স্বজনদের মধ্যে তিন জন সন্তান, একজন বাবা, ছয় জন ভাই। এছাড়া আছেন চাচাত ভাই, মামা শ্বশুর, শ্যালক, ভগ্নিপতি, ভাতিজা।
Published : 19 May 2024, 05:29 PM
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে ১৩ জন সংসদ সদস্যদের আত্মীয়-স্বজন অংশ নিয়েছিলেন। এবার দ্বিতীয় ধাপে সেটি বেড়ে ১৭ জনে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, টিআইবি।
এদের মধ্যে লালমনিরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের ছোট ভাই মাহবুবুজ্জামান আহমেদ এবং ছেলে রাকিবুজ্জামান একই উপজেলায় (কালিগঞ্জ) প্রার্থী।
রোববার রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবির কার্যালয়ে ৬ষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে এই তথ্য জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সমন্বয়ক ইকরামুল হক ইভান।
আগামী মঙ্গলবার ১৬০টি উপজেলায় ভোট হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে ১৫৭টি উপজেলার ১ হাজার ৮১১ জন প্রার্থীর তিনটি নির্বাচনের ৫ হাজার ৪১২টি হলফনামায় দেওয়া ৮ ধরনের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে টিআইবি।
সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীর স্বজনরা যাতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেয়, সেজন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তরফে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তবে আওয়ামী লীগ এবার কাউকে প্রার্থী করেনি, সমর্থনও করেনি। দলীয়ভাবে কাউকে বসিয়ে দেওয়ার উদ্যোগও নেই। তবে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পরে বলেছেন, স্বজন বলতে স্বামী-স্ত্রী বা সন্তানকে বুঝিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনে কাউকে দলীয় প্রতীক না দেওয়া এবং প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দিয়েছিল ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ার চেষ্টায়। তবে বিএনপি ও সমমনারা জাতীয় নির্বাচনের মত এই নির্বাচনেও আসেনি। দলটির যেসব প্রার্থী ভোটে এসেছেন তারাও কাগজে কলম স্বতন্ত্র প্রার্থী, তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এই নির্বাচনে প্রথম দফায় ভোট পড়েছে ৩৬ শতাংশের কিছু বেশি, তবে সেদিন ভোটারদের বাধা দান বা জাল ভোটের মতো অভিযোগ ছিল কম।
বিএনপি যেসব নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটে এসেছে, তারাও তেমন কোনো অভিযোগ করেননি। তবে একটি উপজেলায় এক আওয়ামী লীগ নেতা কারচুপির অভিযোগ এনে ভোট থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন, যদিও তার অভিযোগ সুনির্দিষ্ট ছিল না।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “একদলের একচ্ছত্র যে রাজনীতি, সেটি স্থানীয় পর্যায়ে গভীরতর রূপ লাভ করেছে। অধিকাংশ প্রার্থীই ক্ষমতাসীন দলের।
“যারা আগেও জনপ্রতিনিধি ছিলেন, তারা যারা ছিলেন না তাদের তুলনায় বেশি অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন। সার্বিকভাবে বলা যায়, এটি ক্ষমতাকেন্দ্রিক নির্বাচন, এখানে দলীয় স্বার্থও নাই, জনস্বার্থও নাই।”
যেসব মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের আত্মীয় উপজেলায় দ্বিতীয় দফার ভোটে
মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যের স্বজনরা মূলত চেয়ারম্যান পদেই ভোটে দাঁড়িয়েছেন।
তিন জন সংসদ সদস্যের সন্তান ও একজনের বাবাও আছেন নির্বাচনি দৌড়ে।
পাবনার সংসদ সদস্য মকবুল হোসেনের ছেলে গোলাম হাসনায়েন প্রার্থী হয়েছেন ভাঙ্গুড়া উপজেলায়।নোয়াখালীর সংসদ সদস্য মোর্শেদ আলমের ছেলে সাইফুল ইসলাম দীপু দাঁড়িয়েছেন সেনবাগ উপজেলায়, লালমনিরহাটের কালিগঞ্জের রাকিবুজ্জামান ওই এলাকার সংসদ সদস্য নুরুজ্জামান আহমেদের ছেলে।একই উপজেলার আরেক প্রার্থী মাহবুবুজ্জামান আহমেদ সম্পর্কে নুরুজ্জামান আহমেদের ছেলে।
বগুড়ার সংসদ সদস্য সাইফুল্লাহ মেহেদীর বাবা সিরাজুল ইসলাম খান রাজু দাঁড়িয়েছেন আদমদিঘী উপজেলায়।
নরসিংদীর মনোহরদীর নজরুল মজিদ মাহমুদ শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনের ছোট ভাই, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার গোলাম সারওয়ার সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ছোট ভাই, জামালপুরের বকশীগঞ্জে প্রার্থী নজরুল ইসলাম সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদের ভাই, কুষ্টিয়ার সংসদ সদস্য রেজাউল হক চৌধুরীর ভাই বুলবুল আহমেদ টোকন দাঁড়িয়েছেন দৌলতপুর উপজেলায়।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলীর বড় জামিল হাসান দুর্জয় প্রার্থী হয়েছেন শ্রীপুর উপজেলায়। নির্বাচনি আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে তার প্রার্থিতা বাতিল করে দিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
এর বাইরে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার প্রার্থী এহসানুল হাকিম সাধন রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিমের চাচাত ভাই। শরীয়তপুরের সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন অপুর চাচাত বিল্লাল হোসেন দিপু মিয়া সদর উপজেলার প্রার্থী।
নড়াইলের সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজার চাচা শ্বশুর ফয়জুল হক রোম লোহাগড়া উপজেলায়, চুয়াডাঙ্গার সংসদ সদস্য সোলায়মান হজ জোয়ার্দারের ভাতিজা নঈম হাসান জোয়ার্দার সদর উপজেলায়, ভোলার সংসদ সদস্য আলী আজম মুকুলের ভগ্নিপতি মো. জাফির উল্যাহ বোরহানউদ্দিন উপজেলায়, সিলেটের সংসদ সদস্য মো. আবু জাহিরের শ্যালক বাহুবল উপজেলায়, লক্ষ্মীপুরের সংসদ সদস্য নুর উদ্দিন চৌধুরীর ভগ্নিপতি মামুনুর রশিদ রায়পুর উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন।
