ভূমিকা ও তর্জমা: তাপস গায়েন
Published : 23 Mar 2024, 10:39 PM
লালসা আর ঘৃণা তাঁর আত্মাকে করেছে দগ্ধ, কারণ গ্রীষ্মের উদ্বেলিত সবুজের গভীরে সে এক নির্জন শিশুকে করেছে লঙ্ঘন; দীপ্তিময় শিশুর অবয়বে উন্মাদ দেখছে তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি, যা এখন রাতের প্রতিচ্ছবি । …ডিনারের টেবিলে মায়ের যন্ত্রণাময় হাতের নীচে শিলায় রূপান্তরিত রুটি; বিষণ্ণতায় প্রস্তরের মতো ভারী বোনের দুই চোখের উন্মাদনা ভর করছে তাঁর ভাইয়ের কপালে। ১
নির্জন এবং একাকীত্বের যে জীবন, নিখিল বেদনার পৌনঃপুনিকতায় কবি গেয়র্গ ট্রাকলের কবিতায় তাই যেন শান্ত উন্মাদনা হয়ে পাঠকের কাছে উন্মোচিত, আভাসিতমাত্র। কার্ল গুস্তাভ ইয়ুঙ্গ বিশেষজ্ঞ, এরিখ নয়ইম্যান, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তথ্য-উপাত্ত থেকে ট্রাকলের একটি ‘সাইকিক বায়োগ্রাফি’ ২ নির্মাণ করেছেন, যার রেখাচিত্র অনেকটা এইরকম:
মায়ের মাদকাসক্তি, পরিবারের প্রাত্যাহিকতা থেকে অব্যাহতি নিয়ে এন্টিকে ব্যস্ত এই নারী মায়ের ভালোবাসা দিতে অপারগ ছিলেন ট্রাকলকে। মানবিক সম্পর্কে তাঁর দ্বিতীয় ব্যর্থতা ছোট বোন গ্রেটার সাথে, যাকে তিনি কৈশোরে জেনেছেন, “সবচে সুন্দরী, সবচে বড় শিল্পী, সবচে ব্যতিক্রমী নারী” আর এই বোনকে নিয়ে তাঁর সারাজীবনের দোলাচল, এবং তাঁর কবি জীবনের নির্মিতির কারণ এবং ধ্বংস; এবং “বিলাপ” কবিতায় তাঁকেই সম্বোধন করেছেন, ‘হে নিখিল বেদনার বোন’ হিসেবে! বোনের সাথে রীতি-বহির্ভূত সম্পর্ক, অত্যধিক মাদকাসক্তি, কোকেনসেবন, যৌনপল্লীতে যাতায়ত, ইত্যাদি তাঁর মনোবিকলনের কারণ হয়ত; ট্রাকলের এই মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিপর্যয় তাঁর “মিথিক সত্তা” নির্মাণে তাঁকে বাধাগ্রস্থ করেছে !”
এরিখ নয়ইম্যান ধরে নিয়েছেন যে ট্রাকল এবং গ্রেটার মধ্যে এক ‘সিম্বায়োটিক সখ্য’ গড়ে উঠেছিল, যা পরবর্তীকালে রীতি-বহির্ভূত (ইনসেষ্ট = অজাচার) সম্পর্কের রূপ নিয়েছিল বলে তিনি নির্ণয় করেছেন। ঔপন্যাসিক গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের মাদাম বোভারী উপন্যাস, যা গ্রেটার সংগ্রহে ছিল, সেখানে ট্রাকল উৎকীর্ণ করেছেন, “হে আমার প্রিয় দৈত্যী, যে তুমি জেগে উঠেছ আরব্য রজনীর এক হাজার একটি মধুরতম এবং গভীরতম গল্প থেকে। সেই স্মৃতিতে! গেয়র্গ, সলঝবার্গ, গ্রীষ্ম ১৯০৮ ।” ৩ অনুমান করা হয়ে থাকে, ট্রাকল এবং গ্রেটার মধ্যে চিঠির আদান-প্রদান ছিল ৪, কিন্তু তার কোনো অস্তিত্ব নেই; হয়ত তা হারিয়ে গেছে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। ট্রাকলের বন্ধু, গ্রেটার স্বল্প সময়ের প্রেমিক—এহার্ড বুশবেক— ট্রাকল এবং গ্রেটার মধ্যে অজাচার নাকচ করে দিয়েছেন; অন্যদিকে, ১৯৫৪ খ্রি, থিয়োডর স্পেরির জানান দিচ্ছেন যে গ্রেটা এবং ট্রাকলের ভাইবোন অতিরিক্ত সম্পর্ক ছিল, যা তৎকালীন সাহিত্যজগৎ থেকে খুব দূরবর্তী বিষয় ছিল না।
