বঙ্গবন্ধু: ইতিহাসের অমর মহানায়ক

মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্‌পু
Published : 17 March 2022, 01:00 PM
Updated : 17 March 2022, 01:00 PM

ইতিহাসের দিনপঞ্জি সবসময়ই মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বছরের ১২টি মাসও তাই। তবে এই বারো-র মধ্যেও যে মাসটি বাঙালি জাতির কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়, তা হলো- মার্চ। মার্চ আমাদের কাছে যেমন শোকের মাস, তেমনি মুঠো ভরে পাওয়ার মাসও এই মার্চ। রোমান বর্ষপঞ্জিকাতে মার্চ ছিল প্রথম মাস। রোমানদের যুদ্ধ দেবতা মারিটাসের নাম অনুসারে এই মাসের নামকরণ হয়েছে। অর্থাৎ মার্চ মাসটির উৎপত্তি যুদ্ধ-বিগ্রহকে কেন্দ্র করে। তবে আমাদের কাছে মার্চ শুধু যুদ্ধ-বিগ্রহ কিংবা অগ্নিঝরা হিসেবে পরিচিত নয়; বাঙালি জাতির অনেক কিছু পাওয়ার মাস হলো এই মার্চ। মার্চে যেমন পাকিস্তানি সৈনিকরা নির্মম গণহত্যা চালিয়েছে; তেমনি এই মার্চেই বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলিত হয়েছে। রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। আবার এ মাসেই আমাদের স্বাধীনতা দিবস। তবে জাতীয় জীবনের এসব অর্জন-বিসর্জনকে ছাপিয়ে যায় আজকের ১৭ মার্চ তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন।

অনেক কারণেই এবারের বঙ্গবন্ধুর জন্মোৎসব আমাদের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ। এরমধ্যে একদিকে যেমন বাংলাদেশ স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জনের ৫০ বছর পূর্ণ করেছে, অন্যদিকে দুই বছরের বেশি সময় ধরে উদযাপিত জন্মশতবার্ষিকী উৎসব শেষ হচ্ছে ৩১ মার্চ। যদি ইতিহাসে ফিরে তাকাই, তবে দেখবো- বাঙালি জাতির জন্য বঙ্গবন্ধু শুধু নিজের প্রাণ দেননি, নিজের ব্যক্তিগত সুখস্মৃতিগুলোও ভাগ করেছেন সবার সাথে। জীবদ্দশায় ওই অর্থে জন্মদিন উদযাপন করেননি বঙ্গবন্ধু। তিনি এমন একটি হিমালয়, যিনি নিজের জন্মদিন পালন না করে তার বিনিময়ে ওইদিন জাতির কল্যাণের কথা চিন্তা করেছেন। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৭ মার্চ ৫২ বছরে পা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এদিন বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, "আপনার ৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচাইতে বড় ও পবিত্র কামনা কী?" উত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'জনগণের সার্বিক মুক্তি'। এর পর তিনি যা বলেছিলেন, তা রীতিমত শিউরে ওঠার মতোই। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, "আমি জন্মদিন পালন করি না- আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এ দেশে মানুষের নিরাপত্তা নাই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যে কোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কি, আর মৃত্যুদিনই কি? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু।"

১৯৬৭-তে লেখা আত্মজীবনী 'কারাগারের রোজনামচায়'-তেও নিজের জন্মদিনের কথা লিখে গেছেন বঙ্গবন্ধু। তার ভাষায়, "আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটা উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই। আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস! দেখে হাসলাম।"

১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড ময়দানে বক্তৃতা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। পরে রাজভবনে যখন দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয়, তখন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "আমার জন্মদিন ১৭ মার্চ। আপনি সেদিন বাংলাদেশ সফরে আসবেন। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার সফরের আগেই আমি চাই আপনার সেনাবাহিনী বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেবেন।" শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সম্মতি জানিয়েছিলেন। ১৭ মার্চ ইন্দিরা গান্ধী বাংলার মাটি স্পর্শ করার আগেই ১২ মার্চ বিদায়ী কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিল। এই হলো নিজের জন্মদিনে বঙ্গবন্ধুর চাওয়া ও পাওয়া। এই ছিল বাংলার অবিসংবাদিত নেতার অকৃত্রিমত্তা।

