একবার এক জীবিকায়ন প্রকল্পের আওতায় হাওরের অতিদরিদ্র একটি পরিবার কয়েকটি হাঁস এবং হাঁস পালনের প্রশিক্ষণ পেল। আদরযত্নে লালন করে, কয়েকটি বিক্রি করে নতুন ছানা কিনে অল্প সময়ের মধ্যে তাদের হাঁসের সংখ্যা বাড়তে লাগল। এর পূর্বে পরিবারটি কখনো গবাদী পশুপাখি পালন করেনি। নিজেরাই খেতে পায় না, কেনার টাকা কই? যাইহোক, নতুন খামারী স্বপ্ন দেখেন তিনি একটা হাঁসের খামার করবেন। কিন্তু বিধি বাম। হুট করে একদিন হাওরে বন্যা আসে। পানির টানে তাদের সব হাঁস ভেসে যায়। হাঁস বিক্রি করে একটু একটু করে খামারী যে টাকা সবে সঞ্চয় করতে শুরু করেছিলেন তা বন্যার সময়ে খাবার জোটাতে শেষ হয়ে যায়। বন্যা একসময় শেষ হয় বটে। কিন্তু নতুন করে হাঁস কেনার মতো একটি টাকাও পরিবারটির হাতে থাকে না। সব হারিয়ে তারা তখন আগের মতো নিঃস্ব অবস্থায় ফিরে গিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রকৃতি ও জীবিকায়নের যে নিবিড় ও জটিল সম্পর্ক তার অন্য বাস্তবতাও রয়েছে। আমাদের উপকূলীয় দক্ষিণাঞ্চল ছিল দেশে ধানের মূল জোগানদাতা। সেখানে আইলা ও সিডর নামক ভয়াবহ দুটো ঝড় আঘাত হানার পর বাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে স্থলভাগ ও জলাশয়গুলোতে লবণাক্ততা আশংকাজনকভাবে বাড়তে শুরু করে। এটা যেমন সেই এলাকার জন্য সমস্যা ছিল, একই সঙ্গে জমে থাকা লবণাক্ত পানি নতুন জীবিকায়নের পথও উন্মোচন করল। জোরেশোরে শুরু হলো লবণ পানি আটকে রেখে চিংড়ি চাষ। চিংড়ি রপ্তানি বাংলাদেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়াল। চাষের জমি দখল করে বা স্বল্প মূল্যে কিনে নিয়ে ধনী ব্যক্তিরা মাইলের পর মাইল জুড়ে চিংড়ি চাষ শুরু করলেন। চিংড়ি চাষের জন্য নদীর বাঁধ কেটে বা অন্যান্য নানা পদ্ধতি ব্যবহার করে লবণ পানি জমিতে আটকে রাখতে রাখতে আজ পুরো দক্ষিণাঞ্চলের পরিবেশ ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি। সেখানে মাটি ও ভূগর্ভস্ত পানিতে লবণের মাত্রা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে সব এলাকায় গাছ জন্মাতে চায় না। ফলে চাষাবাদ করা যায় না। আগে যারা ছিলেন দরিদ্র প্রান্তিক কৃষক তারা এখন চিংড়ি ঘেরের শ্রমিক। লবণ পানিতে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করা এবং খাওয়াসহ সকল কাজে লবণ পানি ব্যবহার করার ফলে সেখানে মানুষের শরীরে নানাবিধ রোগব্যাধি দানা বেঁধেছে। দক্ষিণাঞ্চলে সরকারসহ অসংখ্য সংস্থা জলবায়ুসহিষ্ণু জীবিকায়নের ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছে। মিঠা পানির সংস্থানের লক্ষ্যে অনেক পদ্ধতির উদ্ভাবন করা হচ্ছে। কিন্তু চিংড়ি চাষের ফলে পরিবেশ যদি বিপর্যস্ত হতেই থাকে আর সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতি হতে থাকে রুদ্র থেকে রুদ্রতর, তাহলে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীবন ও জীবিকায়নের জন্য নিত্য নতুন উদ্ভাবনও তাল মেলাতে পারবে না।
আমাদের তাই যেকোনও জীবিকায়ন কার্যক্রমে প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে জীবিকার সামঞ্জস্য নিশ্চিত করা এবং পরিবেশ রক্ষা করতে কীভাবে জীবিকায়ন কার্যক্রম ভূমিকা রাখতে পারে– এই বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেভাবে ঝড়-বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুযোর্গের হার ও ভয়াবহতা বেড়ে চলেছে তাতে জলবায়ু ও পরিবেশকে আলাদাভাবে চিন্তা করার আর কোনো সুযোগ নেই। যেকোনো জীবিকায়ন প্রকল্পে বর্তমানে একজন উপকারভোগীর জন্য একের অধিক জীবিকায়নের ব্যবস্থা করা তাই জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন, হাঁসের খামারী যদি শুধু হাঁস চাষ না করে পাশাপাশি অন্য গবাদি পশুও পালতেন বা আয়ের আরেকটি পথ তেরি করতেন তাহলে হাঁসগুলো হারানোর পরও তিনি বিকল্প আয়টিকে আঁকড়ে ধরে সামনের দিকে এগুতে পারতেন। যে সংস্থাটি তাকে হাঁস দিয়েছে তারা উচিত ছিল কোনোভাবে হাঁস হারালে এই দরিদ্র পরিবারটি যে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে সেই সম্ভাবনাকে বিবেচনায় নিয়ে পরিবারটিকে একক আয়ের বদলে বহুমুখী আয়ের পথ তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা বোঝানো এবং সে অনুযায়ী সহায়তা করা।
অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চলে কোনো কৃষক পরিবার যদি জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবেলা করে গরু-ছাগল পালন ও জলবায়ুবান্ধব চাষাবাদ বা এ রকম দুই-তিন রকমের আয়ের উৎস তৈরি করতে পারেনও, তারপরও তাকে অবশ্যেই দুর্যোগকালীন এবং দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে তার আয়ের উৎসগুলো যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় বা কম ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেজন্য করণীয়গুলো শিখে নিতে হবে। যেমন, ঝড় আসার আগে সাইক্লোন সেন্টারে যাওয়ার সময় বাড়িতে জমানো টাকাসহ অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী মাটির নিচে পুঁতে রেখে যেতে হবে। টিউবওয়েলের মাথা খুলে বাকি অংশ ভালোভাবে প্লাস্টিক বা চটের বস্তা দিয়ে মুড়ে মাথাটাও মাটিতে পুঁতে রাখতে হবে। এর ফলে বন্যার পানি টিউবওয়েলের ভেতর ঢুকতে পারবে না। বাড়ি ফিরে পুরো বাড়ি ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ধুয়ে জীবানুমুক্ত করতে হবে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর গরু-ছাগলকে দুই/তিনদিন মাঠের ঘাস খাওয়ানো যাবে না। এর ফলে তাদের রোগব্যাধি হতে পারে। এ সব প্রয়োজনীয় তথ্য না জানা থাকলে একটি ঝড় একটি পরিবারকে পথে পথে বসিয়ে দিতে পারে। তাই যেকোনো জীবিকায়ন প্রকল্পে দুর্যোগ মোকাবেলা করে কীভাবে জীবন ও জীবিকায়নকে রক্ষা করতে হবে সেই জ্ঞান উপকারভোগীদের শেখানোর কার্যক্রম থাকতে হবে।
দুর্যোগসহনশীল জীবিকায়নের প্রয়োজনীয়তা ধনী-দরিদ্র সবার জন্যই অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। বতর্মানে সারা বিশ্বব্যাপী সরকারি-বেসরকারি সকল জীবিকায়ন কার্যক্রম যেন উপকারভোগীদের মধ্যে দুযোর্গ সহনশীলতা তৈরি করতে পারে সেভাবে সেগুলোকে ঢেলে সাজানোর কথা বলা হচ্ছে। কারণ একটি দুর্যোগ যদি একটি মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারকে নিঃস্ব করে দেয় তাহলে বুঝতে হবে পরিবারটি যে আয় করে তা তাদের মধ্যে সংকট মোকাবেলার ক্ষমতা তৈরি করতে পারেনি। ঠিক এ কারণেই কোভিড-১৯ অতিমারির সময় আমরা দেখেছি দরিদ্রদের পাশাপাশি দলে দলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারও কাজ হারিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গিয়েছে। আমরা আর এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না। অন্যদিকে সবার জন্য একই সমাধানও প্রযোজ্য নয়। মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে একজন ব্যক্তির একের অধিক আয়ের উৎস থাকার সুযোগ কম। আবার একজন শিক্ষিত ব্যক্তি তিনি যে পেশায় পারদর্শী সেটিতেই মনোনিবেশ করতে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। তাহলে এই মানুষগুলো যদি কোনো ভয়াবহ দুর্যোগে কাজ হারিয়ে ফেলেন তখন তাদের পরিবার কীভাবে চলবে? এই বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা এবং নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন আছে, যেমন, পরিবারের কর্মক্ষম নারী-পুরুষকেই আয়মূলক কাজে সম্পৃক্ত করা, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিকে এমনভাবে শক্তিশালী করা যেন সেগুলো উপকারভোগীদের শুধু সাময়িক রিলিফ না দিয়ে বরং টেকসইভাবে আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়ে তাদের মধ্যে দুর্যোগসহিষ্ণুতা তৈরি করতে পারে, ইত্যাদি। এছাড়াও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আস্তে আস্তে দেশের সকল জনেগাষ্ঠীকেই নিয়ে আসতে হবে যেন কোনো বড় প্রাকুতিক দুর্যোগ ঘটলে তার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত এমনকি মারাত্বভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বিত্তশালী পরিবারও সহায়তা পায়।
৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য 'একটাই পৃথিবী'। এই একটিমাত্র পৃথিবীতে আমরা একবারই জন্ম নেওয়ার সুযোগ পাই। তাই সেখানে প্রতিটি মানুষের রয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বেঁচে থাকার অধিকার। মানুষের অপরিণামদর্শী কার্যক্রমের কারণে জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। বিশ্বনেতারা যতদিন সম্মিলিতভাবে না চাইবেন ততদিন এই পরিবর্তনকে বন্ধ করা সম্ভব হবে না। তাই জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ বিপর্যয়কে একই লেন্স দিয়ে দেখতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলা করে সকল জনগোষ্ঠী যেন ভালোভাবে টিকে থাকতে পারে তার জন্য যা যা প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের এই লগ্নে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকল অংশীদারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।