তোমরা বলো মহীরুহ, আমি বলি আমার রুহ: সুরক্ষিত থাকুক সিআরবি-র সবুজ

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 15 July 2021, 06:38 PM
Updated : 15 July 2021, 06:38 PM

আমাদের সমূহ নাগরিক পাপের প্রাকৃতিক প্রায়শ্চিত্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নগরের বৃক্ষরা। উন্নয়নের ঊর্ধমুখী গ্রাফের কোপে মরছে পাহাড় ও ভূমির গাছেরা, মরছে জলের মাছেরা। আধিকারিকরা উন্নয়নের ব্যালান্স শিট দেখিয়ে হাততালি কুড়াতে ব্যস্ত। আসলে এমন জোড়াতালির উন্নয়ন টেকে না। আপনাদের শেখানো পরিভাষায় বলি 'সাস্টেইনেবল' হয় না, টেকসই হয় না। জনবান্ধব লাগসই কিছু করুন।

পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায়  চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় পাঁচ শ শয্যার হাসপাতাল ও এক শ আসনের মেডিকেল কলেজ নির্মাণের জোর তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। ইউনাইটেড হাসপাতালের সঙ্গে রেলওয়ের চুক্তি সম্পাদিত হয় গত বছরের মার্চে। ২০১০ সালে  পিপিপি পলিসি প্রণয়ন করা  হলেও  আইন গৃহীত হয়েছে ২০১৫ সালে। পিপিপি পলিসি ও আইন, বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রণয়ন করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। শুরু থেকেই স্টেক হোল্ডারদের আগ্রহের অভাবে লাভজনক তো হয়ইনি বরং পিপিপির উদাহরণ 'কুইক রেন্টাল' বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রগুলো এখন উন্নয়ন দায় হয়ে দেখা দিয়েছে। সিআরবির সমালোচিত এই হাসপাতাল প্রকল্পও পিপিপি-র অধীনে। তবে লাভজনক বিবেচিত হলেও প্রকৃতি নষ্ট করে এ হাসপাতাল নির্মাণ সমর্থন পেত এমন নয়। গাছ পাহাড় ও পরিবেশের ক্ষতি না করে এমন প্রকল্প করার জায়গার অভাব চট্টগ্রামে নেই।

অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে এক মোহন ল্যান্ডস্কেপ এ সিআরবি। চৈত্র সংক্রান্তি, পয়লা বৈশাখ, বসন্ত উৎসব, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীর মতো  আবহমান বাংলার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় সিআরবি-র মায়াবী পরিবেশে। ডিসি হিলের ব্যবহার সীমিত হয়ে আসার পর এ সবুজ প্রাকৃতিক মঞ্চ  প্রাণবন্ত করে তোলেন সংস্কৃতি কর্মীরা। এই ছায়াঘেরা মায়ার অঞ্চল জুড়ে  চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ২০১২ সালে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে সিআরবি এলাকাকে অধিকতর উন্নয়নের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। ফ্লাইওভার বা মেট্রো রেল স্থাপনের মতো বড় ও লাভজনক নয় বলেই হয়তো সে প্রকল্প পরিকল্পনাতেই আটকে আছে।

আমাদের উন্নয়ন ভাবনায় এক ধরনের নৈরাজ্য দেখা যায়। যে কারণে খুব প্রাসঙ্গিকভাবে পুঁজিতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থার কোন না কোন পর্যায়ে প্রকৃতি ও প্রাণের বিনাশের ব্যাপারটি সামনে চলে আসে। পরিবেশবাদী ও উন্নয়নবাদী- দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। কিন্তু এখানে সিআরবির গাছের পক্ষে দাঁড়ানো প্রতিবাদকারীরা আসলে জীবনবাদী। এই এক চিলতে পাহাড়ি সবুজ আসলে চট্টগ্রামের ফুসফুস। অর্থনীতিবিদ সেলিম জাহান তার এক লেখায়  কাটা গাছের শহরকে বলেছেন- 'উলঙ্গ শহর'। আমরা এমন 'উলঙ্গ শহর' চাই না। কেউ এ প্রকল্পের বিরোধী নন বরং  হাসপাতাল নির্মাণের স্থান নির্বাচনকে পুনর্বিবেচনায় নিয়ে অন্য কোথাও বাস্তবায়ন করতে বলছেন।

দেশের আর কোন শহরের নামের আগে কিন্তু 'বীর' বিশেষণ দেখা যায় না যেমন দেখা যায় 'বীর চট্টলা' অভিধায়। আসলে শহর তো বীর হয় না, হয় এর নাগরিকেরা, যা দেখা গেছে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় । আরও মনে পড়ছে- প্রয়াত এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে রাতভর ভোট পাহারা দিয়ে চট্টগ্রামের নগরের সাহসী নাগরিকরা ২০০৫ এর নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের ভোটের ফল উল্টে দেওয়ার সব পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেন। এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর  মেয়াদেই  পরিচ্ছন্নতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন 'অনন্য দৃষ্টান্ত' স্থাপন করেছিল বলে অনেকে মনে করেন। হেলদি সিটি র‌্যাংকিং এ চট্টগ্রামের নামও পাওয়া যেত তার সময়ে। 