১৯৯১ সালের ১৩ অগাস্ট পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে 'শেখ মুজিব আমার পিতা' শিরোনামে প্রবন্ধ লিখেছিলেন কন্যা শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি বলেন, "…নানা শেখ আবদুল মজিদ আব্বার আকিকার সময় নাম রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান।…নাম রাখার সময় বলে যান-  'মা সায়রা, তোর ছেলের নাম এমন রাখলাম, যে নাম জগৎজোড়া খাত হবে'।" 

হয়েছেও তাই। বিশ্ব ইতিহাসের মহানায়ক হয়েছেন আমাদের জাতির পিতা। অসীম ত্যাগ, তিতিক্ষা, সাহস, প্রজ্ঞা, বলিষ্ঠ এবং আপসহীন নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালি জাতীয় ভীত গড়ে দিয়েছেন তিনি। অতি সাধারণ এক জাতি সংগ্রামীতে রূপান্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছেন স্বাধীন বাংলাদেশ। এ কারণেই তিনি অবিসংবাদিত নেতা। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।

ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার অজ পাড়া গাঁ টুঙ্গিপাড়ায় যে শিশুটি খোকা পরিচয়ে জন্ম নিয়েছিলেন, সেই শিশুই পরবর্তীতে জাতীয় নেতা, বঙ্গবন্ধু এবং সবশেষে একটি জাতির পিতা হয়ে ওঠেন। জন্মের পর থেকেই জীবনের প্রতিটি ধাপে নিজেকে চিনিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। দেখেছেন একটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। ১৯৪৮, ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০ এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি বিশেষ অবদান রেখেছেন। গেয়েছেন শেকল ভাঙ্গার গান। দেশের মানুষকে শিখিয়েছেন মুক্তির মূলমন্ত্র। তাঁর নেতৃত্বেই বিশ্ব মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাঙালি। আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

২০২০ সালের ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মের ১০০ বছর পূর্ণ হয়; যা উদযাপনের লক্ষ্যে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ সময়কে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার। তবে কোভিড মহামারী শুরু হওয়ায় ওই সময়কাল ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। এরপর মুজিববর্ষের সময়কাল আরেক দফা বাড়িয়ে ২০২২ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ঘিরে শুধু সরকারি-বেসরকারি পর্যায়েই উদ্যোগ থেমে ছিল না, ব্যক্তিগতভাবেও বছরজুড়ে ছিল নানান আয়োজন। এসব আয়োজনের মাধ্যমে শুধু বঙ্গবন্ধুর স্থানই উচ্চ থেকে উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছেনি, তা নয়; বরং জাতি হিসেবে আমরাও সামনে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা পেয়েছি তাঁর জীবনদর্শন থেকে।

কোভিড মহামারীর মধ্যেও মুজিব শতবর্ষের আয়োজনে অংশগ্রহণ করেছেন ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ভুটানের রাষ্ট্র-সরকারপ্রধানেরা। আয়োজনে অংশ নিয়ে মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহীম মোহাম্মদ সলিহ বলেছেন, "বঙ্গবন্ধু আজীবন রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে আপসহীন ছিলেন। …যারা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখে তাদের সবার হৃদয়ে সব সময় সম্মানের আসনে থাকবেন বঙ্গবন্ধু।" ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং বলেছেন, "বিশ্বকে বলার মতো গল্প দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু''। শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের বক্তব্য, "বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে অনুসরণ করেই বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করেছেন।" নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবি ভান্ডারি বলেছেন, "বঙ্গবন্ধুর ধারাবাহিক সংগ্রামের ফলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর আপনার [শেখ হাসিনা] নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে"। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উক্তি, "বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাংলাদেশকে আজকে এখানে নিয়ে এসেছে"। এছাড়াও বিবৃতি পাঠিয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইউশিহিদে সুগাও, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পোপ ফ্রান্সিসসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা। এছাড়া তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। একই সঙ্গে নগরীর একটি উদ্যানের নামকরণ করা হয় বাংলাদেশের জাতির পিতার নামে। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর নাম আরও একবার উজ্জ্বল হয়েছে।

