মধুসূদন: দ্বিশতবর্ষে পাঠ-পুনর্পাঠ

স্মৃতিকাতরতাধর্মী কবিতাগুলোই তো একমাত্র মাইকেল নয়, প্রধানতমও নয়। উপরন্তু, পাঠ্যপুস্তকের বুনিয়াদি শিক্ষা মাইকেলকে এই ফ্রেমে বন্দি করে ফেলেছে। ফলে, তাঁর প্রধানতম-প্রবলতম কীর্তি ও কৃতি জনপরিসরে জাগরণ সৃষ্টি করার সুযোগই পায় না।

সৌমিত জয়দ্বীপসৌমিত জয়দ্বীপ
Published : 27 Jan 2024, 01:25 PM
Updated : 27 Jan 2024, 01:25 PM

ইতিহাসের সত্যের খাতিরে এ কথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, আমাদের সমস্ত প্রাচীনপন্থি সমাজবোধ— সে হোক সাহিত্য কিংবা সংস্কৃতিচিন্তা কিংবা পুরাণপাঠ কিংবা রাজনীতি— এই জগদ্দল পাথরের পিঠে প্রবল পরাক্রমে প্রথম শাণিত ছুঁড়ি চালানো দিকদ্রষ্টা মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪—১৮৭৩)। মাইকেল ভাষা ও শব্দের ঝংকারে দুমড়েমুচড়ে দিয়েছেন প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি ও মগজের ব্যারিকেড। মাইকেল যেন আগুনের ছাই ভস্ম থেকে জেগে ওঠা গ্রিক পুরাণের সেই ফিনিক্স পাখি, যিনি খোদ নিজেই বহুবর্ষজীবী পুুরাণ-কথার মিথিকাল ইডিওলজিকে বিপ্রতীপ ভাষ্য বা কাউন্টার ইন্টারপ্রেটেশনে ইহলৌকিক পুনর্জন্ম দিয়েছেন! এ বাবদ, মাইকেল সমস্ত সনাতন ভাবনার খোলনলচে পাল্টে দেওয়া আমাদের প্রথম প্রথাবিরোধী সাহিত্য-দ্রোহী। প্রথম সনাতনবিরুদ্ধ চিন্তক ও চিন্তা-সংস্কারক৷ 

রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সনাতনপ্রথার সংস্কার আন্দোলন করেছিলেন সমাজনেতা হিসেবে। মাইকেল সে পথে যাননি। যে অমিতপ্রতিভা তাঁর ছিল, তা দিয়ে তিনি সনাতনপ্রথা ও চিন্তাজগৎকে ভাঙতে হাতিয়ার বানিয়েছিলেন সাহিত্যকে। তাঁর চিন্তার ধার, ভাবনার বহুবর্ণিল আভিজাত্য, প্রায়োগিকতার মায়েস্ত্রাে-রূপ মাস্তানি, ঔদার্যের অলোকসামান্য সততা তাঁকে সুবিশেষ সাহিত্যস্রষ্টা শুধু নয়, আদতে সাহিত্যদ্রষ্টা করে তুলেছে।

২.

ছিলেন স্বভাবজাত কবি। মহাকবি। আর ছিলেন সহজাত বিদ্রোহী। কবি ও বিদ্রোহীর সম্মিলিত উন্নাসিকতা তাঁর জীবনকে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে থামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু, এটাই একমাত্র সত্য নয়। মধুসূদন মহাকাব্যস্রষ্টা হিসেবে যেমন মহাকবি, 'গ্রেট পোয়েট' অর্থেও মহাকবি। আর বিদ্রোহী তিনি তো বটেই, সাহিত্যদর্শনেও, জীবনদর্শনেও।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কালে মহাকবি হওয়ার সমস্ত গুণাবলি নিয়ে জন্মেছিলেন। কিন্তু, মধুসূদন দত্তের যা ছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তা ছিল না— সহজাত বিদ্রোহীপনা। দুই জন দুই কালের মানুষ। বয়সে মধসূদন রবীন্দ্রনাথের পিতৃসম প্রায়। মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ একই সময়ে বেঁচে ছিলেন মাত্র ১২ বছর। লক্ষ্যণীয় হলো: রবীন্দ্রনাথের জন্মের কয়েক বছর আগে-পরে ছিল মধুসূদনের সাহিত্যকৃতির উর্বরতম সময়। সেসব নিয়ে সাহিত্যে বিস্তর আলোচনা হয়েছে, গবেষণাও হয়েছে। কিন্তু, মুশকিল হলো, মধুসূদনের মতো এতো বড় প্রতিভাকে কোনো প্রকার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই প্রায় দু’শ বছর টিকে থাকতে হচ্ছে। রবীন্দ্র-নজরুল অযৌক্তিক ও অপ্রাসঙ্গিক বাইনারির তাপে-চাপে-উত্তাপে পড়ে মধুসূদন জনপরিসরে প্রায় এক অনুচ্চারিত নাম ও মিথে পরিণত হয়েছেন। অথচ, তাঁর মহাপ্রয়াণেরও সার্ধশতবর্ষ হয়ে গেছে!