জাতীয় পর্যায়ের মনোযোগ পেয়েও শুধু চট্টগ্রাম ভালোবেসে তিনি মন্ত্রিত্ব না নিয়ে উনার প্রাণের শহরেই থেকে গেলেন শেষ পর্যন্ত। চট্টগ্রাম তার শেষ নিঃশ্বাসের শহর। দেশি মান তো বটেই, বিশ্বমানের মেধাবী পেশাজীবীরা শুধু এই শহরের মায়া ছাড়তে পারেন না বলে কোথাও যান না। এ দফায়ও আশা করা যায় প্রতিবাদের যৌক্তিকতা মেনে সিআরবি নয়  অন্য কোন সুবিধাজনক জায়গায় এই হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। এই শহরের সংশপ্তক নাগরিকরা সব পারেন।

'শামুকখোল' একটি বিলুপ্তির হুমকিতে থাকা পাখি প্রজাতি  বিশেষ, একে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য মাননীয় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের বেঞ্চ একটি রুল ইস্যু করেন বছর দুয়েক আগে। আর মাত্রই কয়েকদিন আগে রাজধানীর হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রকল্পকে পাবলিক ট্রাস্ট ঘোষণা করে প্রকল্প এলাকার হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকানসহ সব ধরনের ব্যবসায়িক-বাণিজ্যিক স্থাপনা অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। রায়ে বলা হয়েছে, তুরাগ নদীর রায়ের নীতি অনুসারে ঢাকার হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রজেক্টকে পাবলিক ট্রাস্ট (জনসম্পত্তি) ঘোষণা করা হল। মাননীয় বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল এর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। ভরসা রাখতে চাই পরিবেশ সংবেদী উচ্চ আদালতের প্রতিও, কারণ আদালতই শেষ আশ্রয়স্থল।

গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে 'সেইভ সিআরবি' লিখে সবুজ মহীরুহ সহ প্রোফাইল  সাঁটা হচ্ছে, একে নিছক  সবুজ বাঁচানো পেটি বুর্জোয়া রোমান্টিকতার প্রকাশ ভাবা ঠিক হবে না। ধারণা করি সুবোধ মরেনি এখনো। কৃষি জমির ক্ষতি করে আড়িয়াল বিলে বিমা বন্দর নির্মাণ না করার স্মার্টনেস দেখিয়েছিল এ সরকারই, সেই সুবোধ জেগে উঠুক। পরিবেশ ও জলবায়ু ইস্যুতে  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কমিটমেন্ট তাকে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের মতো বৈশ্বিক ফোরামের  নেতৃত্বে এনেছে। সিআরবি-র সবুজ বাঁচানো ইস্যুতে তার আন্তরিক সংবেদী হস্তক্ষেপ কামনা করছেন সবাই।

                      "মধ্যাহ্নে মাঠের মাঝে একাকী বিষন্ন তরুচ্ছায়ে

                       দূর-বনগন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তপ্তবায়ে

                       সারাদিন বাজাইলি বাঁশি!ওরে তুই ওঠ আজি!

                       আগুন লেগেছে কোথা? কার শঙ্খ উঠিয়াছে বান"

রবীন্দ্রনাথের এবার ফিরাও মোরে! কবিতার প্রথম দু পঙক্তি মনে আসতো সিআরবি-র ছায়াময় সবুজ দেখে। এখন নতুন প্রতিবাদের প্রেক্ষাপটে পরের দু-পঙক্তিও বেশ মানিয়ে যায়। নগরের সবুজ প্রায়   অন্তর্হিত যা একটু কোথাও আছে তাও ধূসর হওয়ার পথে। বলতে ইচ্ছা করে পাহাড়ে কান পাতুন শুনতে পাবেন-.

                                       তোমরা বল মহীরুহ

                                       আমি বলি আমার রুহ।

এই রুহ গাছের, পাহাড়ের। এই রুহ আমার, আপনার, এই রুহ প্রকৃৃতির। আমি-আপনিও এই প্রকৃৃতির অংশ।

আশার কথা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) 'হেরিটেজ জোন' বিবেচনায় সিআরবি'তে কোন বাণিজ্যিক স্থাপনার অনুমোদন দিবে না বলে জানিয়েছে। আমরা ভরসা রাখতে চাই সিডিএ-এর এমন অবস্থানের প্রতি।