দুই

১৭ মার্চ আসলেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাটানো বেশ কয়েকটি স্মৃতি চোখের সামনে ভাসে। ৬ দফার প্রচারণা চালাতে ১৯৬৬ সালে পাবনায় গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এদিন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রব বগা মিয়ার বাসায় দুপুরের খাবার খান বঙ্গবন্ধু। সেখানেই বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখি। সেদিন তিনিই আমাকে তার সভায় যেতে আহ্বান করেছিলেন। এরপর আর পেছনে তাকাইনি। কয়েক মিনিটের সাক্ষাতে পিতা মুজিব যেভাবে রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন; সেটাই যে আমাকে পরবর্তীতে এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্রলীগের জিএস, অবিভক্ত পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এবং জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে ছয় বছর দায়িত্ব পালনে উৎসাহ জুগিয়েছে; তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে, ততবারই তার কাছ থেকে নতুন কিছু শিখেছি। স্বাধীনতার পর বেশ কয়েকবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে আমার। যার একটি ঘটনায় সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হই। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বন্যা কবলিত মানুষকে বাঁচাতে পাবনায় 'মুজিববাঁধ' উদ্বোধন করতে এসেছিলেন তিনি। আমি তখন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। স্বাগত বক্তব্যের দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। বক্তৃতা দিলাম। ডায়াস থেকে যখন মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়েছি, ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধু আমার হাত ধরে ফেললেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দাঁড়িয়ে গিয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমু দিয়ে বললেন- 'তুই তো ভালো বলিস'। বঙ্গবন্ধুর বুকে লেপ্টে আছি; কী বলব কী বলা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না। মুহুর্তের জন্য হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম জাতির পিতার দিকে। পরে দুই-একটি কথা বলে স্টেজের সাইডে গেলাম। পরে এই ভেবে উৎসাহি হলাম যে, মাত্র ১৮মিনিট বক্ততৃায় যিনি সাত কোটি মানুষকে এক সুতোয় গেঁথেছিলেন, লাখ লাখ মানুষকে রাস্তায় নামিয়েছেন; সেই মানুষটি যখন আমার ভাষণের প্রশংসা করলেন, তখন সেটা নিঃসন্দেহে ছোট ব্যাপার নয়।

বঙ্গবন্ধুকে 'গার্ড অব অনার' দেওয়ার মধ্য দিয়ে যথারীতি অনুষ্ঠান শেষ হলো। বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে উঠতে যাচ্ছেন, এমন মুহূর্তে আমার কাছে জানতে চাইলেন- ঢাকা যাব কি-না? আগে-পাছে চিন্তা না করে রাজি হয়ে গেলাম। প্রথমবারের মত হেলিকপ্টার ভ্রমণের সুযোগ হলো, তা-ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। ঢাকায় হেলিকপ্টার থামলো পুরাতন বিমানবন্দর তেজগাঁওয়ে। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে ডাকলেন বঙ্গবন্ধু। নির্দেশ দিলেন, খরচ দিয়ে আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে।

১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সাংগঠনিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আরেকবার পাবনা আসেন বঙ্গবন্ধু। জনসভার আয়োজন তখন স্টেডিয়ামে। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে সেবারও বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ হলো। বক্তৃতা শেষে বঙ্গবন্ধু ঠিক পূর্বের ন্যায় আমাকে জড়িয়ে ধরেন। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন, আমি যেন ভবিষ্যতে আরও উন্নতি করি।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল পঁচাত্তরে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। জেলা বাকশালের সম্পাদক ও ৫ যুগ্ম-সম্পাদক মিলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। জাতির জনক সেদিন তার স্বভাব ড্রেসকোড 'হাফ-শার্ট'' ও 'লুঙ্গি' পড়েছিলেন। এই সাক্ষাতের দু'মাস পরেই যে বঙ্গবন্ধু চলে যাবেন, কে জানত সেটা? 