মাইকেলকে একটা জাতীয়তাবাদী রোমান্টিক আমুদে আবহে পাঠ করার প্রপঞ্চ সমালোচনা-সাহিত্যে হাজির আছে। এর পেছনে প্রধান নিয়ামক (সম্ভবত) তাঁর 'কপোতাক্ষ নদ', 'বঙ্গভাষা' বা 'সমাধিলিপি' (এপিটাফ) জাতীয় স্মৃতিকাতরতামূলক কবিতাগুলো। কিন্তু, এ ধরনের বয়ানের সমস্যা হলো, মাইকেল যে জাত্যাভিমান ও স্বাজাত্যবোধের রোমান্টিকতাকে পরাভূত করে এন্টি-ন্যাশনালিস্ট চর্চা করে গেছেন, তা বিলকুল চাপা পড়ে থাকার সুযোগ পায়। এই স্মৃতিকাতরতাধর্মী কবিতাগুলোই তো একমাত্র মাইকেল নয়, প্রধানতমও নয়। উপরন্তু, পাঠ্যপুস্তকের বুনিয়াদি শিক্ষা মাইকেলকে এই ফ্রেমে বন্দি করে ফেলেছে। ফলে, তাঁর প্রধানতম-প্রবলতম কীর্তি ও কৃতি জনপরিসরে জাগরণ সৃষ্টি করার সুযোগই পায় না। এর 'দায়'ও মধুসূদনেরই। মধুসূদনের সাহিত্যের সীমাবদ্ধতা হলো, তাঁর প্রধানতম কীর্তিগুলোর শিল্পগুণ ও ভাষাগুণ এতোটাই উচ্চমানসম্পন্ন ও উচ্চমার্গীয় যে, সাধারণ পাঠকের সে উদ্ধারবিদ্যা নেই। আর, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তাঁর আদি-আধুনিক ফরমকে বোঝার জটিলতা। রবীন্দ্র-নজরুল জনপরিসরে, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ঘরে শোভিত এ উদ্ধারবিদ্যার প্রয়োগ ও তুলনামূলক কম-জটিল ফরমের কারণেই; আর সঙ্গে রয়েছে তাঁদের কাব্যের গীতিময়তা ও সঙ্গীতস্রষ্টা হিসেবে তাঁদের জনমর্মমূলে চিরন্তন নিবাস। এমনকি জীবনানন্দ দাশের মতো বিশুদ্ধ কবি, যাঁকে পর্যন্ত রবীন্দ্র-নজরুল বাইনারিতে পড়ে ব্রাত্য থাকতে হচ্ছে আজও, তিনিও যতটা কাব্যপ্রসাদগুণে জনপরিসরে আদৃত, ছন্দবোধের সহজাত 'অমিত্রাক্ষর মহাত্মা' মধুসূদন ততটাই দূরে ঢেলে দেয়া 'সৎসন্তান'। ফলে, তাঁর অপেক্ষাকৃত প্রধান কীর্তিগুলোও চিন্তার উন্মেষে জনপরিসরকে আন্দোলিত করতে পারছে না। 