দ্বিতীয় দফার উপজেলা ভোটে প্রার্থীদের নিয়ে বিশ্লেষণ
নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ সার্বিক একটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে টিআইবি। পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী-
>> উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২১ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
>> প্রথম ধাপের মতো দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনেও অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের অধিকাংশই ‘আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী’ এবং দলের স্থানীয় নেতৃত্বের সমর্থনপুষ্ট।
>> দলের নির্দেশনা উপেক্ষা করে দ্বিতীয় ধাপেও লড়ছেন বিএনপির স্থানীয় প্রার্থীরা। যদিও দলের নির্দেশ না মেনে বহিষ্কৃত হয়েছেন ৬৪ জন।
>> উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে রাজনৈতিক লড়াই হওয়ার কথা থাকলেও সেখানে দলগত অবস্থান প্রায় শূন্য।
>> স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ জাতীয় নির্বাচনের তুলনায়ও কম। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে নারী প্রার্থী আছেন ২৪ জন।
>> জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ব্যবসায়ী প্রার্থীদের দাপট বাড়ছে। ব্যবসায়ী প্রার্থীদের সংখ্যা চতুর্থ নির্বাচনের তুলনায় ৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ শতাংশ।
চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৭০.৫১ শতাংশই ব্যবসায়ী, ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের প্রায় ৬৮.৭৩ শতাংশ, নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ২৯.২৬ শতাংশ ব্যবসাকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন।
নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৫১.৬৩ শতাংশই গৃহস্থালির কাজকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন।
>> গৃহিণী/গৃহস্থালিকে পেশা হিসেবে দেখানো প্রার্থীদের সাড়ে ১৪.৫৫ শতাংশের আয় আসে ব্যবসা থেকে, কৃষি থেকে আয় আসে ১৬.২৫ শতাংশের, আয় নেই ১০.৯২ শতাংশের, ৪৭ শতাংশ নিজেদের আয়ের কোনো স্বীকৃত উৎস দেখাননি।
>> সার্বিকভাবে প্রার্থীদের ৪২ শতাংশই আয় দেখিয়েছেন সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে, অর্থাৎ করযোগ্য আয় নেই তাদের। সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় দেখিয়েছেন ১০ শতাংশ প্রার্থী।
>> চেয়ারম্যান ও অন্যান্য প্রার্থীদের মাঝে উল্লেখযোগ্য আয় বৈষম্য লক্ষ্য করা গেছে। চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ২১ শতাংশ প্রার্থীদের আয় সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে, যেখানে অন্যান্য প্রার্থীদের ক্ষেত্রে তা ৫৩ শতাংশ। একইভাবে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ২৩.৬২ শতাংশর আয় সাড়ে ১৬ লাখ টাকার উপরে। অন্যান্য প্রার্থীর ক্ষেত্রে তা মাত্র ৩.২৫ শতাংশ। অর্থাৎ চেয়ারম্যান পদে অপেক্ষাকৃত ধনীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
>> প্রায় ৯৪ শতাংশ প্রার্থীর সম্পদ কোটি টাকার নিচে, বাকি প্রার্থীর সম্পদ কোটি টাকা বা তার বেশি। প্রায় ৩ গুণ হয়েছে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা।
>> প্রায় ২৫ শতাংশ প্রার্থীর ঋণ রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩১০ কোটি লাখ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে নেত্রকোণা জেলার পূর্বধলা উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থীর।
>> প্রার্থীদের ১৩.১৩% বর্তমানে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত।
>> ৫ বছরে একজন চেয়ারম্যানের আয় বেড়েছে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৯০০ শতাংশ, ১০ বছরে এই বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৩৩৬ শতাংশ; অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৬৬৬ শতাংশ, স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের সম্পদ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৪০০ শতাংশ।
>> আইনি সীমা বা ১০০ বিঘা বা ৩৩ একর এর বেশি জমি আছে ৪ জন প্রার্থীর।
>> ৫ বছরে অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধিতে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা পেছনে ফেলেছেন সংসদ সদস্যদের। একজন সংসদ সদস্যদের সম্পদ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৬৫ শতাংশ, যেখানে একজন চেয়ারম্যানের সম্পদ বেড়েছে ১১ হাজার শতাংশের বেশি।
>> উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীদের সঙ্গে নির্বাচিত হননি, এমন প্রার্থীদের গত ৫ বছরের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, অনির্বাচিতদের তুলনায় দ্বিগুণ বেড়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকার সঙ্গে দ্রুত আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এক্ষেত্রে শুধু তাদের নিজেদেরই নয়, স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের আয় ও সম্পদ বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। আবার যেসব জনপ্রতিনিধি দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় আছেন, তাদের আয় ও সম্পদ বেশি বৃদ্ধির প্রবণতাও স্পষ্ট।