তিন

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে এখন শুধুই উন্নয়নের ছোঁয়া। বঙ্গবন্ধুর জন্মোৎসব তথা মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে এই উন্নয়ন দ্বিগুণ মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে হাতে নেয়া হয়েছে অগণিত প্রকল্প; যা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগীরাও বিভিন্ন অনুদান ও ঋণ দিয়ে পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সরাসরি ৪৫০ কোটি ডলারের বাড়তি ঋণ ও অর্থ সহায়তা দেয়ার জানিয়েছে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের (জিসিএফ) আওতায় চার বছরে ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এছাড়া সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে দুটি চলমান প্রকল্পে অতিরিক্ত ও একটি নতুন প্রকল্পে ৩৫ কোটি ডলার অর্থ অনুদানের কথা জানিয়েছে। অন্যদিকে ছয়টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ২৭০ কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জাইকা। 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' অবলম্বনে নির্মাণ করা হয়েছে 'চিরঞ্জীব মুজিব' চলচিত্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ছোট বোন শেখ রেহানা নিবেদিত এই চলচিত্র দেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে নির্মিত ছবিটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের ১৯৪৯ থেকে ১৯৫২ সাল উঠে এসেছে। জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরতে 'মুজিব ১০০' অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিশ্বনেতাদের বিবৃতি, মুজিব শতবর্ষের থিম সং, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নির্মিত গ্রাফিক নভেল 'মুজিব'সহ নানা বৈচিত্র্যময় কন্টেন্ট দিয়ে অ্যাপটি সাজানো হয়েছে। এছাড়া বছরজুড়েই লোকজ মেলা আয়োজন, অনলাইন কুইজ প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন প্রকাশনা মুদ্রণের কাজসহ নানা আয়োজনে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মকে স্মরণ করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী বাঙালির কাছে নিছক জন্মদিন নয়। জীবদ্দশায় তিনি শোষিতের নেতা হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। ফিদেল ক্যাস্ত্রোর মতো বিশ্বনায়কের চোখেও তিনি ছিলেন হিমালয়। বিশ্ব মিডিয়ায় তিনি উপাধি পেয়েছিলেন 'রাজনীতির কবি' হিসেবে। এই জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপনের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের মানুষ এবং বিশ্বের মুক্তিকামী, স্বাধীনতাকামী মানুষ বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। তরুণ প্রজন্মও ব্যাপকহারে এই আয়োজনে সম্পৃক্ত হচ্ছে, যা আগামীর বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত আনন্দের। ব্যাপারটি যেন বঙ্গবন্ধুর কীর্তিকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করারই নামান্তর।

সত্যি বলতে বঙ্গবন্ধুর নাম স্বাধীন এ দেশের ইতিহাসের পরতে পরতে লেখা। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানান। তাঁর সে ভাষণ আজ 'ওয়ার্ল্ডস ডকুমেন্টারি হেরিটেজ' হিসেবে ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত। স্বনামধন্য লেখক আহমদ ছফা শেখ মুজিবুর রহমান নামক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান এ দুটো যমজ শব্দ, একটা আরেকটার পরিপূরক এবং দুটো মিলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল-প্রোজ্জ্বল এক অচিন্তিত পূর্ব কালান্তরের সূচনা করেছে।' বাস্তবিক অর্থেই বঙ্গবন্ধুবিহীন আমরা নিজেদের অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারি না। ১০২ বছর আগে আজকের এই ১৭ মার্চে অজ পাড়া গাঁ-য়ে ছোট্ট খোকা এসেছিলেন বলেই আমরা বঙ্গবন্ধুকে পেয়েছি, পেয়েছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, ৭ ও ২৬ মার্চ, সর্বোপরি মুক্তির স্বাদ। তাই আজকের দিনে এটাই চাওয়া- উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতোই আমাদের প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে চির জাগরুক হয়ে থাকুক শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের বঙ্গবন্ধু।