প্রশ্নটা হলো, কী তাঁর প্রধানতম কৃতিত্ব? আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রাণপ্রতিষ্ঠা? হ্যাঁ, তা তো বটেই। তবে, সে সাহিত্যের মূল দ্যােতনা যুক্ত আছে ভাষা প্রশ্নে। বাংলা ভাষাকে অন্তত একশ বছর এগিয়ে দিয়েছেন মধুকবি তাঁর অসামান্য শব্দবোধের শক্তিতে, ভাষাবোধের ব্যাপ্তিতে; ঠিক যেমনটা প্রযোজ্য রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও। তবে, কাব্যে রবীন্দ্রনাথের কাজটা সহজ করে দিয়েছেন মধুসূদনই; গদ্যের ক্ষেত্রে, বিশেষত, ছোটগল্পের ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জটা খোদ রবীন্দ্রনাথকেই নিতে হয়েছে নিজ হাতে— সে স্বীকারোক্তি তিনি 'গল্পগুচ্ছ'-তে করছেনও। ফলে, পূর্বপ্রজন্মে মধুসূদনের আবির্ভাব না হলে রবীন্দ্রনাথের অসামান্য কাব্যপ্রতিভার কতটা প্রস্ফুটিত হতো, সেটাও এক প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার। ভাষার প্রতি কবিতার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান হলো, কবিতা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখে। এ বাবদ, জনপ্রীতি না থাকলেও, বলতেই হবে যে, মাইকেল মধুসূদন দত্তর কীর্তি ও অবদান আরও গভীরতর ও গুরুতর।

৩.

এহেন মধুসূদনের সমালোচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তরুণ তিনি তখন। তখনও পিতামহ বা পিতা বা অগ্রজদের পরিচয়েই তাঁর পরিচিতি। সেই বয়সে প্রথাগত ধ্যানধারণার বশবর্তী হয়ে মাইকেলের বিখ্যাততম সাহিত্যকীর্তি 'মেঘনাদবধ কাব্য' নিয়ে এক পপুলিস্ট রোমান্টিক সমালোচনা করেছিলেন তিনি— যেটা পরে সমালোচনার গুণে নয়, বরং মাইকেলের ডিকনস্ট্রাকশন বা বিনির্মাণকে রবীন্দ্রনাথ না মেনে নিতে পারার যে প্রথাগত ভুল করেছেন, সে কারণে জনপ্রিয় হয়ে গেছে। আদতে, রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারেননি, যে ছাঁচে তিনি মাইকেলকে দেখতে চাইছিলেন, সেই ছাঁচটা মাইকেল তাঁর স্বীয় কৃতিত্ব ও প্রতিভার ঝংকারে কপোতাক্ষ নদের তীরে ছুড়ে ফেলে কলকাতা-মাদ্রাজ-লন্ডন-ভার্সাই গেছেন। রবীন্দ্রনাথের এই 'প্রতিবিপ্লবী' হয়ে ওঠার কারণটি সম্ভবত এই যে, রবীন্দ্রনাথ বিহারীলাল-স্কুলের ছাত্র, যেখানে কাব্যিক রোমান্টিকতা এক মোহময় মাধুর্যের বয়ানমাত্র, খোলনলচে বদলানোর উপাদান নয়। এ বাবদ, রবীন্দ্রনাথকে ঠিক কতটা প্রতিবিপ্লবী বলা যায়, প্রশ্নসাপেক্ষ। অবশ্য এ কথাও বলে রাখা ভালো যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমগ্র জীবনে বড়জোর প্রতিবাদী হতে চেয়েছেন, বিপ্লবী তো অবশ্যই না, প্রতিবিপ্লবীও না। 

রবীন্দ্রনাথ বরং দুই প্রজন্মের সেতুবন্ধ হয়েছেন— পূর্বপ্রজন্মে মধুসূদন, উত্তরপ্রজন্মে নজরুল— কিন্তু, তাঁর ঘরানাটা এ দুইজন থেকে একদমই ভিন্ন। নজরুল বরং মধুসূদনেরই অনুগামী হয়েছেন। চিন্তার প্রাখর্যে নজরুল হয়তো মধুসূদন কিংবা রবীন্দ্রনাথ নন, তবে, এক্ষেত্রে নজরুলের গুরুত্ব এই যে মধুসূদনের রেখে যাওয়া স্কুলকে তিনি তাঁর মতো করে পুনর্জাগরিত করে খোদ নিজেরই একটা স্কুুল তৈরি করে গেছেন। কিন্তু, কোনো এক আশ্চর্য কারণে মধুসূদন-স্কুল ও নজরুল-স্কুলকে একসঙ্গে পাঠ করার যে 'ইন্টারডিসিপ্লিনারি' অত্যুঙ্গ প্রয়াস থাকা দরকার ছিল, তা অনুপস্থিত আধুনিক বাংলা সাহিত্য-সমালোচনায়। যার কারণে, স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সাহিত্যের গতিপথও নির্ধারণ করা যায়নি। শুরুটা হওয়ার কথা ছিল মধুসূদনের বৈপ্লবিক চিন্তাকে কেন্দ্রে রেখে, নজরুলযোগে। কিন্তু, নজরুল অযাচিত সাম্প্রদায়িক বাইনারির খপ্পরে পড়লেন, আর মধুসূদন তো অনালোচিতই রয়ে গেলেন! ভারতবর্ষ তথা বৃহৎ বাংলা তথা বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথের বিউপনিবেশায়ন মধুসূদন বিনির্মিত সৃষ্টিতে, মূখ্যত 'মেঘনাদবধ কাব্যে', জোরালোভাবে উপস্থিত থাকার পরও, আমরা উত্তরযুগে তা ধরতে ব্যর্থ হয়ে ফের পাশ্চাত্যের কাছেই ফিরে গেছি।