রয় প্যাস্কাল ৫ জানাচ্ছেন, “ ট্রাকলের কালে ভাইবোনের রীতিবর্হিভূত সম্পর্ক নিয়ে সাহিত্যজগতে অপ্রতুল ছিল না—যেমন, হফম্যান্সস্থালের ‘ইদিপাস এন্ড স্ফিংক্স’ (১৯০৫); ঔপন্যাসিক থমাস ম্যানের গল্প ‘দ্য ব্লাড অফ দ্য ওয়ালসাং (১৯০৫);’ এবং স্তানিস্ল ছিভিসাভস্কী’র উপন্যাস ‘ডে প্রফুন্ডেস (১৯০০)।’ অটো রাংকের বই, ‘দ্য ইনসেষ্ট—থীম ইন লিটারেচার এন্ড লেজেণ্ড’ (১৯১২); ফ্রয়েডের ‘টোটেম এন্ড ট্যাবু’ (১৯১৩) । সঙ্গীতের জগতে জিন সিবেলিয়াসের ‘কুলেরভো’ যা গ্রীক উপাখ্যানের উপরে ভিত্তি করে রচিত, যেখানে অনেক আগে হারিয়ে যাওয়া বোনের সাথে ভাইয়ের যৌনাচারের কাহিনী আছে ।” ৫ এরিখ নয়ইম্যান বলছেন, “ট্রাকলের কাছে দার্শনিক নীৎশে হয়ে উঠেছিলেন এক কাল্ট, কম্পোজার রিচার্ড ভাগনারের প্রতি ছিল তাঁর অসামান্য শ্রদ্ধা, এবং ভাগনারের ‘ডিওয়োর কুইয়ো’ যেখানে ভাইবোনের ইনসেষ্ট স্থান পেয়েছে, তারই সুখ্যাতি ট্রাকল অকুন্ঠচিত্তে সমর্থন দিয়ে গেছেন। এই অজাচার, যা সত্য কিংবা কাল্পনিক যাই হোক না কেন, তা কবি ট্রাকলের কাব্যপ্রতিমার অন্যতম বাহিকাশক্তি হয়ে আছে। ‘প্যাশন’ কবিতায় ‘নীল নিষ্পাপ মানসের’ অবলুপ্তি হলো; এ যেন অনেকটাই খ্রিষ্টীয় চিন্তায় সেই আদিপাপ, কারণ ট্রাকলের কাব্যভাষায় তা ছিলো ‘উন্মাদ প্রজন্মের অন্ধ ভালোবাসা…।’
এরিখ নয়ইম্যান মনে করেন, যখন ভাইবোনের অজাচার প্রকৃত অর্থেই আদিমতম পতন এবং ধ্বংস; বোনের উপরে ভাইয়ের এই নিষ্ঠুরতা ট্রাকলকে করেছে খুনি এবং ভঙ্গুর এবং নিজের ভিতরের সৌম্য যুবককে করেছে ধ্বংস। তিনি আরও মনে করেন, যৌবনের প্রারম্ভিক পর্যায়ে এই সন্ত্রাস তাঁকে পরবর্তী জীবনে করেছে অপরাধী; পাপবোধ এসেছে এবং তাঁর ব্যক্তিত্বের নৈর্ব্যক্তিকায়ন (=ডিপার্সোনালাইজেশন) ঘটেছে; কিন্তু তিনি পূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়ে যান নি কেন ট্রাকলের কবিতা দোদুল্যমানমাত্র নয়, বরং খুবই অনির্দিষ্ট ।এবং যে পৌনঃপুনিকতায় তিনি শব্দ, ইমেজ এবং অনুভবকে ব্যবহার করেন, তা হলো অভিজ্ঞতার উপরে প্রভুত্ব। কিন্তু যে ভায়োলেন্সের তিনি নায়ক, তা তাঁকে পূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করেনি, তাঁর নন্দনতাত্ত্বিক এবং সৃজনশীল সত্তার পূর্ণ বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়েছে। নয়ইম্যানের মতে, এনিমা যা ব্যষ্টিক অবচেতন এবং সামষ্টিক অবচেতনের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা করে, তা ট্রাকলের ক্ষেত্রে ঘটেনি, কারণ বাইরের জগৎ, অর্থাৎ মায়ের সাথে এবং, বিশেষ করে, বোনের সাথে সম্পর্কের ছেদ ঘটতে থাকে, তিনি তখন আরও গভীরভাবে সামষ্টিক অবচেতনের দিকে ঝুঁকে পড়েন, যেখানে এনিমা অধিক ক্রিয়াশীল। মিথিক সত্তা নির্মাণে ব্যর্থ এই কবি হয়ে উঠেছেন, ‘ট্রান্সপার্শোনাল, আর্কেয়িক সিঙ্গার।’ ট্রাকলের কবিতা শুরু হয় নির্জনতার মধ্য দিয়ে; প্রতিটি সাহিত্য সমালোচক অবাক হয়ে দেখেছেন ট্রাকলের কবিতায় আশ্চর্যরকম নিঃশব্দতা এবং শূণ্যতা। রিলকে তাঁর কবিতা (হেলিয়ান) পড়তে গিয়ে অনুভব করেছেন, কীভাবে তাঁর কবিতা যতিচিহ্নের উপরে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে; কীভাবে অপ্রতুল শব্দভাণ্ডার দিয়ে নির্মিত কবিতা, শূন্যতাকে ভর করে, হয়ে ওঠে দিগন্তবিস্তারী।
যৌবনের উন্মেষপর্বে ট্রাকল ছিলেন মিতবাক, অন্তর্মুখী; ছিল তাঁর লম্বা চুল, এবং পোশাকে তিনি ছিলেন ফ্যাশন সচেতন; ঠিক এই পর্বে তিনি জুডেনগাস এবং স্টাইনগাসের যৌনপল্লীতে যাতায়ত শুরু করেন, এবং একজন বয়স্ক দেহপসারিনীর সাথে সখ্য গড়ে তোলেন; এর কারণ সম্ভবত তিনি এইসব নারীদের মধ্যে মাতৃরূপ খুঁজে ফিরতেন। অবশ্য মৃত্যু পথযাত্রী কাজিন মারিয়ার সাথে খন্ডকালিন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। প্রত্যেক সাক্ষাতে ট্রাকল মারিয়ার কোলে একটি করে লাল গোলাপ রাখতেন, এবং তাঁর দেয়া শেষ গোলাপ নিয়ে মারিয়ার শবযাত্রা সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু, গ্রেটা ব্যতীত কারও সাথে তাঁর গভীর প্রেম সম্ভব হয়ে উঠেনি। কবিতার পাঠকমাত্র জানেন, কীভাবে গ্রেটা তাঁর কবিতা জুড়ে ব্যাপ্ত।
[অন দ্য ওয়ে]
[এক] তোমার চোখ ডুবে আছে বিষণ্ণতায়/ জেগে আছে তোমার হাসির ক্ষীণ শব্দ /ঈশ্বর নমিত করেছেন তোমার চোখের পাতা
[রোজারির জন্য স্তব গান (বোনের প্রতি)]
[দুই] বোনের কম্পিত ছায়া অভ্যর্থনা জানায় সেইসব মৃত সৈন্যদের, দৃশ্যমান যাঁদের রক্তাক্ত অবয়ব, সেইসব বীর, যাঁদের প্রেতাত্মারা ঘুরে বেড়ায় নির্জন ফলের বাগানে । [গ্রোডেক]
[তিন] হে নিখিল বেদনার বোন । দেখ, এক ভীরু নৌকা ডুবে যায়। নক্ষত্র সমূহের নীচে রাতের নীরব অবয়ব
[বিলাপ]
ট্রাকলের আত্মহত্যার ঠিক পাঁচ বছর পরে গ্রেটাও আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন! কবি গেয়র্গ ট্রাকলের পাঠকমাত্রেই জানেন, এক শান্ত উন্মাদনা, যার সাথে মিশে আছে প্রথম মহাযুদ্ধের বিভীষিকা, হেমন্তের উন্মাদনা যা জার্মান ভাষার কবি হোল্ডারলীন, রিলকে, হফম্যান্সস্থাল, প্রমুখকে মৃত্যুর বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন করেছে; কিন্তু এরপরেও ট্রাকল রয়ে গেছেন অনন্য, কারণ সচেতনার শীর্ষবিন্দুতে যখন সচেতনতার অবলুপ্তি ঘটে, যখন ভাষা নিতান্তই চিন্তার বাহকমাত্র নয়, যখন পৃথিবীর বুকে রাত গভীর, যেন মহাজগতের উন্মেষবিন্দু মাত্র, যখন আমরা মুখর হয়ে উঠিনি, ঠিক তখনই নিজের অনিবার্য পতনের মধ্যে ভাষা, সহোদরা আর কবিতা— এই ত্রয়ীর নিরুদ্দেশ যাত্রা যেন তিনি ঠিক অবলোকন করে চলছেন!
রোজারির জন্য স্তব গান
(বোনের প্রতি)
যখন তুমি চলে যাও, তুমি নিয়ে আস হেমন্ত আর সন্ধ্যা
নীল হরিণ গাছের নীচে দ্রুতই শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়,
সন্ধ্যায় একটি পুকুর নির্জন হয়ে আসে।
উড়ন্ত পাখিদের উড়ে যাওয়ার নম্র শব্দ
তোমার চোখ ডুবে আছে বিষণ্ণতায়
জেগে আছে তোমার হাসির ক্ষীণ শব্দ
ঈশ্বর নমিত করেছেন তোমার চোখের পাতা
নক্ষত্ররা খুঁজে ফেরে রাত, শুভ শুক্রবারের শিশু,
দৃশ্যমান তোমার কপাল।
গ্রোডেক
সন্ধ্যা অতিক্রান্তে রাতের প্রথম প্রহর—
সমরাস্ত্রের সংঘাতে হেমন্ত অরণ্য জেগে ওঠে
সোনালী প্রান্তর আর সুনীল হ্রদ পাড়ি দিয়ে
গড়িয়ে গেছে সূর্য দীপ্তিহীন, অনুজ্জ্বল
রাত আলিঙ্গন করে মুমূর্ষু যোদ্ধাদের, আর
তাঁদের বিধ্বস্ত চোয়ালে আদিম বিলাপ, কিন্তু
চারণভূমিতে জড়ো হয় লাল মেঘ,
যেখানে এক ক্ষুদ্ধ দেবতার বাস, যিনি
নিজেই এক নির্গলিত রক্ত— হিম চাঁদের মতো
সব রাস্তাই প্রবাহিত তামসিক পতনের দিকে
রাত আর নক্ষত্রের সোনালি শাখার নীচে
বোনের ছায়া কম্পমান্ নির্জন অরণ্যের মাঝে
বীরদের আত্মা আর রক্তাক্ত মাথাকে শুভেচ্ছা জানাতে;
হেমন্তের বিষাদ বাঁশি বেজে চলে নলখাগড়ার বনে
হে গর্বিত বিষণ্ণতা— তুমি পিতলের বেদী
তীব্র এক বেদনা থেকে প্ররোচনা পায়
আত্মার গনগনে শিখা—
হে অনাগত প্রপৌত্র এবং প্রপৌত্রীগন
চলার পথে
সন্ধ্যায় তারা আগন্তুককে নিয়ে এলো মর্গে
বাতাসে আল্কাতরার ফিকে গন্ধ, লাল ডুমুরের মৃদু বিভঙ্গতা
জ্যাকদ্য পাখিদের কালো উড্ডয়ন, প্রহরারত এক সৈনিকের হাঁটাহাঁটি
কালো আভরণে সূর্যাস্ত হয়েছে; পুরাতন সন্ধ্যা ফিরে ফিরে আসে
পাশের কক্ষেই বোন বাজিয়ে চলছে সুবার্টের সোনাটা
অতি ধীরে তার হাসি সুনম্র ভঙ্গীতে ডুবে যায় পরিত্যক্ত ঝর্নার গভীরে,
যা ছড়ায় নীল এই সন্ধ্যায়, এই গোধূলিতে; অতি পুরাতন আমাদের জাতি
কে যেন বাগানে করে ফিস্ফিস্; কে যেন ফেলে গেছে কালো এই বেহেস্ত
কাপবোর্ড থেকে ব্যাপ্ত হতে থাকে আপেলের সুঘ্রাণ, পিতামহী জ্বালায় সোনার প্রদীপ
কী যে এই নির্জন মৃদু হেমন্ত; আমাদের পদচারণায় দীপ্ত এই পুরাতন পার্ক
কী বিপুলভাবে জেগে আছে হায়াসিন্থ তার অবয়বে
দীর্ঘ বৃক্ষের নীচে, এই গোধূলিতে
জেগেছ বসন্ত তোমার পায়ের পাতায়, আর রহস্যময় নিঃশ্চুপ লাল তোমার মুখে
ঘুমিয়ে পড়া পাতায় আবৃত হয়ে আছে পচনশীল সূর্যমুখীর কালচে সোনালি আভা
পপিতে আচ্ছন্ন তোমার চোখের পাতা আমার কপালে স্বপ্ন দেখে শান্ত ভারাতুর
হৃদয়ে আমার অতি মৃদু ঘণ্টী বাজে। তোমার অবয়ব যেন নীল মেঘ
এই গোধূলিতে আমার বুকে ব্যাপ্ত হয়ে আছে
অদ্ভুত এক টেভার্ণ থেকে গিটারের ধ্বনি ভেসে আসে
বন্য এল্ডারবুশ, চলে গেছে কবে নভেম্বরের দিন
জেগেছে আঁধারের সিড়িতে পরিচিত পদক্ষেপ, বাদামি আলোর অভিক্ষেপ
অবারিত জানালায় জেগে আছে প্রিয় এক আকাঙ্ক্ষা—
কী এক আধাঁর এই রাত; লালচে আগুন
নিভে গেছে আমার মুখে। এই নিশ্চলতায়
ভীত, সন্ত্রস্ত হৃদয়ের গান হারিয়ে যায়
মদ্যপ (আমি), এই পয়োনালিতে ডুবে যায় মাথা
প্যাশন
সন্ধ্যার অরণ্যে, রৌপ্য বেদনায়, অর্ফিয়ূস যখন
মৃতের উদ্দেশে বাঁশি বাজায়, তখন কে তুমি
বসে আছো দীর্ঘ বৃক্ষের নীচে শ্রান্তিতে অলস, মন্থর?
বিষণ্ণতা তখন ব্যাপ্ত হতে থাকে
হেমন্তের নল খাগড়ার বনে, নীল পুকুরে
বর্ধনশীল সবুজ বৃক্ষের নীচে যা ফিকে হয়ে আসে।
উন্মাদ প্রজন্মের অন্ধ ভালোবাসা
আলোছায়াময় পথে আপন বোনকে অনুসরণ করে,
যা দিনের সোনালী চাকায় উদীপ্ত হয়ে অপসৃত হয়েছে বহুদিন
এখন রাত শান্ত, নির্জন।
পাইনের আবছায়ায়, পাথুরে আলিঙ্গনে
দুইটি নেকড়ে তাদের রক্তকে মিলিত করেছে
পায়েহাটা পথের সাঁকোর উপরে
সোনালী আভার মেঘ অপসৃত হতে থাকে
নিভে গেছে শৈশবের নির্জন অধীরতা
অর্ধদেবতা ট্রাইটনের পুকুরে
ভেসে আসে নির্জীব মরদেহ
তার ঘুমন্তপ্রায় বেগুনি চুলের ভীড়ে,
যেন শেষাবধি তার সৌম্য মাথা হবে চৌচির
এবং একটি নীল হরিণ প্রায় সময়ই
সান্ধ্য বৃক্ষের নীচে অন্ধকার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে
যেন চির জাগরুক, যেন রাতের সঙ্গীতে মুগ্ধ
শান্ত উন্মাদনা, কিংবা যন্ত্রসঙ্গীতের প্রবহমানতা,
যা পূর্ণ হয়ে আছে অস্বচ্ছ উন্মাদনায়
এক পাথুরে নগরীর
অনুতপ্ত এক বালিকার হিমশীতল পায়ের পাতায়
তথ্যপঞ্জীঃ
[১] Autumn Sonata by Georg Trakl, translated in English by Daniel Simko; Dream and Derangement, p. 129-135।
[২] Georg Trakl, Marie Jaanus Kurrik, Columbia University Press, New York & London, 1974
[৩-৫] Introduction by Michael Jarvie (from) Autumnal Elegies by Georg Trakl, Translated in English by Michael Jarvie, 2019, p. 17-p18
টিকাঃ
(Symbiotic Relation= সিম্বায়োটিক সখ্য)— প্রানিজগতের মধ্যে সিম্বায়োটিক সখ্যর নমুনা প্রচুর আছে । দু’টি মানুষের মধ্যেও এই সম্পর্ক সম্ভব!
Symbiosis: The Art of Living Together (nationalgeographic.org)
(Depersonalization = ডিপার্সোনালাইজেশন) — যখন কেউ নিজের অনুভূতিগুলোকে নিজের না ভেবে মনে করে এই অনুভূতিগুলো তাঁর শরীরের বাইরের, অর্থাৎ, নিজেকেই নিজে বাইরে থেকে দেখে; তখন পরিপার্শ্বকেও অলীক মনে হয়।
(Transpersonal Experience = ট্রান্সপার্শোনাল অভিজ্ঞতা)—পরিবর্তিত এক সত্তা, যা একার হয়ে অনেকের অভিজ্ঞতার রূপারূপ দেখায়, যা বাস্তবের থেকেও অধিক বাস্তব! বাউল, সুফি সাধকরা এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাওয়াআসা করেন।