমার বাবার সঙ্গে উনি রাজনীতি করেছেন, আমার বাবার সঙ্গে উনি প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, কিন্তু দেখা হয়েছে, রাজনীতি-দলের ওপরেও উনাদের সম্পর্ক ছিল।

“আমিও ২০১৮ সালে ওনার সঙ্গে নির্বাচন করেছি, যখনই দেখা হয়েছে উনি আমাদের অত্যন্ত স্নেহ করে গ্রহণ করেছেন। আমি দোয়া করি ওনাকে বেহস্ত নসিব করুক। দেশের রাজনীতির জন্য একটি শূন্য স্থান রয়ে গেল।”

বনানীতে চিরঘুমে

পরে সন্ধ্যায় রাজধানীর বনানী কবরস্থানে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে সমাহিত করা হয়েছে।

শহীদ মিনার থেকে সোমবার বিকাল ৫টার দিকে তার মরদেহ নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। সেখানে আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপতিম সংগঠন যুবলীগ, কৃষকলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকা ও জাতীয় পতাকায় মোড়ানো কফিনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলীয় নেতারা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

পরে বাদ আসর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয় এ বীর মুক্তিযোদ্ধাকে।

আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সন্ধা ৬টা ২০ মিনিটে বনানী কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয়।”

দাফনের সময় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান, উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন বলে জানান বিপ্লব বড়ুয়া।

এর আগে সোমবার সকালে ফরিদপুরের নগরকান্দার এমএন একাডেমি স্কুল প্রাঙ্গণে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই সংগঠকের প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর পর প্রথম জানাজা হয়। জানাজা শেষে সংসদ উপনেতার কফিন নেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।

আরও খবর

Also Read: ‘সাহসী, নিবেদিতপ্রাণ’ সাজেদা চৌধুরীকে স্মরণ সহযোদ্ধাদের

Also Read: সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুতে শোকের ছায়া ফরিদপুরে

Also Read: সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক

Also Read: সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী আর নেই