কাকতালীয় বটে, মধুসূদন-নজরুল উভয়েরই জীবন অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টে অতিবাহিত হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রেও তাঁরা রবীন্দ্রনাথ থেকে আলাদা। নজরুল তো একদমই ব্যতিক্রম। মধুসূদন রবীন্দ্রনাথের মতোই সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মেছিলেন বটে, কিন্তু ধর্মান্তরিত হওয়ার পরিণতি শেষ পর্যন্ত তাকে জীবনযুদ্ধে কঠোরভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিয়েছে। অথচ, মধুসূদন সেই সময়ের মানুষ, যখন কি না বাংলায় তথাকথিত 'রেনেসাঁস' হচ্ছে! ইউরোপীয় রেনেসাঁস চার্চের প্রভাব থেকে রাষ্ট্রকে আলাদা করেছিল। আর ভারতবর্ষে তথাকথিত 'বেঙ্গল রেনেসাঁসে'র কালে একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিকে ধর্মান্তরিত হতে হচ্ছে উন্নততর জীবনব্যবস্থা ও খ্যাতির মোহে, ধর্মান্তরিত হয়ে আবার পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে ত্যাজ্যপুত্র হতে হচ্ছে। এমন পারিবারিক ধর্মীয় গোঁড়ামি, তাও উচ্চশিক্ষিত এক পরিবারের, এ বড়ই আশ্চর্য অ-রেনেসাঁসীয় ঘটনা! উপরন্তু, সে কালেরই মধুসূদন ইহলৌকিক জীবনযাপন করেও কেন তাঁর ধর্ম ছাড়া চললই না, সেটাও বড় প্রশ্ন। আবার, ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে তখনকার প্রধান নেতৃস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিন্দু কলেজ যে অহিন্দু হিসেবে তাঁর ছাত্রত্ব বাতিল করে দিল, এটাও রেনেসাঁসের সমস্যা হিসেবে প্রশ্নভুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অহিন্দু ও অন্তঃজ শ্রেণির হিন্দুরা পড়ার অধিকার রাখেন না, মূখ্যত তাদের অ্যালামনাইয়ের উপনিবেশজাত রেনেসাঁসীয় বয়ানও প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া জরুরি। এসব প্রশ্নর উত্তরের মধ্যেই রেনেসাঁসের ফাঁকফোকর যেমন লুকিয়ে আছে, তেমনই লুকিয়ে আছে 'রেনেসাঁসপুত্র মধুসূদন'-কে নাকচ করার একাডেমিক গুরুদায়িত্ব। 

৪.

মধুসূদনকে বুঝতে হলে তাঁর সময় ও সমাজকে বোঝা দরকার। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের শেষে তাঁর জন্ম আর তৃতীয় ভাগ শুরু হওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু। এই পঞ্চাশ বছরে এমন অনেক কিছুই ঘটেছে, যা ভারতবর্ষ আগে দেখেনি। যশোরের সাগরদাঁড়ি গ্রামের মধুসূদন মহানগর কলকাতায় চলে আসতে না-আসতেই দেখলেন, ১৮২৯ সালে ভারতবর্ষে বেন্টিংক-রেজিম শুরু হয়ে গেছে। বিশাল প্রভাব নিয়ে ১৮৩৫ সালে টিবি ম্যাকওলের আগমন এবং ইংরেজি ভাষাকে কেন্দ্রে বসিয়ে 'আধুনিক ভারতীয় শিক্ষা' প্রচলিত হয়ে গেছে। হিন্দু কলেজে ১৮২৬ সাল থেকে ডিরোজিওর নেতৃত্বে হিন্দু সনাতনপন্থী চিন্তাকে মুক্তচিন্তার মারফত কুঠারাঘাত করা শুরু হয়ে গেছে। এরপর, মধুসূদন যখন উচ্চশিক্ষিত হয়ে গেছেন, ইংরেজি সাহিত্যে নিজেকে সঁপে দিবেন বলে মনস্থির করেছেন, তখন দেখলেন ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক মডেলে 'আধুনিক' তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়েছে— কলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজে— যার দুটি শহরে মধুসূদনের থাকার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে। আর দেখলেন, ১৮৫৭ সালের প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন বা উপনিবেশবাদী বয়ানে 'সিপাহী বিদ্রোহ'।

এতোকিছুর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে মধুসূদনের মতো জিনিয়াস সাহিত্য রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। ফলে, অতি অনিবার্যভাবেই তাঁর হাতে সৃষ্টি হয়েছে এমন সব নতুন বিষয় কিংবা কাউন্টার নেরিটিভ, যা অভূতপূর্ব বাংলা সাহিত্যের জন্য তো বটেই, বাংলার চিন্তাজগতের জন্যও। মধ্যযুগের দৈবিক, ঐশিক, গৈরিক ও অলৌকিক চিন্তাধারার পরিবর্তে সাহিত্যকে তিনি লৌকিক, অনাধ্যাত্মিক ও শৈল্পিক পর্যায়ে উন্নীত করেছেন। এই পরিসরে সেসবের চর্বিতচর্বণ বাতুলতামাত্র। শুধু এটুকু বলে রাখা ভালো, 'মেঘনাদবধ কাব্যে' তিনি মহাকবি বাল্মিকীর যে কাউন্টার তৈরি করেছেন, কিংবা 'বীরাঙ্গনা কাব্যে' পুরাণের নারীদের মুখে ভাষা দিয়ে তিনি যে তাদের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অবস্থানের অধিকারবোধকে তুলে ধরতে চেয়েছেন, তা তাঁর জাতীয়তাবাদী সংকীর্ণ মনের চেয়ে উদারনৈতিক রাজনৈতিক অবস্থানকেই স্পষ্ট করে।ব্রাত্যকে উঁচু ও ঋজু করে দেখার এ বাসনাই তাঁর দ্রোহী স্বভাবজাত এবং তা প্রকাণ্ড হয়ে উঠেছে তাঁর সময়কে নিজের মতো করে সৃষ্টি করার অভিপ্রায়ে। অন্তত সাহিত্যক্ষেত্রে, এ গুরুত্বপূর্ণ কর্মসিদ্ধিতে মধুসূদন নিঃসঙ্গই ছিলেন, বলা যায়। যেমন তিনি নিঃসঙ্গ ছিলেন তাঁর মৃত্যুকালে। 

৫.

মাইকেল মধুসূদন দত্ত আজও, দ্বিশতবর্ষ পরেও নিঃসঙ্গই। বাংলা সাহিত্য এবং দুই বাংলায় তাঁর যে সামাজিক অবস্থান হওয়া উচিত ছিল, তা সমাজ তাঁকে দেয়নি, রাষ্ট্র তাঁকে দেয়নি, সাহিত্যের বিচারকগণও দেননি। আশ্বস্তের কথা হলো, এতো বিরুদ্ধবাদী স্রোতে ভেসেও, মধুসূদন হারিয়ে যাননি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, 'অতিকায় হস্তি লোপ পাইয়াছে, কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে।' কিন্তু, মধুসূদন বাংলা সাহিত্য শুধু নয়, বাংলার চিন্তাজগতেরই সেই বিরল অতিকায় হস্তি, যিনি টিকে আছেন স্বীয় কৃতিত্বে, যোগ্যতায় ও অভাবনীয় প্রতিভায়। এবং তাঁকে অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করা যায়নি। 

বাংলার এক শ্রেষ্ঠ সন্তানের প্রতি কুর্নিশ জানাই, তাঁর আবির্ভাবের কারণে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই!